—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
আর জি কর হাসপাতালের যে বিপুল দুর্নীতি সামনে আসছে, তার উল্লেখ কখনও মেলেনি বিধানসভার স্বাস্থ্য বিষয়ক স্থায়ী কমিটির রিপোর্টে। এ কি কমিটির সদস্যদের কর্তব্যে গাফিলতি, না কি স্বেচ্ছা-নীরবতা? বিধানসভার স্থায়ী কমিটিগুলির ক্ষমতা অনেক। তার সদস্যরা যে কোনও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করতে পারেন, যে কোনও আধিকারিককে তলব করতে পারেন, নথিপত্র খতিয়ে দেখতে চাইতে পারেন। সে সবের ভিত্তিতে সরকারকে সতর্ক করা, বিভিন্ন সুপারিশ করা কমিটির কাজ। বিধানসভায় স্থায়ী কমিটির রিপোর্ট জমা পড়লে তার পর্যবেক্ষণ এবং সুপারিশগুলি জনসমক্ষে আসে। ফলে সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টিও সম্ভব। সরকারের কাজের উপর নজরদারি, এবং সরকারি দফতর ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিতে রাশ টানার এই উপায় গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যেই রয়েছে। যে-হেতু এই স্থায়ী কমিটিগুলিতে শাসক এবং বিরোধী, সব দলের সদস্যই থাকেন, তাই সেগুলির বক্তব্যের তাৎপর্য যথেষ্ট। বাম আমলের গোড়ার দিকে বিভিন্ন বিষয়ে স্থায়ী কমিটির রিপোর্টগুলিতে বিশদ তথ্য-পরিসংখ্যান উঠে আসত, কাজের গলদগুলিও সুবিস্তারে আলোচিত হত। আক্ষেপ, সেই রীতি দীর্ঘ দিনই উপেক্ষিত হচ্ছে। বর্তমানে বিধানসভার স্থায়ী কমিটিগুলির অধিকাংশেরই রিপোর্ট অতি সংক্ষিপ্ত, সারবত্তাও তেমন নেই। আর জি কর-কাণ্ডের পর দেখা গেল, সিবিআই তদন্ত শুরু করার কিছু দিনের মধ্যেই যথেষ্ট দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে গেল, তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে গ্রেফতার করল। পরীক্ষায় পাশ-ফেলের জন্য টাকার দাবি থেকে মর্গের মৃতদেহ পাচার পর্যন্ত যে দুর্নীতির বিস্তার, এত বছরের মধ্যে স্থায়ী কমিটির নজরে তা আসেনি কেন?
যাঁরা গণতন্ত্রের প্রহরী, জনস্বার্থের রক্ষক, তাঁদের কাছে এ প্রশ্নটি পেশ করা জরুরি। স্বাস্থ্য বিষয়ক স্থায়ী কমিটির পনেরো জন সদস্যের অধিকাংশই শাসক দলের— কমিটির প্রধান নির্মল মাজি, যিনি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে তৃণমূলের বাহুবলী নেতা বলেই পরিচিত। শাসককে বিব্রত করতে পারে, এমন কোনও তথ্য রিপোর্টে উল্লেখ করা হবে না, শাসক দলের নেতারা তা চাইতে পারেন। কিন্তু বিরোধী সদস্যরা তা মানবেন কেন? গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েকটি বড় মাপের কেলেঙ্কারি ঘটেছে। স্কুলে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ আদালতেও মিলেছে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার দুর্নীতি, একশো দিনের কাজের প্রকল্পেও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কয়লা পাচার, গরু পাচার, রেশন দুর্নীতি ইত্যাদিও আলোচনার কেন্দ্রে থেকেছে। বিধানসভায় মোট ছাব্বিশটি স্থায়ী কমিটি রয়েছে— এতগুলি অনিয়ম তার সদস্যদের নজর এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। অথচ, কেন্দ্রীয় সংস্থা তদন্তে না নামলে, বা আদালত তথ্য না চাইলে, রাজ্যবাসী অন্ধকারে থাকছেন। আর জি কর-কাণ্ডের ফলে যেমন ক্রমশ প্রকাশ্যে আসছে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিপুল অনিয়ম, বিপুলতর দুর্নীতির একের পর এক প্রমাণ। অনেক সরকারি মেডিক্যাল কলেজ, বা হাসপাতালে টেন্ডারে অনিয়ম থেকে সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ করার প্রবণতা, সবই দেখা যাচ্ছে।
এই দূষণ ছড়াতে পেরেছে জনপ্রতিনিধিদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য। বিধায়করা যদি সঙ্কীর্ণ স্বার্থে নিজেদের সাংবিধানিক কর্তব্য ভুলে যান, কেবল নিয়মরক্ষার্থে ওজনহীন রিপোর্ট পেশ করেন বিধানসভায়, তবে গণতন্ত্র একটা প্রহসন হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি, সরকার যদি বিভিন্ন কমিটি বা ব্যক্তির সতর্কবার্তাকে গুরুত্ব না দেয়, বিচ্যুতিগুলি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে, তা হলে রাজ্যকে বড় বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। আর জি করে দুর্নীতির নানা দিক নিয়ে নানা অভিযোগ প্রশাসন পেয়েছিল, কিন্তু সুরাহা করেনি। ছোট অপরাধ সংশোধন করায় এমন অনীহাই বড় অপরাধ ঘটবার পথ তৈরি করে দেয়।