—ফাইল চিত্র।
দেশের সব পথ এসে মিশে যাচ্ছে শেষে অযোধ্যায়— অন্তত তেমনই যখন দাবি, সেই সময়ে মণিপুর ও নাগাল্যান্ডে দেখা গেল, একটি অন্য যাত্রায় শরিক হয়েছে এক অন্য ভারত। ভারত সব সময়েই বহুত্বের দেশ, সেই বহুত্ব যে কী ভাবে জায়গা করে নিচ্ছে আজকের বাস্তবে— রাজনীতির ধারকবাহকদের অবজ্ঞা ও অবহেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে, কিংবা সংবাদমাধ্যমের তাচ্ছিল্য ও অনবধান সত্ত্বেও— এই যাত্রা সেই সত্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’-র এই পর্ব নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে, সমালোচনাও। কিন্তু রাহুল গান্ধীর এই যাত্রার জন্যই যে ওই ভিন্ন ভারত আজ কিছুটা হলেও জানান দিচ্ছে, স্বীকার না করে উপায় নেই। বিশেষত মণিপুর এক ভয়ানক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে গত বছর, এখনও সেখানে আগুন নির্বাপিত হয়নি, তার সামনে এক বিরোধী নেতা গিয়ে দাঁড়ালেন, সেখান থেকে যাত্রারম্ভ করলেন— যখন শাসকরা যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়ার যোগ্যই মনে করেননি এখানকার হিংসার সেই ফেনিল বাস্তবকে। আজও ইম্ফল থেকে পার্শ্ববর্তী জেলায় যাত্রাকারীরা প্রবেশ করে দেখছেন হিংসায় বিদ্বেষে ধ্বস্ত জনসমাজ ক্ষোভাগ্নিতে ধিকিধিকি জ্বলছে, আর সরকারের দিকে তাকিয়ে তীব্র দাবি তুলছে, শান্তি নেই, শান্তি নয়, শান্তি চাই না, চাই আলাদা প্রশাসন। এও এক ভারত, যে ভারত শাসকের দাবি অনুযায়ী ‘এক’ নয়, ‘অমৃত’পথের পথিক নয়, তার মন আলাদা, তার দাবি অন্য। হয়তো এই ভারতকে ভুলিয়ে রাখতেই দরকার হয় সর্বস্মৃতিহর ধর্মীয় উন্মাদনাকে। রাজনীতিকে জয়রথ হাঁকানোর জন্য ভর করতে হয় সেই উন্মাদনার উপর।
‘জয়রথ’-এর গুরুত্ব অপরিমেয়, কেননা সামনে জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু সেই একই কারণে কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলির সঙ্কটও এই মুহূর্তে বৃহৎ। বিজেপির ধর্ম-উন্মাদনার বিরুদ্ধে তারা কোথায় দাঁড়াবে, সেটা অত্যন্ত জটিল প্রশ্ন। প্রশ্ন যেমনই হোক, উত্তরটা জানা। এই ভারতে ধর্ম নিয়ে কথা না বলা কঠিন। কিন্তু ধর্ম নিয়ে কথা বলা আরও কঠিন, তাতে কেবল বিজেপির বি-টিম হওয়া যায়। এই সঙ্কটের সামনে এসে রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস যে ন্যায় যাত্রা-র সূত্রে নাগরিক মনে জাগাতে চাইছে কৃষকের সঙ্কট, জিএসটি-র জেরে রাজ্য কোষাগারের চাপ, কোভিড-পরবর্তী বেকারত্ব আর আয়হ্রাসের সমস্যা, সাঙাততন্ত্রের দুর্নীতি ও সম্পদ-অপসারণের মতো বিষয়সমূহ, তার গুরুত্ব অপরিসীম। এই সব সমস্যা চিরকালই ছিল, কিন্তু গত দশ বছরে তাদের প্রকোপ বেড়েছে বহু গুণ। এবং অনুমান করা যায়, আরও অনেক বাড়ানোর দিকেই এগোবে বিজেপি শাসন। তার সঙ্গে তীব্র রেখায় বেড়েছে বিদ্বেষ ও অসহনশীলতা। সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে মনে করিয়েছেন তফসিলি জনজাতিদের উপর হিংসা ২০১৪ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। সংখ্যালঘুদের কথা নতুন করে বলার দরকার আছে কি?
ন্যায় যাত্রা দিয়ে বুঝতে হবে, মানুষ কী চান: রাহুল গান্ধীর বক্তব্য। সমস্যা হল— বক্তব্যটি সারপূর্ণ, কিন্তু বড়ই বিলম্বিত। প্রথম পর্বের ভারত জোড়ো যাত্রার সঙ্গে দ্বিতীয়টির এতখানি সময়-ব্যবধান সম্পূর্ণ অহেতুক, অবিবেচনাপ্রসূত। প্রথম পর্বে যে সাফল্যের সাড়া পাওয়া গিয়েছিল, তা ইতিমধ্যেই ফিকে হয়ে মিলিয়ে যেতে বসেছে। মাঝখান থেকে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের ‘বিচক্ষণতা’য় তৈরি হয়েছে নতুন উন্মাদনা-উদ্রেককারী ‘ন্যারেটিভ’। সেই আখ্যানের বিপরীতে একটি বিকল্প আখ্যান তৈরি করতে হলে আর কয়েক মাস আগে তা শুরু করা উচিত ছিল না কি? আসল কথা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আর রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে একটা বড় তফাত আছে। দল হিসাবে কংগ্রেস এবং নেতা হিসাবে রাহুল গান্ধীরা এখনও বোঝেননি যে কেবল প্রথমটি নয়, দ্বিতীয় গুণটি অধিগত না করলে এই ভারতে টিকে থাকার সম্ভাবনা স্বল্প; কিংবা শূন্য।