লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের রাজনৈতিক অপপ্রয়োগ বিষয়ে প্রশ্নকর্তাদের তীব্র ভাষায় সমালোচনা করা হয়েছে সম্পাদকীয় ‘ঊন-নাগরিক?’-এ (২৩-৮)। তাঁদের ‘সম্মান’ ‘শিষ্টতা’ ‘সমতা’র বোধ নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। এই বক্তব্যের প্রতি সম্মান জানিয়েও, এর বিরুদ্ধে কিছু বক্তব্য রাখতে চাই। প্রথমেই বলি, সরকারি অনুদানের অর্থ জনগণের কর-শুল্ক থেকে নেওয়া। ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রীর নয়। অথচ, এই অনুদান দেওয়ার সময় সরকারি মঞ্চ থেকে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করা হয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সব দিচ্ছেন। তিনিই ‘অনুপ্রেরণা’। অনুগামীরাও শাসায়, যারা তাঁর দলকে ভোট দেয়নি, তাদের লক্ষ্মীর ভান্ডার বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ সব সংবাদপত্রে, টেলিভিশনের খবরে দেখা যাচ্ছে। নীরব থেকে একে কার্যত সমর্থন করছেন মুখ্যমন্ত্রী। সরকার বা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলই তো ভোটের সঙ্গে লক্ষ্মীর ভান্ডারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক মেনে নিচ্ছে।
সম্পাদক প্রশ্ন তুলেছেন প্রশ্নকর্তাদের শ্রেণি ও লিঙ্গচরিত্র নিয়ে। লক্ষণীয়, আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে এখন শুধু লক্ষ্মীর ভান্ডার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে না। প্রশ্ন উঠছে পুজো-অনুদান এবং অন্যান্য সরকারি প্রকল্পের অনুদান নিয়ে। প্রশ্ন উঠছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সরকারি পরিষেবা কাঠামো নিয়ে, যা ভেঙে পড়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর সামাজিক সুরক্ষার বিষয়ে অবহেলা, সরকারি কর্মীদের বঞ্চনা, সরকারি চাকরিতে অপ্রশিক্ষিত, অদক্ষ কর্মীদের নানা ভাবে কাজে লাগিয়ে কার্যত এক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টির বিষয়েও প্রশ্ন উঠছে। শ্রমের বিনিময়ে মজুরি, পারিশ্রমিকের উপযুক্ত ন্যায়, নীতির অভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক চাহিদা না পূরণ করে সামান্য অনুদান দিলে আর যা-ই হোক, অর্থনীতির উন্নতি হয় না। সম্পাদকের সঙ্গে আমি একমত যে এ দেশে নারীশ্রম উপযুক্ত মর্যাদা, পারিশ্রমিক, পায় না। এই অপ্রাপ্তি, উপেক্ষা দেশের সর্বজনীন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মস্ত বাধা। সে জন্য ভারতে একশো দিনের কাজে নারীর অগ্রাধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে যৎসামান্য কিছু আর্থিক অনুদান নারীর অধিকারের বিকল্প না হলেও মেয়েদের কিছু আত্মসম্মান দেওয়া হয়েছে কয়েকটি রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ্মীর ভান্ডার উচ্চ প্রশংসিত ও গৃহীত হয়েছে। তবে শাসক রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রী যখন সরকারি অনুষ্ঠান থেকে ভোট পাওয়ার জন্য দাবি করেন যে, এই অনুদান অমুক দিচ্ছেন, তখন তা নাগরিক অধিকারের সাংবিধানিক সম্মান হারায়। অমুক গ্রাম, পরিবার ভোট দেয়নি, অতএব অনুদান বন্ধ— এমন কথাও শোনা যায়। এই জন্যই ‘ভিক্ষা’ শব্দটি চালু হয়েছে।
শুভ্রাংশু কুমার রায়
চন্দননগর, হুগলি
বিষের বাষ্প
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছিলেন প্রাক্তন ডেপুটি সুপার আখতার আলি। মেডিক্যাল বর্জ্য বেআইনি ভাবে বিক্রি থেকে শুরু করে ফুড স্টল, পার্কিং থেকে টাকা তোলা, সরকারি টাকা নয়ছয়, অনৈতিক ভাবে শিক্ষার্থীদের ফেল করিয়ে দেওয়া, শিক্ষাঙ্গনে যৌনকর্মীর প্রবেশ— এমন নানা অভিযোগ তিনি রাজ্য পুলিশের অ্যান্টি করাপশন ব্যুরো, টালা থানা, স্বাস্থ্য ভবন, মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে জানান। যা গত বছর এক বাংলা সংবাদ চ্যানেলে প্রচারিতও হয়। তার পর চেনা ছক। লোক-দেখানো কমিটি গঠন, অভিযোগকারীর বদলি, কমিটির বিচারে বিষয়টি খারিজ করে দেওয়া, এ সবই ঘটে যায়। কয়েক মাসের মধ্যে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠল। এই ভাবে দাগিয়ে দিলেই অভিযোগকে লঘু করা যায়। কিন্তু মূল কথা হল, এই লড়াইটা দুর্নীতির সঙ্গে নীতির, অসাধুর সঙ্গে সাধুর।
শুধুমাত্র কারও প্রাণ গেলে তবেই কি আমরা জেগে উঠব? যারা ধীরে ধীরে বিষ-বাষ্পে সমাজকে বিষিয়ে তুলছে, তাদের কী হবে? প্রশাসনের উপর আস্থা বহু আগেই হারিয়েছে মানুষ। বিচারব্যবস্থার উপর যেটুকু ভরসা আছে, তা যেন সমস্ত ক্ষেত্রে বজায় থাকে, এই আশাই রাখি। দিকে দিকে বিক্ষোভে সবাই কিন্তু শাসক-বিরোধী নন, মূলত তাঁরা দুর্নীতি-বিরোধী, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার বিরোধী। যিনি যে দলেই থাকুন, আমরা কোন দিকে এগোচ্ছি একটু ভাববেন। দলের ভুলটাকে প্রশমিত করতে চাইবেন না।
সাধারণ মানুষের প্রতিও অনুরোধ, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাকে তুচ্ছ মনে করে “যে-ই যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ”-এর মতো হতাশাজনক বাক্যবন্ধ বলবেন না। সব সময় মনে রাখবেন, রাম লঙ্কা জয়ের পর কিন্তু রাবণ হয়ে যাননি। আমাদের সাধারণ মানুষের মধ্যে সব রকমের শক্তি আর সম্ভাবনা রয়েছে। নিহত তরুণী চিকিৎসকের মতোই, যে যার নিজের মতো করে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এক দিন এই কালো মেঘ কাটবেই।
অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায়
সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
স্নেহলতা
আজ থেকে ১১০ বছর আগে, ৩০ জানুয়ারি, ১৯১৪ সালে চোদ্দো বছরের মেয়ে স্নেহলতা আত্মহত্যা করে। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে যে আলোড়ন উঠেছিল, তার নজির একমাত্র আজকের নির্যাতিতার প্রতি সহমর্মিতার মতোই। স্নেহলতার যেখানে বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল, সেখানে পাত্রপক্ষের দাবি ছিল ৮০০ টাকা নগদ ও ১২০০ টাকার অলঙ্কার। এই টাকা জোগাড় করা তার বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাড়ি বন্ধক রেখে তিনি টাকা জোগাড়ের উদ্যোগ করলে স্নেহলতা আত্মহননের পথে বাবাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে সে তার বাড়ির লোকদের পথে বসা থেকে মুক্তি দেয়, সঙ্গে নিজেকেও নয় কি?
পণ বা যৌতুকের পীড়ন তখনকার বাংলায় কতটা অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছেছিল, স্নেহলতার মৃত্যু ছিল তার জ্বলন্ত প্রমাণ। স্নেহলতার মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল বাঙালি মধ্যবিত্তকে। পণপ্রথার বিরুদ্ধে পথে নেমেছিল নাগরিক সমাজ। কলকাতায় অন্তত দশ-বারোটি সভা হয়েছিল। সেই সব সভায় ছিলেন স্যর গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বিচারপতি সারদাচরণ মিত্র, লালমোহন বিদ্যারত্নের মতো মানুষেরা। বঙ্গীয় ব্রাহ্মণসভা ও কায়স্থসভার মতো সংগঠনও সরব হতে বাধ্য হয়। অধিকাংশ সভাতেই যুবকরা অগ্নিসাক্ষী করে শপথ নিয়েছিলেন, তাঁরা বিবাহে পণ নেবেন না, পিতামাতা পণ নিতে চাইলে তাঁরা বিরোধিতা করবেন। ২১ ফেব্রুয়ারি কলেজ স্কোয়্যারে বিশাল এক সভার আহ্বান করে বলা হয় বিবাহ-পণের মতো সামাজিক কলঙ্ক মোচনের উদ্দেশ্যেই এই সভা।
কেবল কলকাতা নয়, বাংলার অন্যান্য প্রান্তের মানুষও প্রতিবাদ আন্দোলনে শামিল হন। গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যে এই আন্দোলনের ঢেউ পৌঁছেছিল, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের চলমান জীবন বইয়ে তার উল্লেখ আছে। স্নেহলতার মৃত্যুর বছরেই রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘হৈমন্তী’ ও ‘অপরিচিতা’র মতো গল্প। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লেখেন ‘মৃত্যু স্বয়ম্বর’ নামক কবিতা। ভারতী পত্রিকায় নিস্তারিণী দেবী লেখেন— মায়েরা যদি প্রতিজ্ঞা করেন মেয়েকে চিরকুমারী রাখব, কিন্তু পণ দেব না, তা হলেই স্নেহলতার আত্মহত্যা সার্থক হবে।
অন্য দিকে, গোবিন্দচন্দ্র দাস তাঁর ‘থাকুক আমার বিয়া’ কবিতায় লেখেন, দরকার হলে সারা জীবন কুমারী থেকে মেয়ে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গল বা মেরি কার্পেন্টার-এর আদর্শে জীবন কাটাবে, বিয়ের নামে ‘অমন পশু কিনবো নাকো কাণা কড়ি দিয়া’। বামাবোধিনী পত্রিকা বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করে। প্রবাসী পত্রিকা পণপ্রথাকে জাতীয় কলঙ্ক বলে চিহ্নিত করে। তবে তখন আজকের মতো দলতন্ত্র ছিল না। সমাজের কুৎসিত প্রথার বিরুদ্ধে সেই সময় মানুষ পথে নেমেছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে।
প্রলয় চক্রবর্তী
বারাসত, উত্তর ২৪ পরগনা