পথ লাইব্রেরি থেকে বই পড়ছেন পথচলতি মানুষ। নিজস্ব চিত্র।
রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে সবে চা-এ চুমুক দিয়েছেন। হঠাৎ চোখে পড়ল রাস্তার ধারে ছোট কাচের আলমারির মতো কী যেন! কাছে গিয়ে দেখলেন সারি সারি বইয়ের সম্ভার! আলমারির এক পাশে সাজিয়ে রাখা গল্পের বই। অন্য পাশে ‘ওয়াল ম্যাগাজ়িন’। আর মাথার ভিতর উঁকি দিচ্ছে কৌতূহল। সামনে বসে থাকা ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর আসবে, ‘‘এটা পথ লাইব্রেরি।’’
উত্তর কলকাতার দেশবন্ধু পার্কের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাছে ‘উত্তরের আড্ডা’। এক চায়ের দোকান ঘিরে তৈরি আড্ডার ঠেক। তারই উদ্যোগে মুঠোফোনের জগৎ থেকে শিশুদের বার করে আনতে ২০২২ সালে তৈরি হয় এই পথ লাইব্রেরি। ‘উত্তরের আড্ডা’-র কার্যনির্বাহী সদস্য সুভাষ দাস জানান, ছোটদের কাছে পড়াশোনার বাইরের দুনিয়া বলতে মূলত এখন একটাই জায়গা। স্মার্টফোনের স্ক্রিন। অবসর বলতে যেটুকু হাতে সময় থাকে, তার সবটাই চলে যায় সেই স্ক্রিনের দখলে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গল্পের বই পড়ার প্রবণতা।
নিজস্ব চিত্র।
শিক্ষক দিবসকে উপলক্ষ করে বছর তিনেক আগে শুরু হয় এই পথ লাইব্রেরির যাত্রা। আলাদা ভাবে লাইব্রেরি কার্ড নেই। নেই কোনও টাকা-পয়সার লেনদেন। শুধু একটাই আশা, সকলে যাতে একটু বই পড়ে। সুভাষের কথায়, ‘‘এখন বিখ্যাত কোনও লেখকের বই সমাজমাধ্যমে খোঁজ করলে বেশির ভাগ সময় পিডিএফ ফাইল পাওয়া যায়। সরাসরি হাতে গল্পের বই নিয়ে পড়ার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। শিশুদের এই স্ক্রিন-বন্দি জীবন থেকে মুক্ত করতেই ২০২২ সালে ৫ সেপ্টেম্বর তৈরি হয় এই পথ লাইব্রেরি।’’
কিন্তু বই আসছে কোথা থেকে? খরচই বা বহন করা হয় কী ভাবে? ‘উত্তরের আড্ডা’ সূত্রে খবর, এলাকাবাসীরা তো বটেই, পথ চলতি বহু মানুষও এখানে গল্পের বই রেখে যান। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে বেড়েছে বইয়ের সম্ভার। একটাই শর্ত, আলমারি থেকে পছন্দমতো বই বার করে যত ক্ষণ ইচ্ছে পড়ার পরে আবার আলমারিতেই রেখে দিতে হবে। আলমারিতে কোনও সময়েই তালা ঝোলানো থাকে না। ফেলে দেওয়া গাছের গুঁড়ি দিয়ে সামনে বানানো রয়েছে ছোট ছোট টুল। চায়ের দোকানের পাশাপাশি চার দিকটা আলোয় ঘেরা। ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাদের উদ্দেশ্য, চায়ের দোকানে যখন বয়স্কদের ভিড় জমে, তখন সঙ্গে আসা ছোট্ট শিশুটি যাতে পাশে গল্পের বই নিয়ে বসতে পারে। পরবর্তীতে এই লাইব্রেরি আরও বাড়িয়ে তোলার ইচ্ছে রয়েছে। যেখানে সমাজ সচেতনতামূলক বিভিন্ন বই রাখা হবে।’’
শুধু বই পড়াই নয়। ‘ওয়াল ম্যাগাজ়িন’-এ টাঙানো নানা রকম ছবি থেকে কবিতা। যদি চান, আপনার নিজস্ব কোনও ছবি বা লেখা সকলের কাছে পৌঁছক, সেই সুযোগও দিচ্ছে ‘উত্তরের আড্ডা’। কিন্তু এই লাইব্রেরি হোক বা ‘ওয়াল ম্যাগাজ়িন’, মুঠোফোনের দুনিয়ায় কি হারিয়ে যাচ্ছে সবটাই? সংগঠনের সম্পাদক তপন বসাক বলেন, ‘‘ তিন বছরের দিকে এগোচ্ছে এই গ্রন্থাগার। কিন্তু দেখা গিয়েছে, বেশির ভাগ সময়ই বয়স্ক মানুষরা এসে বই পড়েন। ছোটদের মধ্যে আগ্রহ খুবই কম।’’
নিত্যদিনের ব্যস্ততায় কমেছে মাঠে খেলাধুলো। ভারী ব্যাগের বোঝা রাখতে না রাখতেই শুরু হয় যায় টিউশন ক্লাস। যেটুকু অবসর সময় রয়েছে, সেখানে মাথা গোঁজা থাকে মুঠোফোনেই। এ সবের মধ্যেই এখন শিশু হারাচ্ছে তার শৈশব। হারিয়ে ফেলছে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুকুমার রায়, লীলা মজুমদারকেও।