প্রতীকী চিত্র।
তা হলে ব্যাপারটা দাঁড়াল এই— এ দেশের গয়নার বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে ও দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, সর্বত্রই যার অবাধ প্রতাপ, দিনকে যে এক তুড়িতে রাত করতে পারে, আর রাতকে করতে পারে সূর্য-আদপেই-না-উঠতে-পারা নিকষ কালো অতলতিমির, তারই নাম সোশ্যাল মিডিয়া। আমরা যেন সোশ্যাল মিডিয়ার জন্যই অপেক্ষা করে বসেছিলাম— আমাদের নীচে নামার অদম্য বাসনা নিয়ে, আরও কত, কত, কত পাতালে যাওয়া যায় সেই রাক্ষুসে পরীক্ষার আঁচে সব ছারখার করার আবেগটা ভেতরে পুষে রেখে। কেউ বলছে, বাবা ভাল খেলতে পারেনি যখন, নিয়ে এসো ওর বাচ্চা মেয়েকে, মজা করে নিই! কেউ বলছে, প্রেমিকের অসময়-মরণের কারণ জানা যাচ্ছে না যখন, প্রেমিকাটাই ডাইনি! কেউ বলছে অতিমারি বলে কিছু হয় না, ভ্যাকসিন নিলে ইমিউনিটি কমে মানুষ পটাপট মরবে, ভুলেও এদের ভোট দিয়ো না। কেউ বলছে, মুখে মাস্ক পরলে আমরা নিজের ভাইরাসে নিজেই দমবন্ধ হয়ে মরব জেনে যে নেতারা মাস্ক পরার কথা বলছেন তাঁদের কিডন্যাপ করো। আহা, সোশ্যাল মিডিয়া না হলে কী ভাবেই বা জানতাম কী পরিমাণ হিংস্র কীট কিলবিল করছে মানুষজাতির মাথায়, কেবল একটা আধারের অভাবে তাকে ঠেকা দেওয়া হচ্ছিল এত দিন ধরে। এত দিনে ঘটল আমাদের অবরুদ্ধ কামনাবাসনার চিরপ্রতীক্ষিত রিলিজ়, মুক্তি!
না, এ সব শুধু মিথ্যা বা ভুল নয়। সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে তৈরি সত্য-উত্তর বা পোস্ট-ট্রুথের গল্পটা ঢের বেশি বড়। এখন আমরা ইনস্ট্যান্ট এবং কনস্ট্যান্ট যোগাযোগের জন্য বিসর্জন দিতে পারি যে কোনও ‘সমাজ’ ও ‘সামাজিক’-এর ‘সোশ্যাল’-কে। ‘ভার্চুয়াল’-এর জন্য ছেড়ে দিতে পারি ‘রিয়েল’-কে। আর তা করতে পারি বলেই ‘অন্য’দের কথা ভাবতে হয় না আমাদের, কেবল নিজেরটুকু, খুব বেশি হলে নিজের পরিবার-পরিজনটুকু, ব্যস। যে সত্যিই অন্য বা আলাদা, তাকে চেনা চিরকালই কঠিন ছিল— কঠিন বলেই অনেক জ্ঞানবিজ্ঞান, ন্যায়নীতির ধার ধারতে হত, নিজের বাইরে বেরিয়ে কিছু ভাবা বা কল্পনা করাটা শিখতে হত— এখন সেই কাজটাকে আমরা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় বলে জেনেছি।
জেনেছি, নিজের স্ক্রিনের সঙ্গে নিজে থাকাটাই বেঁচে থাকা, তার চেয়ে বৃহত্তর বা মহত্তর কিছু হয় না। আমি-র শুরু ও শেষ আমি-তেই, তাই আমার যা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে, তা-ই বিশ্বাস করি। যা বিশ্বাস করি, তাকেই ‘বাস্তব’ বলে জানি। যাকে ‘বাস্তব’ বলে জানি, অন্যদেরও তা বিশ্বাস করতে বাধ্য করি। বার বার বলতে থাকি এক কথা, যাতে কথাটা ঘুরে ঘুরে দাঁড়িয়ে যায় নিজের পায়ের জোরে!
আর তাই, সোশ্যাল মিডিয়াকে আমাদের এত দিনের ওই সব চেনাজানা ‘লেভয়াথান’ বলা যাবে না, অরওয়েলের ‘১৯৮৪’-মডেল দিয়েও বোঝা যাবে না, কোনও ‘বিগ ব্রাদার’ আমাদের ‘ওয়াচ’ করছে না— এ কেবল ‘আমাদের’ই গল্প। আমরাই হুমড়ি খেয়ে স্ক্রিনের মধ্যে সেঁধিয়ে পাতালপ্রবেশের জন্য হুড়োহুড়ি করে মরছি। যাকে আমরা মুক্তির প্রযুক্তি বলে গৌরবধ্বজা উড়িয়েছি, তারই ফাঁস গলায় জড়িয়ে ঝুলে পড়তে আকুলিবিকুলি করছি। সোশ্যাল ডিলেমা নামে ছবিটি বলে দেয়, যে-সব বুদ্ধিধর নানা রকম যুগান্তকারী কাজ করে এই সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়াটাকে তৈরি করেছেন, তাঁরাও আজ হতভম্ব হয়ে দেখছেন, বিষবৃক্ষের বিষফল কী বীভৎস। শত চেষ্টাতেও মানুষ আজ পারবে না সোশ্যাল মিডিয়ার জাল কেটে বাইরে থাকতে। এরই মধ্যে প্রকৃতিও নীরব প্রতিশোধের ঠান্ডা হাসি হেসে চালটি চেলেছে, পাঠিয়ে দিয়েছে তার ভয়ঙ্করী দূতী অতিমারিকে, যাতে আর সব পথ বন্ধ হয়ে যায়, যাতে আমরা নিজ নিজ কুঠুরিতে বসে আন্তর্জালের পাতালপুরীতে ডুবতে পারি। এই সম্মেলক পাতালপ্রবেশের দায় আমাদেরই, বাইরে কাকে গাল দেব আর।
পাতালপুরীর নিয়ম-মতেই, আমরা প্রথমেই বানিয়ে ফেলি একটা শত্রুকোটর, আর তার পর সেই কোটরে ঢুকিয়ে দিই আমার যা-কিছু সমস্ত অপছন্দের জিনিস। ভারী সহজ কাজ, এর জন্য যুক্তি লাগে না, বুদ্ধি লাগে না, এক কণা ভাবতে হয় না। এত সহজ বলেই পুরনো জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা এটা করতে বারণ করত— উল্টে ‘ভাবতে’ বলত, ‘জানতে’ বলত। এখন আর দরকার নেই সেই সব গালভরা তত্ত্বকথার কিংবা তথ্যসংবাদের— আমার দরকার কেবল কালো-পক্ষ আর আলো-পক্ষ। সোশ্যাল মিডিয়াও আমাদের দেখে অবাক, অন্ধকার ঘনানোর কাজে এত যে তাদের আমরা হুমড়ি খেয়ে সাহায্য করব, সেটা তারা আগে বোঝেইনি তত।
বিস্ময়ের চোটে এই কিছু দিন আগেই ফেসবুক কোম্পানি নিজের পয়সায় লোক লাগিয়ে বিস্তর অঙ্ক কষে দেখেছে, লোকে যত ফেসবুক-টুইটার-ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি ব্যবহার করছে, ততই সমাজে আলো না বেড়ে কালো বাড়ছে, মেরুকরণ বাড়ছে, হিংসা মারামারি বাড়ছে, ধর্ষণ নিধন বন্দুক বিষ সবই বাড়ছে। দেখেশুনে আশঙ্কিত ফেসবুক নিজেই ব্যাখ্যা করেছে, হিউম্যান ব্রেন-এর মধ্যে যে একটা ‘ডিভিসিভ-নেস’ কিংবা বিভাজিত হয়ে যাওয়ার স্বতঃস্ফূর্ত প্রবণতা আছে, সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদ্ম বা লক্ষ্যভেদী চাল সম্ভবত আমাদের মাথার ঠিক সেই জায়গাটাতেই প্রথম ডাক পাঠায়: ‘‘ভাগ হয়ে যাও, ভাগ হয়ে যাও’’!
হৃদয় খুঁড়ে বেদনা বার করতে যদি আমরা এতই স্থিরপ্রতিজ্ঞ, তবে আর অন্যে আমায় বেদনা দিল কেন, সে কথা তুলে লাভ কী! আমরা যদি কাউকে ডাইনি, নেশাড়ু, শয়তান ভাবতে উদ্গ্রীব হয়ে থাকি, টিভির ‘অ্যাঙ্কর’ তাতে ইন্ধন দেবেনই, আর সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা অ্যাঙ্কর-মশাইয়ের সেই বিষবমন হাজার বার, লক্ষ বার ঘুরে ঘুরে দেখবই। মেয়েটি গণধর্ষিত হল বলে বাকি সমাজ এসে তাকে পুড়িয়ে দিলেও আমরা বলে যাব, ও তেমন কিছু নয়। সোশ্যাল মিডিয়া শিখিয়েছে নতুন সোশ্যাল দর্শন— ভুলেও কারও সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে ভেবো না!
সে দিক থেকে দেখতে গেলে, আমেরিকার ভোটেও এবার যে সব অভাবনীয়ের ক্বচিৎ কিরণের উদ্ভাস, তাকে কেবল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একার কারসাজি বললে ভুল হবে। তা ও দেশের মানুষেরই পরিচয়। তাঁরা নিজেরাই একটা দানবীয় গহ্বর তৈরি করেছেন, আর সমানে তার মধ্যে গিয়ে ঢুকছেন। ট্রাম্প তাঁদের দেখছেন, এবং আহ্লাদিত হয়ে সেই পাতালপ্রবেশ-প্রবণতার একশো শতাংশ সুযোগ নিচ্ছেন। এই কারণেই করোনা-আক্রান্ত প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে ফিরেই এক টানে মাস্ক খুলে ফেলেন যখন, মুখে বাঁকা হাসি ভাসে— করোনাভাইরাস যে একটা বুজরুকি মাত্র, ‘লিবারাল’ চক্রান্ত— আমেরিকান মনের সেই অন্ধকার গহ্বরটায় চাষ করে যে তাঁর ব্যক্তিগত লাভ কাঁড়ি কাঁড়ি। এটাও আসলে এক ‘অ্যালগরিদ্ম’, আমাদের মাথার ওই অন্ধকার জায়গাটা, যেটা আঁধারে তলানোর জন্য হাঁকপাঁক করতে করতে চব্বিশ ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়া পরিক্রমা করছে, সেই দিকে তাক করে বাণ মারা। দেশবিদেশের রাজনীতি এই কাজটাই করছে। প্রযুক্তির জন্যই আজ আমাদের এই হাল, তবে তার মধ্যে মানুষের মস্তিষ্কে বিষাক্ত হরমোন-ক্ষরণের প্রযুক্তিটিও বাদ নেই।
এক দিকে আমরা এই সব অঘটন ঘটানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করছি, অন্য দিকে ফেসবুক টুইটার ইউটিউব-রা আমাদেরই আচরণে আতঙ্কিত হয়ে একের পর এক রীতিনীতি পাল্টাচ্ছে, বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করছে, যাতে মানুষের কুকথা-কুকাজকে একটু সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু মানুষ যখন পেয়েছে রক্তের স্বাদ, তাকে আটকানো কোন প্রযুক্তির সাধ্যি! এই যেমন, করোনাভাইরাস যে ‘প্যানডেমিক’ নয়, ‘প্ল্যানডেমিক’, অর্থাৎ সযত্নে তৈরি করা মানুষ-নির্যাতনের ফাঁদ, এ নিয়ে মে মাসে ‘ভাইরাল’ হয়ে কাঁপিয়ে দিল বাইশ মিনিটের একটি ছবি। অগস্টে এল তার দ্বিতীয় পর্ব। ফেসবুক ইউটিউব টুইটার প্রথমেই আটকানোর ব্যবস্থা করল তাকে, নিষিদ্ধ করল সোজাসুজি, তবু ফাঁক পেরিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ তা দেখলেন— ছাড়লেন না!
সোশ্যাল ডিলেমা তথ্যচিত্রের নির্মাতা জেফ অরলোস্কি কয়েক দিন আগে একটা প্রবন্ধ লিখেছেন, ‘উই নিড টু রিথিঙ্ক সোশ্যাল মিডিয়া বিফোর ইট’স টু লেট’ নামে। একটা উদ্ধৃতি পড়ি সেখানে, নিল পোস্টম্যান-এর বই থেকে: ‘‘পিপল উইল কাম টু লাভ দেয়ার অপ্রেশন, টু আডোর দ্য টেকনোলজিস দ্যাট আনডু দেয়ার ক্যাপাসিটিজ় টু থিঙ্ক।’’ সত্যিই তো, ভাবতে-ভুলিয়ে-দেওয়া প্রযুক্তির প্রতি আমাদের দাসত্ব স্বীকার তো আসলে আমাদের অন্তরের সুগভীর প্রেম নিবেদন, কে বাঁধ দেবে তাতে। প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে: ঘৃণা, বিদ্বেষ ও অপরাধের প্রতি সেই পাগলপারা বাঁধনহারা প্রেম।