‘মাদকের’ মহামারির কবলে আমেরিকা। সিন্থেটিক ড্রাগ, যা ব্যথা-বেদনা উপশমে ব্যবহৃত হয়, তা-ই এখন আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেই সিন্থেটিক ড্রাগের নাম ফেন্টানিল। এটি হেরোইনের তুলনায় ৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী। এই মাদকের উৎপাদনমূল্যও অনেক কম। আমেরিকায় গত বছর সেই ফেন্টানিল অতিরিক্ত সেবনের কারণে ৭৫ হাজার জনের মৃত্যু হয়েছে।
কিন্তু কী সেই মারণ মাদক, যা নিয়ে চিন্তা বেড়েছে আমেরিকার? ফেন্টানিল হল একটি অনুমোদিত শক্তিশালী সিন্থেটিক ওপিওড ড্রাগ।
বেদনানাশক এবং রোগীকে অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহৃত এই ওষুধ মরফিনের চেয়ে প্রায় ১০০ গুণ এবং হেরোইনের চেয়ে ৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী।
ওয়াশিংটনের বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, ফেন্টানিল সেবনের কারণে আমেরিকায় প্রতি দিন গড়ে ২০০ জনের মৃত্যু হয়। ক্রেতাদের অজান্তেই হেরোইন বা কোকেনের মতো ফেন্টানিলও অন্যান্য পদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে ধরানো হয় নেশা।
‘ইউএস হাউস কমিটি’র মতে, ১৮-৪৫ বছর বয়সি আমেরিকার বাসিন্দাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ ফেন্টানিল। ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেল্থ স্ট্যাটিস্টিকস’ অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২২ এবং ২০২৩ সালে আমেরিকার প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ অতিরিক্ত ফেন্টানিল সেবনের কারণে মারা গিয়েছেন।
কিন্তু এই ‘মাদকের’ উৎস কোথায়? কী ভাবেই বা আমেরিকায় মহামারির মতো ছড়াচ্ছে সেই মাদকের নেশা? উত্তর— চিন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পও সেই সমস্যার দিকে নজর রেখেছেন।
ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে, তিনি ফেন্টানিলের রমরমা নিয়ন্ত্রণে চিনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক বাণিজ্য শুল্ক আরোপ করবেন। ফেন্টানিল সমস্যা কখন শুরু হয়েছিল? কী ভাবে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সঙ্কটে পরিণত হল যে আমেরিকার সরকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা ঘোষণা করেছে?
আগামী ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের পদে বসবেন ট্রাম্প। তবে তার আগেই ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, ‘‘মেক্সিকো এবং কানাডার মধ্যে দিয়ে আমেরিকায় অপরাধ এবং মাদক চালান এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যা আগে দেখা যায়নি।’’
ট্রাম্প আরও বলেছিলেন, ‘‘আমাদের দেশে মাদক, বিশেষ করে ফেন্টানিল চালান এবং অবৈধ শরণার্থীদের আক্রমণ পুরোপুরি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত শাস্তিমূলক বাণিজ্য শুল্ক বহাল থাকবে।’’
গত ২৫ নভেম্বর নিজের সমাজমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ চিনা পণ্যের উপর ১০ শতাংশ এবং মেক্সিকো ও কানাডার পণ্যগুলির উপর ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কথা জানিয়েছেন ট্রাম্প।
আমেরিকায় অবৈধ ওষুধ, বিশেষ করে ফেন্টানিলের রমরমা রোধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ না করার জন্য চিনের সমালোচনা করেন ট্রাম্প। আমেরিকার হবু প্রেসিডেন্ট দাবি করেছেন, এই বিষয়ে চিনের সঙ্গে অতীতের আলোচনায় কোনও লাভ হয়নি।
চিন অবশ্য আমেরিকার ফেন্টানিলের রমরমার জন্য নিজেদের দায়ী করতে কোনও মতেই রাজি নয়। চিনের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে একটি বিবৃতি জারি করে বলা হয়, ‘‘২০১৯ সালের প্রথম দিকে চিন আনুষ্ঠানিক ভাবে ফেন্টানিলের মতো সমস্ত পদার্থ নিয়ে তদন্ত শুরু করে এবং চিনই বিশ্বের প্রথম দেশ যারা এমনটা করেছে। আমেরিকার সঙ্গে এক হয়ে মাদক বিরোধী অভিযান চালিয়েছে চিন, যা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। এই সত্য সকলের কাছেই পরিষ্কার।’’
চিনের যুক্তি, ফেন্টানিলের রমরমার জন্য দায়ী আমেরিকাই। চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মাও নিং গত মাসে অক্টোবরে বলেছিলেন, ‘‘ফেন্টানিল অতিরিক্ত সেবনের মূল কারণ আমেরিকাতেই রয়েছে। আমেরিকার সরকারের আরও কার্যকর পদক্ষেপ করা উচিত।’’
চিন এমন দাবি করলেও আমেরিকায় ফেন্টানিলের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে। এটি আমেরিকায় মাদক-সঙ্কটের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
প্রথম ট্রাম্প জমানার তুলনায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জমানায় সীমান্তে বাজেয়াপ্ত করা ফেন্টানিলের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে আমেরিকার সীমান্ত এলাকা থেকে যেখানে ১,১৫৪ কিলো ফেন্টানিল উদ্ধার করা হয়েছিল, ২০২৪ সালে সেই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২,২৪৭ কিলো।
আমেরিকার দাবি, তাদের দেশে বেশির ভাগ ফেন্টানিল পাচার হয় মেক্সিকোর পথে। তবে ‘ইউএস ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ আমেরিকায় পাচার হওয়া ফেন্টানিলের ‘প্রধান উৎস’ হিসাবে চিনকেই দায়ী করেছে।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালের পর থেকে আমেরিকায় সিন্থেটিক মাদকে যত জনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই মারা গিয়েছেন বেআইনি ভাবে তৈরি ফেন্টানিল, অ্যাসিটাইল ফেন্টানিল এবং কার্ফেন্টানিলের মতো মাদক সেবন করে।
আমেরিকার বুকে ফেন্টানিলের আবির্ভাব সত্তরের দশকে। সেই সময় এই মাদক বিক্রি করা হত ‘চায়না হোয়াইট’ নামে। তবে ২০১০ নাগাদ এর ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।
ফেন্টানিলের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে আমেরিকার সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা নিলেও মাদক সরবরাহ এখনও পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। মাদকটি মূলত বিভিন্ন বৈদ্যুতিন যন্ত্র, খেলনা-সহ অন্যান্য জিনিসের ভিতরে ঢুকিয়ে পাচার করা হয়।