পাহাড়ের রাজনীতি আর আবহওয়া একই রকম। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পাহাড়ের জলবায়ু চা চাষের উপযুক্ত হলেও ঘাসফুলের নয়। এখনও পর্যন্ত বাংলার সর্বত্র বিজয়পতাকা তুলতে পারলেও দার্জিলিং লোকসভা আসন একটি বারও জিততে পারেনি শাসক তৃণমূল। পর পর তিন বার পদ্ম ফুটলেও তা একা করতে পারেনি বিজেপি। প্রতিটি জয়েই পাহাড়ি দলের সমর্থন দরকার হয়েছে। এ বারেও সুবাস ঘিসিংয়ের গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের সমর্থনেই লড়ছে বিজেপি। পদ্মশিবিরের সঙ্গে রয়েছে বিমল গুরুঙের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাও।
পাহাড়ের রাজনীতিতে ফি-বারে ক্ষমতার হস্তান্তর দেখা গিয়েছে। স্বাধীনতার পরে পরে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলেও পরে সিপিএমের দখলে যায় পাহাড়। তবে একা নয়, আঞ্চলিক দলের সমর্থন নিতে হয়েছে। আর সেই সমর্থন বার বার বদলানোয় কখনও বাম, কখনও কংগ্রেস এই ভাবেই চলে। তবে ১৯৯৬, ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে অকাল ভোটে সিপিএম জিতেছিল। তবে প্রতি ভোটেই বদলে যায় সাংসদ। বিজেপির ক্ষেত্রেও তাই হয়ছে। ২০০৪ সালে কংগ্রেসের জেতা দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্র বিজেপি ২০০৯ সালে দখল করার সময়ে সাংসদ হন যশোবন্ত সিংহ। কিন্তু পরের বারেই প্রার্থী বদলায় বিজেপি। ২০১৪ সালে সাংসদ হয়ে কেন্দ্রে মন্ত্রীও হন সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। আবার ২০১৯ সালে অহলুওয়ালিয়াকে বর্ধমান-দুর্গাপুরে প্রার্থী করে দার্জিলিঙে বিজেপি নিয়ে আসে আদতে মণিপুরের বাসিন্দা রাজু বিস্তাকে। এ বার ফের রাজু প্রার্থী হলেও একটা সময় পর্যন্ত শোনা গিয়েছিল অন্য নাম। প্রাক্তন বিদেশেসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা প্রার্থী হচ্ছেন, এমন জল্পনা তৈরি হওয়ার সময়েও ‘আত্মবিশ্বাসী’ রাজু অবশ্য বলেছিলেন, ‘‘এ বার আর বিজেপি প্রার্থী বদল করবে না।’’
দার্জিলিঙের হিসাব-নিকাশ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
বাস্তবেও সেটাই হয়েছে। রাজুই লড়ছেন তৃণমূলের গোপাল লামার বিরুদ্ধে। তবে দার্জিলিঙে রাজুর একটা ‘কাঁটা’ও রয়েছে। তিনি দলেরই বিধায়ক বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা। দল কোনও ‘ভূমিপুত্র’কেই পাহাড়ে টিকিট দিক বলে দাবি তুলেছিলেন বিজেপি বিধায়ক বিষ্ণুপ্রসাদ। সে দাবি না-মানায় নির্দল হয়ে দলেরই প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়েছেন কার্শিয়াঙের বিজেপি বিধায়ক। তবে তাতেও রাজুর জন্য দার্জিলিং ‘কঠিন’ আসন, এমনটা বলা যাবে না। তার কারণ গত লোকসভা এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফল।
২০১৪ সালে বিজেপি দার্জিলিঙে জিতেছিল ১,৯৭,২৩৯ ভোটে। ২০১৯ সালে সেই ব্যবধান বাড়িয়ে ৪,১৩,৪৪৩ ভোট করেন রাজু। বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ৪২.৭৩ থেকে হয়ে যায় ৫৯.১৯ শতাংশ। তৃণমূলের ভোট মোটামুটি একই জায়গায় ছিল। ২০১৯ সালে তৃণমূল দার্জিলিঙে পেয়েছিল ২৬.৫৬ শতাংশ ভোট।
কিন্তু গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলে একটু হলেও দার্জিলিঙে পিছিয়ে যায় বিজেপি। তাদের প্রাপ্ত ভোট কমে হয় ৪৩.৬৮ শতাংশ। সেখানে তৃণমূলের ভোট বেড়ে হয় ৩১.৩৭ শতাংশ। লোকসভায় বিজেপি ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল। তৃণমূল জেতে শুধু চোপড়ায়। বিধানসভা নির্বাচনে চোপড়া তৃণমূল ধরে রাখার পাশাপাশি দলের সমর্থিত বিজিপিএম প্রার্থী জেতেন কালিম্পঙে।
এমন সব পরিসংখ্যান বুঝিয়ে দেয়, পাহাড়ের আবহাওয়ার মতোই সেখানকার রাজনৈতিক ভারসাম্য অনবরত বদলায়। কখন মেঘ, কখন বৃষ্টি আর কখন ঝকঝকে রোদ উঠবে, সেটা আগে থেকে বলা যায় না। যেমন উত্তাল পাহাড়কে শান্ত করতে পারা তৃণমূল মনে করেছিল ভারতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক ভাইচুং ভুটিয়াকে জেতাতে পারা যাবে। কিন্তু তা হয়নি। তবে এ বার বিজেপি জিতলে নতুন রেকর্ড তৈরি হবে। এই প্রথম টানা চার বার কোনও দল জিতবে দার্জিলিঙে। একই দলের টিকিটে পর পর দু’বার সাংসদ হওয়ার কৃতিত্ব প্রথম পাবেন রাজু।