ফাইল চিত্র।
অলঙ্কারশাস্ত্রে ব্যাজস্তুতি শব্দটির অর্থ কপট স্তুতি, অর্থাৎ প্রশস্তির ছলে নিন্দা। কাব্যসাহিত্যে তো বটেই, সামাজিক আলাপেও প্রশংসার মোড়কে সমালোচনা বা কটাক্ষ পরিবেশনের রীতি সুপ্রাচীন, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু অঞ্চলে কথায় কথায় মিছরির ছুরি চালানোর ঐতিহ্য সুপ্রসিদ্ধ, মতান্তরে কুখ্যাত। অতএব, এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন কলকাতা হাই কোর্টের নতুন ভবন হস্তান্তরের অনুষ্ঠানে সমাগত বিচারপতিদের সামনে দাঁড়িয়ে আদালতের নিষ্পক্ষতার জয়গান করে বলেন, “বিচার নিরপেক্ষ হয়, এক পক্ষ হয় না”, তখন শ্রোতার মনে এই কূটপ্রশ্ন জাগতেই পারে যে, তিনি কি সুকৌশলে মহামান্য বিচারকদের নিরপেক্ষতার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন? কিছু কাল যাবৎ শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগের মামলায় এবং অন্যান্য বিষয়েও রাজ্য প্রশাসনের প্রতি উচ্চ আদালতের সমালোচনা, তিরস্কার এবং নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হয়েছে, মন্ত্রী-সান্ত্রিরা লোকচক্ষে অপদস্থ হয়েছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই কি মুখ্যমন্ত্রীর মুখে সুবিচারের বন্দনা? তিনি কি বিচারবিভাগের সামনে একটি আয়না তুলে ধরে বলতে চেয়েছেন, বিচার যেন নিরপেক্ষ হয়?
এ-প্রশ্নের উত্তর দেবা ন জানন্তি। তবে ব্যাজস্তুতিই হোক আর সরল প্রশস্তিই হোক, মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি ঠিকই বলেছেন, গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের পক্ষে নিরপেক্ষ ও তৎপর বিচারবিভাগের গুরুত্ব অপরিসীম। বস্তুত, আজকের ভারতে সেই গুরুত্ব অনেকাংশে গণতন্ত্রের অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিচারবিভাগের নজরদারি ও সংশোধনী ছাড়া আইনের শাসন এবং সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা উত্তরোত্তর কঠিন থেকে কঠিনতর। আর সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন, গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যরক্ষায় বিচারবিভাগের দায়িত্ব যেমন বিপুল, প্রশাসনের কর্তব্যও কি তেমনই বিরাট নয়? সেই দায়িত্ব কি তাঁর প্রশাসন যথাযথ ভাবে পালন করছে? করলে কি পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির হাল আজ এমন করুণ হত? এক দিকে দুর্নীতি, অন্য দিকে অপদার্থতা— দুই ব্যাধির যে অজস্র লক্ষণ চতুর্দিকে প্রকট হয়ে উঠেছে, তা কি সুশাসনের পরিচয় বহন করে? মুখ্যমন্ত্রীর হাতে যদি আয়না থাকে, তবে সেটিকে নিজের সামনেও এক বার তুলে ধরতে পারেন। আত্মদর্শনই তো আত্মশুদ্ধির প্রথম শর্ত।
আত্মশুদ্ধির সদিচ্ছা না থাকলে অবশ্য আয়নাটি নিজের দিকে ঘোরানোর স্পৃহাও জাগে না। অন্য কেউ মুখের সামনে দর্পণ তুলে ধরলে সে-ও শত্রু বলে গণ্য হয়। মুখ্যমন্ত্রী যখন বিচারবিভাগ সম্পর্কিত মন্তব্যের পাশে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর নিন্দায় মুখর হন, তখন সন্দেহ হয়, তিনি কি অনুগত সংবাদমাধ্যম চাইছেন? ওই অনুষ্ঠানেই তিনি বলেছেন, সংবাদমাধ্যম তাঁর সমালোচনায় সত্য কথা বললে তিনি কিছু মনে করেন না, কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সরকারকে কাঠগড়ায় তুলে তাকে মিথ্যা অপবাদে দোষী সাব্যস্ত করা হবে কেন? মিথ্যা অপবাদ অবশ্যই আপত্তিকর। সংবাদমাধ্যমের একাংশ যে ক্ষেত্রবিশেষে সংযত, দায়িত্বপরায়ণ ভূমিকা পালনের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়, তাও অস্বীকার করা চলে না। কিন্তু সরকার বা শাসক দলের দুর্নীতি বা অন্য দোষত্রুটির অভিযোগ প্রকাশ করলেই তা ‘অপবাদ’ হবে কেন? ক্ষমতাবানের সমালোচনা করলেই সেটা ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ হবে কেন? মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, সংবাদমাধ্যম সরকারের ভাল কাজগুলোর কথা বলে না, কেবল ছিদ্রান্বেষণ করে। এই ক্ষোভে প্রশাসকের যে মানসিকতার সঙ্কেত মেলে, সেটি উদ্বেগজনক। সে কেবলই স্তুতি শুনতে চায়, সমালোচনা তার চক্ষুশূল। প্রশাসকের এই মনোভঙ্গি গণতন্ত্রের অনুকূল নয়। মুখ্যমন্ত্রী বিচারবিভাগ ও সংবাদমাধ্যমকে স্বধর্ম পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। একই আহ্বান তাঁর আপন প্রশাসনকেও জানানো আবশ্যক।