শুভেন্দু অধিকারী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এখনও গোটা প্রার্থিতালিকা প্রকাশিত হয়নি। বাকি চার আসনের প্রার্থীর নাম ঘোষণা। কিন্তু দিল্লিবাড়ির লড়াই নিয়ে বিজেপির অভ্যন্তরীণ লড়াই জমে উঠেছে। দলের অন্দরে এখন একটাই আলোচনা— প্রার্থী বাছাইয়ে কার কথা বেশি গুরুত্ব পেল? রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার না কি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী? তবে বেশির ভাগ নেতাই বলছেন শুভেন্দুর সঙ্গে সুকান্তের আদৌ কোনও প্রতিযোগিতাই নেই। বেশিরভাগ আসনেই একতরফা ভাবে জয় পেয়েছেন শুভেন্দু। অধিকারীর অধিকারকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে।
উত্তরবঙ্গে সে ভাবে প্রার্থী বদল হয়নি। হয়েছে আলিপুরদুয়ার এবং রায়গঞ্জে। প্রথম আসনটির সাংসদ জন বার্লা এখনও কেন্দ্রের প্রতিমন্ত্রী। তিনি টিকিটই পাননি। দ্বিতীয়টির দেবশ্রী চৌধুরী এ বার টিকিট পেয়েছেন কঠিন আসন কলকাতা দক্ষিণে। এই দুই আসনে এ বার প্রার্থী মাদারিহাটের বিধায়ক মনোজ টিগ্গা এবং কার্তিক পাল। বিজেপির পুরনো দিনের নেতা মনোজ টানা দু’বার বিধানসভায়। এখন মুখ্য সচেতক। সেই সঙ্গে কয়েক মাস আগেই আলিপুরদুয়ারের জেলা সভাপতি হয়েছেন। ‘আদি’ বিজেপি হলেও বিধানসভায় শুভেন্দুর ‘সেনাপতি’ হিসাবেই টিগ্গার পরিচয়। আবার রায়গঞ্জে বিজেপি প্রার্থী কার্তিক পালও শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠ হিসাবেই পরিচিত।
শুভেন্দুর বড় প্রভাব দেখা গিয়েছে দুই মেদিনীপুরে। কাঁথিতে নিজের ভাই সৌমেন্দু অধিকারী এবং তমলুকে আর এক ভাই দিব্যেন্দুর ছেড়ে দেওয়া আসনে প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রার্থী। এর নেপথ্যে শুভেন্দুর ভূমিকার কথা সকলেরই জানা। পশ্চিম মেদিনীপুরে দু’টি আসন। ঘাটালে শুভেন্দুর কথাতেই প্রার্থী করা হয় খড়্গপুর সদরের বিধায়ক হিরণ চট্টোপাধ্যায়কে। তিনি তো শুভেন্দুর সঙ্গে সঙ্গেই বিজেপিতে এসেছিলেন গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে। আর মেদিনীপুরে তো শুভেন্দু বড় জয় পেয়েছেন বলে মনে করছে পদ্মশিবির। বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ মেদিনীপুরে জয়ের মধ্যে দিয়েই রাজ্যে বিজেপির নতুন দিন তৈরি করেছিলেন। সেই দিলীপই এ বার মেদিনীপুরে টিকিট পেলেন না। বিজেপির অন্দরে কান পাতলে শোনা যায়, দিলীপের বদল অন্য কাউকে ওই আসনে প্রার্থী করার প্রবক্তা ছিলেন শুভেন্দুই। প্রথমে প্রাক্তন আইপিএস ভারতী ঘোষকে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সায় না দেওয়ায় শেষে প্রার্থী করা হয় শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ অগ্নিমিত্রা পালকে। শুভেন্দুর আগেই বিজেপিতে এলেও আসানসোল দক্ষিণের বিধায়ককেও ইদানীং বিরোধী দলনেতার ঘনিষ্ঠ হিসাবে মনে করা হয়।
এ বার বিজেপি বেশ কয়েক জন বিধায়ককেই প্রার্থী করেছে। হিরণ, মনোজ, অগ্নিমিত্রা ছাড়াও বারাসতে টিকিট পেয়েছেন বনগাঁ দক্ষিণের স্বপন মজুমদার, মুর্শিদাবাদে স্থানীয় বিধায়ক গৌরীশঙ্কর ঘোষ, বর্ধমান পূর্বে হরিণঘাটার বিধায়ক অসীম সরকার। পরিষদীয় দলের এই সদস্যদের লোকসভা ভোটে প্রার্থী করার কথা নাকি শুভেন্দুই বলেছিলেন। মালদহ দক্ষিণে প্রার্থী হয়েছেন ইংরেজবাজারের বিধায়ক শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী। তবে তিনি ২০১৯ সালেও ওই আসন থেকেই প্রার্থী হয়েছিলেন। এ ছাড়াও বহরমপুরের প্রার্থী নির্মল সাহা, হাওড়ার রথীন চক্রবর্তী, বোলপুরের পিয়া সাহার নামও নাকি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে দেওয়া শুভেন্দুর তালিকাতেই ছিল।
কলকাতার আশপাশেও শুভেন্দুর প্রভাব স্পষ্ট। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসা তাপস রায় কলকাতা উত্তরে প্রার্থী হয়েছেন। দমদমে টিকিট পেয়েছেন শীলভদ্র দত্ত, ব্যারাকপুরে অর্জুন সিংহ। এঁদের সঙ্গে শুভেন্দুর সম্পর্কের কথা তো নতুন করে বলার দাবিই রাখে না। সব চেয়ে বড় কথা বসিরহাটের প্রার্থী রেখা পাত্র। সন্দেশখালির ‘প্রতিবাদী’ বধূকে কী ভাবে প্রার্থী হতে রাজি করানো গেল, কী ভাবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বোঝানো গেল— সে কাহিনি বিজেপির অনেক শীর্ষ নেতার কাছেই অজানা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তা গোপন রেখে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিলমোহর আদায়ের নেপথ্যে শুভেন্দুরই বড় ভূমিকা ছিল বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে। রাজ্য নেতারা বলছেন, বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে রাজনীতি শুভেন্দু এতটাই ভাল বোঝেন যে, ভাল ফলের লক্ষ্যে তাঁর কথাকে মান্যতা দেওয়াই সঠিক বলে মনে করেছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
সুকান্তের কি তবে কোনও ভূমিকাই নেই? দলের আলোচনায় বলা হচ্ছে, পুরনো সাংসদদের আরও কয়েক জনের টিকিট অনিশ্চিত ছিল। সেটা নিশ্চিত করায় বড় ভূমিকা ছিল সুকান্তের। এমনকি, দিলীপের আসন বদল নিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি লড়েছিলেন। একটা সময়ে এমন মনে করা হচ্ছিল যে, দিলীপকে প্রার্থীই করা হবে না। আবার এমন জল্পনাও ছিল যে, আসন বদল হলে দিলীপ প্রার্থী হবেন না। শেষ পর্যন্ত সে সবের সমাধান সূত্রে দেন সুকান্তই। তবে শুভেন্দুর কাছে অনেক আসনেই তিনি পেরে ওঠেননি। যদিও সুকান্ত বলেন, ‘‘কেউ কারও প্রার্থী নন। বিজেপি সংগঠনের জোরে জেতে। আর নরেন্দ্র মোদীকে তৃতীয় বার ক্ষমতায় আনার জন্যই মানুষ ভোট দেবেন।’’