T N Ninan On Dr. Mammohan Singh

সমালোচনার সম্মুখীন হয়েও তাঁর স্মিত হাসিটি বজায় রাখতেন, মনমোহন প্রশ্রয় দেননি উচ্চাভিলাষকে

রাজনীতিকে সম্ভাবনার শিল্প হিসাবে দার্শনিক ভাবে বর্ণনা করলেও মনমোহন সম্ভাবনার পরিধিকে যে বাড়াতে পারেননি, সে কথা আমি এক বার তাঁর সঙ্গে এক বন্ধুত্বপূর্ণ এবং খোলামেলা আলোচনায় স্পষ্ট জানিয়েছিলাম।

Advertisement

টি এন নাইনান

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ২২:৩০
Share:

মনমোহন সিংহ। ছবি: পিটিআই।

মনমোহন সিংহের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮১-তে। দিল্লিতে ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ সংবাদপত্রের রিপোর্টার হিসাবে আমি আমার ব্যুরো প্রধানের সঙ্গে যোজনা কমিশনের সদস্য-সচিব মনমোহনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ব্যুরো প্রধান আর তিনি দীর্ঘ কালের বন্ধু। আমরা তাঁর সুসজ্জিত দফতরে ঢুকে সোফায় বসার পর আমার বস নজর করলেন, মনমোহনের ঝাঁ-চকচকে পালিশ করা জুতোর ভাঁজের জায়গাটিতে ফাটল ধরেছে। বন্ধুত্বের মেজাজেই আমার বস তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, একজোড়া নতুন জুতো কেন কিনছেন না তিনি। উত্তরে মনমোহন জানিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপুঞ্জে তাঁর বিগত কাজের সুবাদে তিনি যে টাকা পেয়েছিলেন, তা সঞ্চয় করেই তিনি একটি বাড়ি করেছেন। এখন আবার মেয়েদের বিয়ের জন্য সঞ্চয় করতে হচ্ছে। ফলে…

Advertisement

কিছু ক্ষণ পরেই আমাকে কমিশনের আর এক সদস্যের ঘরে যেতে হয়। তিনি আবার নামজাদা বিজ্ঞানী। তিনি আমাকে চা খাওয়াতে পারছেন না বলে ক্ষমা চাইলেন। কারণ হিসাবে নিজে থেকেই জানালেন, চিনির দাম বড় বেশি বেড়ে গিয়েছে।

সময়টাই ছিল এমন, যখন সরকারের সামনের সারির বাসিন্দারাও খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন, তাঁদের বেতনও ছিল সামান্য। বিশ্বে ভারতীয় অর্থনীতির পরিচয় ছিল ‘দরিদ্র’ হিসাবে এবং দেশের অভ্যন্তরে ঘাটতি এবং প্রায় সর্বত্রই ‘কন্ট্রোল’ ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। ১৯৯১-এ এমন এক ‘কন্ট্রোল’-এর নিগড় থেকেই মনমোহন অর্থনীতিকে মুক্ত করেন। উৎপাদকেরাই এখন থেকে ভোক্তাদের খুঁজে নেবেন, এমন বার্তা প্রকাশ্যে আসে। অবশ্য এমনটা হওয়া উচিত ছিল বহু আগেই।

Advertisement

তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে ১৯৯১-এর অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য মনমোহনকে যে কৃতিত্ব দেওয়া হয়, তা বাস্তব প্রাপ্যের তুলনায় খানিক বেশিই। তিনি নিজে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পুরো প্রয়াসটিই ছিল দলগত প্রচেষ্টার ফল এবং সবচেয়ে কম আলোচিত পিভি নরসিংহ রাও থেকে শুরু করে তাঁর প্রধান সচিব এএন বর্মা। এবং যশোবন্ত সিংহ-সহ শিল্পবাণিজ্য মন্ত্রকের সঙ্গে যুক্ত প্রায় প্রত্যেকেই তাঁদের ভূমিকা পালন করেছিলেন। উল্লেখ্য, চন্দ্রশেখরের প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে সরকারকে দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচাতে সক্রিয় হয়েছিলেন এবং নরসিংহ রাওয়ের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণের কাল পর্যন্ত তিনি সেই কাজ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৯১-এর বাজেট পেশ করার সময় মনমোহন এক যুগান্তের ঘোষণা করেছিলেন সাহিত্যিক ভিক্টর হুগোর বিশেষ একটি উক্তি দিয়ে, যার মর্মার্থ ছিল— যে ভাবনাস্রোত সমাগত, তাকে কেউ আটকাতে পারবে না। তাঁর সেই বক্তৃতা শেষ হয়েছিল এমন বক্তব্য দিয়ে যে, “গোটা বিশ্ব জেনে রাখুক, ভারত স্পষ্ট ও দৃঢ় ভাষায় জানাচ্ছে, সে আজ জেগে উঠেছে। আমরাই জয়ী হব, সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে জয় করব।”

তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে কিছু ঘটনার জন্য মনমোহন যে পরিমাণ সমালোচিত হয়েছিলেন, ততখানি আবার তাঁর প্রাপ্য ছিল না। তাঁকে খুব প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এক দুর্বল জোট সরকারের নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে। যেখানে সরকারের অংশীদারদের যাবতীয় দাবি তাঁকে মেটাতে হচ্ছে। সেই সরকার এমনই, যাকে তার জোট-সদস্যেরা ক্রমাগত পিছন দিকে টানছে, বিরূপ কমিউনিস্টদের সমর্থন প্রয়োজন পড়ছে যখন তখন এবং এমন একটি মন্ত্রিসভা, যার সদস্যেরা তাঁদের আনুগত্য জানাচ্ছেন সনিয়া গান্ধীর প্রতি এবং কখনওই প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নয়। সনিয়া গান্ধীও তাঁদের নিয়ন্ত্রণের রাশ অনেকাংশেই নিজের হাতে রাখছেন। ফলে সব মিলিয়ে যেন এক দ্বৈত শাসনের অবতারণা ঘটছে। মনমোহন তাঁর পদে বহাল থাকছেন ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে সব কিছুর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে নেই।

এ সব সত্ত্বেও যে নেতৃত্ব তাঁর তরফ থেকে পাওয়ার আশা করা হয়েছিল, তিনি তা দিতে ব্যর্থ হন। রাজনীতিকে সম্ভাবনার শিল্প হিসাবে দার্শনিক ভাবে বর্ণনা করলেও মনমোহন সম্ভাবনার পরিধিকে যে বাড়াতে পারেননি, সে কথা আমি এক বার তাঁর সঙ্গে এক বন্ধুত্বপূর্ণ এবং খোলামেলা আলোচনায় স্পষ্ট জানিয়েছিলাম। তিনি উত্তরে জানান, তাঁর কোনও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। এক জন প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে এমন কথা শোনা বিরল ব্যাপার। বরং সনিয়া গান্ধীকে তাঁর সরকারের বেশ কিছু বড়সড় পদক্ষেপের জন্য কৃতিত্ব দিতে তিনি দ্বিধা করেননি। যার মধ্যে, তথ্যের অধিকার, গ্রামীণ স্তরে কর্মনিযুক্তির নিশ্চয়তা প্রদান এবং খাদ্যের অধিকার অন্যতম। মনমোহনের যেন নিজস্ব ভাবনার ভাঁড়ারে টান পড়েছিল। কেবল কৃষকদের ঋণমুক্তির ব্যাপারটি ছাড়া আর তেমন কিছু দেখা যায়নি।

সব শেষে পড়ে থাকে তাঁর ব্যক্তিগত গুণাবলির কথা। তাঁর স্বচ্ছ, সৎ ভাবমূর্তি, জনগণের প্রতি সংবেদ, ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধ প্রায় প্রতিটিই বৈঠকেই লক্ষণীয় ছিল। কোনও কিছু বোঝার ব্যাপারে গভীর ক্ষমতা এবং জ্ঞানের পরিচয় তাঁর প্রায় প্রতিটি সাক্ষাৎকারেই পাওয়া যেত। খুব কঠিন সময়েও তাঁর মুখের স্মিত হাসিটি বজায় থাকত। এই সমস্ত কিছু তাঁর ব্যক্তিত্বকে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল, যেখানে সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কিয়ান ইউয়ের মতো বিরল ব্যক্তিরাই পৌঁছতে পেরেছেন।

তাঁর আর একটি প্রতিভা ছিল অল্প কথায় অনেক কিছু বলার দক্ষতা। ১৯৯৬-এ যখন আমি লিখেছিলাম যে নরসিংহ রাওয়ের সরকার তার নির্বাচনী ইস্তাহারে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে উল্লেখ করেনি, তিনি খানিক ক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন, “এ ছাড়া আর বলারই বা কী ছিল?”

রাজনীতির ভাষ্যকাররা মনমোহনের বিনয়ী স্বভাবের কথা বার বার বলেন। সন্দেহ নেই, তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর বিনয়ী স্বভাবটি নিয়ে চলতেন। কিন্তু আমি বিস্তর ভেবেচিন্তে দেখেছি, এই স্বভাব-বিনয় সত্ত্বেও তিনি তাঁর আশপাশের মানুষজনের থেকে খানিক বেশি উচ্চতাতেই অবস্থান করতেন। তার কারণও ছিল যথেষ্ট। সম্ভবত তিনি আত্মবিশ্লেষণের বিষয়টিকে সযত্নে গোপনই রাখতেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি অন্য মানুষের সদম্ভ আচরণের সুযোগটি নিতেন এবং নিজের স্বভাসিদ্ধ বিনয়-বচন দ্বারা তাঁদের নিরস্ত্র করে ফেলতেন। এমন ঘটনা আমি একাধিক বার দেখেছি। দিল্লির তাজ প্যালেস হোটেলে ভারত সফররত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে এক মধ্যাহ্নভোজের সময় তিনি বলেছিলেন, গোটা ভারত তাঁকে ভালবাসে, সেখানেও এই বিনয়ের ঘাটতি ছিল না।

আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ)-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিশেল ক্যামডেসাসের সঙ্গেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল। ক্যামসেডাস ১৯৯১ সালে এক ঋণ মঞ্জুর করে কার্যত ভারতকে বাঁচান। পরে যখন তিনি ভারত সফরে আসেন, দিল্লিতে এক নৈশভোজে মনমোহন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিনয় বজায় রেখে তাঁকে ‘স্যর’ বলে সম্বোধন করেন (আমার স্মৃতি অন্তত তা-ই বলছে)। সম্ভবত সেটি ছিল ভারতীয়দের একান্ত মুদ্রাদোষ। কিন্তু সেখানে উপস্থিত অবস্থায় আমার মনে হয়েছিল দেশের অর্থমন্ত্রীর পক্ষে আইএমএফের অধিকর্তার প্রতি এই বিনয়টুকু না দেখালেও চলত। যখনই মনমোহন সমালোচনার সম্মুখীন হতেন, তিনি তাকে ব্যক্তিগত স্তরে নিয়ে যেতেন না। কোনও সাক্ষাৎকারেই তার উল্লেখ থাকত না। এক গ্রন্থপ্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, তাঁর সরকারের ব্যর্থতা সংক্রান্ত সমালোচনার বিষয়ে তিনি ওয়াকিবহাল। কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও বলেছিলেন যে, তাঁর সরকার যা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে, সেই কৃতিত্বটুকু তাঁকে দেওয়া হোক। অবশ্যই তা এক ন্যায্য দাবি।

মনমোহনের কেমব্রিজের বন্ধু অশোক ভি দেশাই এক সমালোচনার কথা বলেছেন। ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ সংবাদপত্রের কড়া ধাঁচের কলাম লেখক অশোক ১৯৯৫-এ লিখেছিলেন, মনমোহন নিজে সৎ হলেও তাঁর আশপাশে থাকা দুর্নীতিগ্রস্তদের সহ্য করে চলেন। প্রতিবাদ জানানোর জন্য মনমোহন আমাকে ডেকে পাঠান এবং জানতে চান, এমন সমালোচনার জবাব তিনি কী ভাবে দিতে পারেন? আমি তাঁকে জানাই, লেখক তাঁর বন্ধু এবং আমি দেশাইকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে পারি। বহু বছর পরে দেশাই আমাকে জানান, মনমোহন শেষ পর্যন্ত তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশাইকে তাঁর বক্তব্যের পিছনে কারণ দর্শাতে হয়েছিল। সব মিলিয়ে মানুষটিকে ঘিরে এক মুক্ত বাতাস সর্বদাই বয়ে যেত।

বিজ্ঞান ভবনে আয়োজিত মনমোহনের সম্মানে প্রকাশিত ইশার জাজ অহলুওয়ালিয়া এবং ইয়ান লিটলের যৌথ সম্পাদনায় প্রবন্ধ সংগ্রহের প্রকাশ অনুষ্ঠানে এই খোলা হাওয়ার স্বাদ আমরা পেয়েছিলাম। উল্লেখ্য, ইয়ান অক্সফোর্ডে মনমোহনের শিক্ষক ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে আমি রসিকতার সুরে খানিক সমালোচনাও করেছিলাম। কিন্তু, সেই সময়ে শিকাগোয় অধ্যাপনারত রঘুরাম রাজন (প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন উপদেষ্টা) বেশ কড়া ধাঁচের সমালোচনাই করেছিলেন। আমার জানা নেই, কোনও প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত এমন এক নৈশভোজের আসরে এই ভাবে খোলামেলা সমালোচনা আদৌ করা যায় কি না। সেই সময়টাই ছিল যেন খোলা হাওয়ার!

সাংবাদিক হিসাবে আমার সৌভাগ্য যে, মনমোহন সিংহের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে প্রায় ৩৫ বছর আমি আলাপ-আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রায় প্রতিটি স্মৃতিই উজ্জ্বল আমার কাছে। তাঁর জ্ঞান ও সচেতনতার স্বাদ পেয়েছি প্রতি সাক্ষাতেই। সমস্ত সমালোচনা সত্ত্বেও আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, তিনি প্রকৃত অর্থেই দেশের সুসন্তান। তাঁর প্রয়াণ অন্য জনপ্রিতিনিধিদের তুলনায় একটু বেশিই ব্যক্তিগত শোকের বিষয় হয়ে রইল আমার কাছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement