বাঙালি বহুকাল ধরিয়া ছাত্রাবস্থা হইতে কারণে এবং অকারণে, প্রসঙ্গে ও অপ্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এত বেশি ঠিক এবং ভুল উদ্ধৃতি দিয়া আসিতেছে যে, তিনি এই বহুব্যবহারে এবং অপব্যবহারে বিলক্ষণ অভ্যস্ত। কিন্তু গত রবিবার নরেন্দ্র মোদী যখন বেতারবাহিত ‘মন কি বাত’-এ গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ টেগোরের বচন স্মরণ করিয়া শিশুদের খেলনা বিষয়ে প্রজ্ঞা বিতরণ করেন, তখন রবীন্দ্রনাথও হয়তো কৌতূহলভরে কান পাতিয়াছিলেন। মোদীজির বচন শুনিয়া তাঁহার ওষ্ঠাধর ঈষৎ কম্পিত হইয়াছিল কি না, সেই গোপন কথাটি শ্মশ্রুগহনেই হারাইয়া গিয়াছে। তবে মানিতেই হইবে, তাঁহার ‘দ্য রিলিজন অব ম্যান’ শীর্ষক বক্তৃতা-প্রবন্ধে নিহিত খেলনা বিষয়ক উক্তিটিকে শ্রীযুক্ত মোদী যে ভাবে আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজে লাগাইয়াছেন, তাহা সত্যই অভিনব। কোভিড-বন্দি শিশুদের দুঃখে কাতর হইয়া তাহাদের জন্য কী করা যায়, সেই বিষয়ে সপারিষদ চিন্তন করিতে করিতে তিনি ভাবিয়াছেন, বিদেশি খেলনায় না ভুলিয়া দেশের নানা অঞ্চলের রকমারি খেলনা দিয়া শিশুদের আমোদ দিতে পারিলে বেশ হয়। সেই সূত্রে ভারত গোটা পৃথিবীর ‘খেলনা নির্মাণের কেন্দ্র’ হইয়া উঠিতে পারে, তাহাতে আত্মনির্ভর অর্থনীতি গড়িবার কাজটিও অগ্রসর হইতে পারে। চিনা খেলনার দাপট কমাইয়া বেয়াড়া প্রতিবেশীকে উচিত শিক্ষাও দেওয়া যায়— এমন কথা তিনি মুখ ফুটিয়া বলেন নাই বটে, কিন্তু মনের সব কথা মুখ ফুটিয়া বলিতে হইবে, গুরুদেব তো সেই আদেশ দিয়া যান নাই।
নরেন্দ্র মোদী যে-সে লোক নহেন, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। কেবল ভক্তবৃন্দ নহে, দেশের বহু মানুষই তাঁহার বিবিধ বাণী শুনিয়া চমৎকৃত হইয়া থাকেন। তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই, সম্ভবত অধিকাংশই, প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্যটি গলাধঃকরণ করিয়া মনে করিবেন যে, রবীন্দ্রনাথ বিদেশি খেলনা ফেলিয়া শিশুর হাতে স্বদেশি খেলনা তুলিয়া দিবার উদ্দেশ্যেই সওয়াল করিয়াছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় কেহ বা এমন তত্ত্বও আবিষ্কার করিতে পারেন যে, এই প্রসঙ্গেই তিনি গান বাঁধিয়াছিলেন: কোন খেলা যে খেলব কখন, ভাবি বসে সেই কথাটাই। হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির স্বর্ণযুগে এমন সব আশঙ্কাকে হাসির কথা বলিয়া উড়াইয়া দেয়, কাহার সাধ্য! সেই কারণেই মনে রাখা দরকার, ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডে প্রদত্ত হিবার্ট লেকচার-এ রবীন্দ্রনাথ বিদেশি খেলনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করিয়াছিলেন আপন শৈশবের একটি ঘটনার সূত্রে। সেই খেলনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিরাগ এই কারণে নহে যে তাহা বিদেশি, তাঁহার আপত্তির কারণ ইহাই যে, সেই খেলনার রূপে ‘শৈশবের স্বর্গরাজ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের বাজারি দুনিয়ার লোভ’ প্রবেশ করে। শিশুর আনন্দকে বাজারের সামগ্রী করিয়া তুলিবার মর্মস্পর্শী সমালোচনাকে ‘টয় হাব’ বানাইবার যুক্তি হিসাবে ব্যবহার করিবার এই বিচিত্র উদ্যোগ কি রবীন্দ্রনাথের চিন্তা বিষয়ে কিছুই না জানিবার প্রমাণ, না কি ইহা জানিয়া-শুনিয়াই তাঁহার কথা অপব্যবহার করিবার প্রকল্প?
লক্ষণীয়, রবীন্দ্রনাথ শিশুর খেলিবার আনন্দকে দেখিয়াছিলেন সমবেত উপভোগের উদ্যাপন হিসাবে। তাঁহার উক্তি: ‘‘আমার আনন্দে আমার খেলার সঙ্গীদের ষোলো আনা ভাগ ছিল, বস্তুত, তাহারা আমার সহিত খেলায় যোগ দিলে তবেই আমার পরিতৃপ্তি সম্পূর্ণ হইতে পারিত।’’ এই সমবায়ী আনন্দ ও পরিতৃপ্তির ধারণা রবীন্দ্রনাথের নৈতিক অবস্থানের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাঁহার সারা জীবনের অগণিত লেখায় ও কথায় তাহা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত হইয়াছে। সকলকে লইয়া বাঁচিবার মধ্যেই যে প্রকৃত সভ্যতার ধর্ম নিহিত, এই মৌলিক ধারণা হইতে তিনি কখনও এক বিন্দুও ভ্রষ্ট হন নাই। সেই ধর্মের প্রেরণাতেই বিশ্বভারতীর রূপকার বলিয়াছিলেন যে, সকলে মিলিয়া খেলিবার মধ্য দিয়াই অসম্পূর্ণ খেলনা সম্পূর্ণ হইয়া উঠিত, বাজার হইতে কিনিয়া আনা সম্পূর্ণ খেলনায় সেই ‘হইয়া উঠিবার’ অবকাশ নাই, সেখানেই তাহার দৈন্য। তাঁহার ভাষণের সূত্র ধরিয়া নরেন্দ্র মোদীও ‘অসম্পূর্ণ খেলনা’র সৌন্দর্য ও মহিমা কীর্তন করিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার দর্শনের মূল সুরটিই মোদীজির অধরা থাকিয়া গিয়াছে। ইহাতে আশ্চর্য হইবার কোনও কারণ নাই। রবীন্দ্রনাথ যে আদর্শ বা নৈতিকতার কথা বলেন, নরেন্দ্র মোদীদের চিন্তা তাহা হইতে কেবল দূরবর্তী নহে, সেই দূরত্ব সম্পূর্ণত অসেতুসম্ভব। তাঁহাদের পাটোয়ারি বুদ্ধিতে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহারযোগ্য উপকরণ হইতে পারেন, তিনি সে-বুদ্ধির অগম্য।
যৎকিঞ্চিৎ
আমেরিকা নামে দেশটার সময় ভাল নয়। লরা হ্যারিকেনে লন্ডভন্ড পূর্ব উপকূল। পশ্চিম উপকূল দাবানলে ছারখার। পুব থেকে পশ্চিম, দেশের শরীর জ্বলছে কৃষ্ণাঙ্গ ক্ষোভের বারুদে। আর পুরো দেশ জুড়ে মরণজাল পেতে গপাগপ মানুষ খাচ্ছে করোনা নামের মহাকাল। প্রেসিডেন্ট মশাই কোনওটাতেই পাত্তা দিচ্ছেন না, সব বিরোধীদের কারসাজি! বরং নিজে আয়েশ করে বসে গণতন্ত্র কুটিকুটি করে কাটাছেঁড়া করছেন। নির্বাচন তো নভেম্বরে। কিন্তু অ্যাপোক্যালিপ্স কি এসেই গেল?