আলম রহমান। সংগৃহীত ছবি।
ছোট থেকে ঘাড় সোজা হত না। হাতে তেমন জোর পেতেন না। তাতে কী? পা দিয়ে লিখেই চলত পড়াশোনা। প্রতিবন্ধকতা বাধ সাধলেও হার মানাতে পারেনি তাঁকে। ছোট থেকেই চলছে লড়াই। তবে শুধু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নয়, দোসর অর্থাভাবও। এই দ্বিমুখী লড়াই নিয়েই মাধ্যমিকের পর উচ্চ মাধ্যমিকেও সাফল্যের মুখ দেখলেন মুর্শিদাবাদের কান্দি রাজ হাই স্কুলের আলম রহমান। মোট ৫০০-র মধ্যে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৪০২। তাঁর সাফল্যে খুশি পরিবার-পরিজন থেকে এলাকাবাসী।
মুর্শিদাবাদের কান্দি মহকুমার বৈদ্যনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা আলম। বাবার একটি ছোট মুদির দোকান রয়েছে। মা গৃহবধূ। তাঁকে দেখভালের পুরো দায়িত্বই তাঁর মায়ের। সঙ্গে সাহায্য করে তাঁর দুই বোনও। ছোট থেকে ১০০ শতাংশ প্রতিবন্ধকতা নিয়ে পড়াশোনা করলেও কখনওই নিজেকে অন্য সকলের চেয়ে আলাদা মনে করতে চায়নি আলম। তাই মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক— দু’ক্ষেত্রে অন্য সকলের সঙ্গে ‘নরমাল’ স্কুলে পড়েছে সে। কোনও ‘বিশেষ’ স্কুলে ভর্তি হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা দেখা গেলেও আলমের বন্ধুরা বরাবর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রেখেছিলেন। তাঁকে সাহায্য করেছেন তাঁর স্কুলের শিক্ষক থেকে গৃহশিক্ষক—সকলেই। বরাবর স্কুলে ফার্স্ট হওয়া এই ছেলে মাধ্যমিকেও সবাইকে চমকে দিয়ে স্কুলে প্রথম হয়েছিলেন। শুধু ‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন’-দের মধ্যে নয়, সার্বিক ভাবে। ৭০০য় তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৬২৫। উচ্চ মাধ্যমিকেও এ বার তাঁর ঝুলিতে রয়েছে ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর। মাধ্যমিকে ‘রাইটার’ নিলেও উচ্চ মাধ্যমিকে পা দিয়ে লিখেই এই ফল! কী ভাবে এই অসাধ্যসাধন? আনন্দবাজার অনলাইনকে আলম বলেছেন, “পড়তে ভাল লাগে। তাই সারা বছরই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছি। তবে হাড়ে ব্যথার জন্য টানা পড়তে পারতাম না। রেস্ট নিয়ে নিয়েই পড়তাম।” বিজ্ঞান অনুরাগী এই ছাত্রের প্রিয় বিষয় অঙ্ক এবং পদার্থবিদ্যা। অবসরে পছন্দ গল্পের বই পড়া, কবিতা লেখা এবং বোনেদের সঙ্গে গল্প করা।
ভবিষ্যতে কি তা হলে চিকিৎসক বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন? আক্ষেপের সুরে বললেন, “না, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে একটু আগ্রহ থাকলেও পড়াশোনার জন্য অনেক যন্ত্রপাতি ব্যবহারেরও প্রয়োজন হবে, বাকিদের মতো তো আমি সে সব অতো পারব না।” তা হলে? কী পরিকল্পনা ভবিষ্যতের? তাঁর কথায়, “আমি বিজ্ঞানের যে কোনও বিষয়ে স্নাতক হয়ে ডব্লিউবিসিএস অফিসার হতে চাই। সুযোগ পেলে ইচ্ছে রয়েছে সর্বভারতীয় স্তরের ইউপিএসসি পরীক্ষা দেওয়ারও।”
ছেলেকে খাওয়ানো, স্নান করানো থেকে শুরু করে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসা, সব কিছুই একা হাতে সামলান আলমের মা। তাই ছেলের সাফল্যে গর্বিত হলেও এখন মনে একরাশ চিন্তার ভিড়। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, “আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে আমরা তো আলমকে মাধ্যমিকের পর আর পড়াবই না ঠিক করেছিলাম। ওর এতো ভাল রেজ়াল্ট! থেকে তখন কান্দি পৌরসভার চেয়ারম্যান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। স্কুলের কাছে থাকার জন্য বাড়িভাড়ার টাকাটা উনিই দেন। সরকারি খাতে ১০০০ টাকা এবং প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর সাহায্য পায় আলম। কিন্তু তাতেও ওর পড়াশোনা, চিকিৎসার খরচ চালানো দিন দিন মুশকিল হয়ে উঠছে। কী ভাবে ছেলের স্বপ্নপূরণ করব, এখন দিনরাত শুধু সেই চিন্তা।” আলমের এতদিনের লড়াই যাতে বিফলে না যায়, তাই সকলের কাছে কাতর স্বরে আবেদন জানিয়েছেন তাঁর মা।
দুর্বল শরীরেও মুখে এক গাল হাসি আলমের। চোখে এক রাশ স্বপ্ন। এখন শুধু প্রয়োজন একটু আর্থিক সাহায্যের। বাকি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত তিনি।