লকডাউনে যন্ত্রবৎ একই কাজ করিয়া মানুষ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছে ইহা যেমন সত্য, তেমনই সত্য— এই অবসাদ কাটাইবার বহুবিধ উপায় প্রকাশ্যে আসিতেছে। সমাজমাধ্যম ভরিয়া গিয়াছে অখণ্ড অবসরযাপনকে সহনীয় ও আকর্ষক করিয়া তুলিবার প্রয়াসে। লেখক স্বরচিত গল্প-কবিতা শুনাইতেছেন, নৃত্যশিল্পী নাচের ভিডিয়ো শেয়ার করিতেছেন, ইন্টারনেটে বিনামূল্যে রাশি রাশি চলচ্চিত্র দেখিবার ও বই পড়িবার সুযোগ মিলিতেছে। কেহ ছবি আঁকিতেছেন, কেহ দেখাইয়া দিতেছেন নিতান্ত সামান্য উপকরণ দিয়াও কী রূপে নূতন ও স্বাদু পদ রাঁধা যাইতে পারে। তাহা সত্ত্বেও অভিযোগের অন্ত নাই, এত কিছু করিবার পরেও বাঁচিয়া যাওয়া সময় কী করিয়া কাটাইব। প্রিয়জনমুখ দেখিবারও ক্লান্তি আছে, গৃহবন্দি মানুষ মুখে না বলিলেও সম্যক উপলব্ধি করিতেছে।
সর্বাধিক অসুবিধা তারুণ্যের, বলিলে ভুল হইবে কি? বয়স্ক মানুষেরা তবু সময়ের স্রোতে ভিড়িয়া যান, অল্পবয়সিদের পক্ষে তাহা প্রায় অসম্ভব। শিশুকেও ভুলাইয়া রাখা যায়, তরুণকে যায় না। তরুণ-যুবারা স্বভাবত প্রাণচঞ্চল ও ব্যস্ত, বৃথা সময় নষ্ট করিবার সময়ও তাহাদের নাই। লকডাউনে ঘরে বসিয়া থাকা তাহাদের কাছে দুঃসহ, এমন ভাবনা অসঙ্গত নহে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও একরৈখিক যাহা কিছুকেই বৈচিত্রময় করিয়া তোলা, নিয়ম ভাঙিবার নিয়ম মানাই যাহাদের সহজাত প্রবৃত্তি, এই ক্লান্তিকর সময় কি তাহাদের কাছে দুর্বহ হইবে না? মনস্তত্ত্ববিদরা কিন্তু অন্য কথা বলিতেছেন। তাঁহাদের মতে, বয়স্ক মানুষের নিকট যাহা ক্লান্তি ও অবসাদ, তারুণ্যের কাছেই তাহাই নূতন কিছু করিবার প্রেরণা। লকডাউনে তরুণদের বরং অধিক সৃষ্টিশীল হইয়া উঠিবার সম্ভাবনা। চিনের উহানে করোনার তাণ্ডবের পরে ঘরে বসিয়া পড়াশোনা করিবার জন্য কর্তৃপক্ষ একটি অ্যাপ চালু করিয়াছিল। কিন্তু এত দিন পর আবার পড়াশোনা কেন, এই বলিয়া সেখানকার ছাত্র-সম্প্রদায় পরিকল্পনামাফিক সম্মিলিত ভাবে ইন্টারনেটে অ্যাপটির এমন প্রযুক্তিগত বিরুদ্ধ-সমালোচনা করিল যে তাহা বন্ধ হইয়া গেল। কেহ বলিতে পারেন, ইহা তো কুকর্ম, সৃষ্টিশীলতা কোথায়? কিন্তু মনোবিজ্ঞানী বলিবেন, সুকৃতি-দুষ্কৃতি মূল্যবোধের ব্যাপার, তাহা সরাইয়া দেখিলে বুঝা যাইবে, প্রযুক্তিকে কাজে লাগাইয়া যে উপায়ে তাহারা ইচ্ছা পূরণ করিল, তাহাকে বাহবা দিতে হইবে বইকি।
অর্থাৎ সৃষ্টিশীলতা যে কেবল মুক্ত অবাধ পরিবেশেই বাড়িয়া উঠিবে, তাহা নহে। অন্তত তারুণ্যের ক্ষেত্রে নহে। বরং বাধাবিপত্তি আসিলেই তাহাদের উদ্ভাবনী শক্তির অধিক পরিচয় পাওয়া যায়। করোনার ন্যায় জরুরি অবস্থাই দেখাইয়াছে, কোনও কিশোরী ঘরে বসিয়া জীবাণুনাশক অভিনব মাস্ক, কোনও তরুণ বিকল্প পিপিই বা ভেন্টিলেটর বানাইয়াছেন। অগণিত তরুণ প্রযুক্তির সাহায্যে এমন যোগাযোগ সম্ভব করিয়াছেন, যাহার দ্বারা দূর রাজ্যে আটকাইয়া পড়া নিরাশ্রয় অভুক্ত শ্রমিকের খাওয়া-পরার সংস্থান হইয়াছে। এই সকল কাজের পশ্চাতে উপচিকীর্ষা ও সাধু উদ্বেগ রহিয়াছে সত্য, কিন্তু মূলে রহিয়াছে অখণ্ড অবকাশের ভ্রুকুটি। হয়তো প্রশ্ন করিলে এই উত্তরও আসিবে, কর্তৃপক্ষ কাজের কাজ কিছু করিতেছিল না, তাই আমি করিলাম। লকডাউনের ক্লান্তি এহেন সৃষ্টিশীলতার জন্ম দিলে তাহা সর্বার্থেই স্বাগত।