কলকাতা দ্বিতীয় স্থানে, দিল্লির পরেই। উন্নয়ন নয়, বায়ুদূষণের নিরিখে। বিশ্বের প্রায় সাড়ে ছ’হাজার শহরের উপর একটি আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালে ভারতের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলির মধ্যে দ্বিতীয় ছিল কলকাতা, গোটা বিশ্বে তার জায়গা ২০ নম্বরে। সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট, কলকাতার পিএম ২.৫-এর মাত্রা ২০২১ সালে ছিল ৫৯ মাইক্রোগ্রাম। আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধির হার প্রায় ২৬ শতাংশ। দিল্লির তুলনায় এই মাত্রা কম হলেও ভারতের অন্য মেট্রো শহরগুলির তুলনায় তা লক্ষণীয় ভাবে বেশি। এবং বৃদ্ধির হারে তা দিল্লি-সহ অন্য সমস্ত শহরকেই পিছনে ফেলেছে। বিষয়টি গভীর উদ্বেগের। বাতাসে থাকা অতি সূক্ষ্ম কণা পিএম ২.৫ ফুসফুসের গভীরে অনায়াসে প্রবেশ করে, এবং ক্যানসার-সহ নানাবিধ জটিল রোগের সৃষ্টি করতে পারে। বাতাসে এই কণার উপস্থিতি মানবশরীরের পক্ষে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকারক হিসাবে চিহ্নিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই কণার বার্ষিক সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করেছে ৫ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ, কলকাতার বাতাসে পিএম ২.৫-এর মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রার তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি।
এই পরিসংখ্যান স্তম্ভিত করে দেয়। প্রমাণিত যে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বায়ুদূষণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেলে বায়ুদূষণের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, দিল্লি, মুম্বইয়ের ন্যায় বৃহৎ শহরগুলিতে যে বায়ুদূষণ বেশি হবে, তাতে সংশয় নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিচারে কলকাতা দিল্লি-মুম্বই তো বটেই, ভারতের অন্য অনেক মেট্রো শহরের তুলনাতেও পিছিয়ে। অথচ, দূষণের নিরিখে সে পাল্লা দিচ্ছে দিল্লির সঙ্গে, পিছনে ফেলেছে মুম্বই, বেঙ্গালুরুর মতো শহরকে। পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন যে এই দূষণ বিষয়ে অবহিত নয়, তেমন বলা চলে না। দিল্লির দূষণ প্রসঙ্গ যখনই উঠেছে, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন কলকাতার দূষণ নিয়েও। ২০২০ সালে কলকাতায় সবচেয়ে দূষিত দিনের সংখ্যা ছিল ৭৪। গত বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৮৩। অথচ, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করা হয়নি। এবং দূষণ প্রতিরোধে যে ব্যবস্থাগুলির কথা প্রশাসনিক তরফে এত দিন জানানো হয়েছে, তাও যে ঠিকমতো কাজ করছে না, সমীক্ষার ফলেই তা স্পষ্ট। এটি জনস্বাস্থ্য নিয়ে চূড়ান্ত সরকারি উদাসীনতা এবং অপদার্থতার উদাহরণ, যা দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে।
এবং এই সমস্যা শুধুমাত্র কলকাতাতেই সীমাবদ্ধ নেই। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলকেও ক্রমশ বায়ুদূষণ গ্রাস করছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পগুলির উপর যথাযথ নজরদারির অভাবই এর একমাত্র কারণ। জেলাগুলিতে হামেশাই পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়ম ভাঙা হয়। বায়ুদূষণ প্রতিরোধে কলকাতা তবু যেটুকু গুরুত্ব পায়, জেলার দূষণের ক্ষেত্রে তার ছিটেফোঁটাও জোটে না। জনস্বাস্থ্যের উপরেও এর প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯ সালে বায়ুদূষণজনিত কারণে যত সংখ্যক মৃত্যু ঘটেছে, ভারতের মধ্যে তা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তবুও টনক নড়েনি। বায়ুদূষণে দেশের প্রথম সারিতে স্থান পাওয়ার কৃতিত্ব গৌরবের নয়। কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন যত দ্রুত তা উপলব্ধি করবে, তত মঙ্গল।