‘শরীরে লবণের ক্ষত’ (৭-৯) শীর্ষক প্রবন্ধ পড়ে শিউরে উঠলাম। কী ভয়ানক অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন সুন্দরবন এলাকার মহিলারা! এ তো জটিল অসুখের সঙ্গে স্থায়ী বসত। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এক দিকে যেমন মেয়েদের শরীরে চুপিসারে বাসা বাঁধছে মারণ অসুখ, তেমনই তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটিও অবহেলার নয়। প্রত্যক্ষ ছাপ পড়ছে মেয়েদের সামাজিক জীবনেও। এ সব অঞ্চলে বর্ষাকালে জলের লবণাক্ত ভাব কম থাকলেও, গ্রীষ্মকালে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। মিষ্টি জলের উৎস সময়ের সঙ্গে লোপ পাওয়ায় ওই নোনাজলেই সারতে হয় যাবতীয় দৈনন্দিন কাজ। প্রজননতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটিত অসুখ ছাড়াও অধিকাংশ বাসিন্দা ভুগছেন আমাশয়, দুর্বলতা ও কৃমির সমস্যায়। হজমের সমস্যা, অ্যাসিডিটি আর চর্মরোগের সমস্যা তো নিত্য দিনের সঙ্গী।
বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি সম্প্রতি এক গবেষণায় জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলে লবণাক্ততা মারাত্মক হারে বেড়ে যাওয়ায় মেয়েদের ঋতুচক্র প্রক্রিয়ায় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি নোনাজলের কারণে শিশুকন্যাদের শ্বেতস্রাব বা লিউকোরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। চিকিৎসকদের মতে, শিশু বয়স থেকে দীর্ঘ দিন ধরে লিউকোরিয়ার কারণে মূত্রনালির সংক্রমণ, শ্রোণি (পেলভিস) প্রদাহজনিত সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব, এমনকি জরায়ুর ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে, যা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ। সরকারি তত্ত্বাবধানে সমীক্ষা চালিয়ে, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসক দল পাঠিয়ে নিয়মিত স্বাস্থ্যশিবির খুলে, হাইজিন ও স্যানিটেশনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করে জরুরি ভিত্তিতে সকলের এগিয়ে আসা উচিত। স্বাস্থ্য নিয়ে কর্মরত ‘এনজিও’গুলিকেও এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞে শামিল করা
যেতে পারে।
মৃণাল কান্তি ভট্টাচার্য, কেতুগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান
ত্রাণ নয়, উন্নয়ন
‘শরীরে লবণের ক্ষত’ প্রবন্ধে স্বাতী ভট্টাচার্য সুন্দরবন ও তার এলাকা-সংলগ্ন মেয়েদের দুরবস্থা তুলে ধরেছেন। প্রশ্ন জাগে, ভোটের রাজনীতিতে প্রান্তিক মানুষের জীবন কতটুকু কাজে লেগেছে? তাঁদের সামান্য সাহায্য আসলে সমাজে বাহবা কুড়োনোর উপাদান ছাড়া আর কিছুই নয়। সাগরের মীন, সামান্য চাষের জমি আর জঙ্গলের উপর নির্ভর করে বেঁচে-থাকা এই মানুষগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে কেউ মাথা ঘামান না।
সুন্দরবনের মানুষদের সাহায্য করার যে আদিখ্যেতা দেখানো হয়, তার অনেকটাই প্রচার-প্রসারের লোভে। আমি নিজেও এক জন সমাজসেবী, ইয়াস ঝড়ের পরে সাহায্যের ডালা নিয়ে গিয়েছিলাম সুন্দরবনের মৌসুনি দ্বীপে। সেখানে আমাদের ত্রাণসামগ্রী এক প্রকার কেড়ে নিয়ে পঞ্চায়েতের লোকেরা নিজেদের পছন্দমতো লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। ফলে, যাঁদের সত্যিই প্রয়োজন, তাঁরা তা পাচ্ছেন না।
ইয়াস বা আমপান এই সব মানুষের মননে ও জীবনে যে ক্ষতের সঞ্চার করেছে, তা সামান্য চাল-ডাল-মুড়িতে ঠিক হওয়ার নয়। মেয়েদের শারীরিক অযত্ন ও কষ্টগুলো উপেক্ষিত থেকে যায়। সমাজের ধারক ও বাহক হলেন মেয়েরা, অথচ জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ মেয়েরা নিজের শরীরের দিকে তাকানোর সামান্য অবসরটুকু পান না। লবণের নিঃশব্দ আক্রমণে তাঁদের দেহ নানান অসুখের আঁতুড়ঘর হয়ে যায়। প্রকৃত অর্থে উন্নয়ন করতে চাইলে মেয়েদের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে হবে। খয়রাতি দিয়ে উন্নয়ন হয় না, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে সে উদ্দেশ্যে কাজ করতে হবে।
মো সাব্বির সেখ, রঘুনাথগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ
তিলে তিলে মৃত্যু
‘শরীরে লবণের ক্ষত’ লেখাটি মনকে নাড়া দেয়। উপকূলের মেয়েরা রক্তক্ষরণে বিপন্ন হয়েও জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত। জোঁকের গায়ে যেমন নুন দিয়ে মারা হয়, তেমনই এই মেয়েরা তিলে তিলে লবণক্ষতে মৃত্যু বরণ করছেন। সরকার কি এই বিষয়ে অবহিত নয়? সুন্দরবনের অন্দরে এই অসুন্দর কি মনকে নাড়া দেয় না? উপকূল-কন্যাদের পাশে দাঁড়িয়ে কারা রুখবে তাঁদের যন্ত্রণা?
পল্টু ভট্টাচার্য, রামরাজাতলা, হাওড়া
টনক নড়বে?
স্বাতী ভট্টাচার্য উপকূলবর্তী সুন্দরবনের নোনা জলমাটিতে সেখানকার অধিবাসীদের, বিশেষত মেয়েদের কষ্টের হৃদয়বিদারক কাহিনি তুলে ধরেছেন। আমরা মাঝেমধ্যে সুন্দরবন যাই, শুনি তাঁদের জীবন যুদ্ধের কথা— কাঁকড়া ধরতে গিয়ে কী ভাবে বাঘের খপ্পরে পড়েছিলেন, উল্টো দিকের বনি ক্যাম্প, কলস দ্বীপ থেকে সাঁতরে বাঘ তিন দিন জি প্লট গোবর্ধনপুরে ঘোরাফেরা করেছিল, বন্যার জল হুহু করে ঢুকে পড়াতে মানুষজন মনসা দ্বীপে রামকৃষ্ণ মিশনের পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে দুপুরে গরম খিচুড়ি খেয়েছিলেন। এ বারের ইয়াস ঝড়ে দু’জন মাস্টারমশাইয়ের কথায়, কুমিরমারিতে গ্রামের বহু মানুষ নিজেরা পর পর দাঁড়িয়ে মানবপ্রাচীর তৈরি করে নোনাজল থেকে চাষের জমি বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। আমরা স্বচক্ষে দেখেছি মেয়েরা বকখালি, কৈখালি, সাগরদ্বীপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোমরজলে দাঁড়িয়ে মীন ধরছেন। লেখক জেনেছেন, প্রায় হাজার পঞ্চাশেক মেয়ে সারা বছর পাঁচ-ছ’ঘণ্টা নদীতে কাটানোর ফলে প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণে ভোগেন। এঁদের ভুল বুঝিয়ে অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত নার্সিংহোম গর্ভাশয় বাদ দিচ্ছে, সে খবর সরকারের কাছে নেই। এই বিবরণের পরে আশা করা যায়, সরকারের টনক নড়বে। সুন্দরবনের মানুষের বিপন্নতার সমাধানে এলাকার মানুষদের বিকল্প কর্মসংস্থান, ঘরে ঘরে মিষ্টি জলের টিউবওয়েল বসানো, সংগঠিত সরকারি ডাক্তারদের টিম ওখানে গিয়ে নিয়মিত মেয়েদের মেডিক্যাল ক্যাম্পে চেক আপ করা, ইত্যাদি দাবি মানা হবে। মুখরোচক খবর পরিবেশন না করে, সব সংবাদমাধ্যমকে সুন্দরবনের মানুষের অসহায়তার ছবি তুলে ধরতে হবে।
শিখা সেনগুপ্ত, কলকাতা-৫১
রাসায়নিকের ভয়
গ্রাম ও শহরের পুকুরগুলোয় এখন মাছ চাষ করার জন্য নানা রকম রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়। হাইব্রিড মাছ, পাট, পানিফল, পদ্মফুল, কচুরিপানা ইত্যাদি চাষের জন্য পুকুরে গলা অবধি দেহ ডোবাতে হয়। এ সব রাসায়নিক জলজ উদ্ভিদ-প্রাণীর ক্ষেত্রে বিষ, জীববৈচিত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক। জেনে বা না-জেনে নানা রাসায়নিক ওষুধ দেওয়া হয় বদ্ধ জলাশয়ে। গবাদি পশু স্নান করানো হয়। তা ছাড়া যে কোনও বদ্ধ জলাশয় দূষণের ডিপো। শহরের পুকুরগুলো আবার ডাস্টবিন— বর্জ্য প্লাস্টিক আবর্জনা ভাসে যত্রতত্র। সেগুলো সরিয়ে ছোট ছেলের দল সাঁতার কাটে। মিস্ত্রিমজুর হাতমুখ ধুয়ে নেন, স্নান করেন। স্বাতী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ পড়ে মনে হচ্ছে, সমস্যা শুধু সুন্দরবনে আটকে নেই। জলের চাহিদা-জোগানের মানচিত্রে নানা ভাবে জলদূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। আর্সেনিক দূষণ তার আর এক মাত্রা।
জলবায়ুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে জলদূষণের ফলে ক্ষতির কথা প্রচার হওয়া দরকার। কিন্তু এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সমান্তরাল চিকিৎসা এবং বিকল্প জীবিকারও দরকার। সুন্দরবনের জীবকুলের মধ্যে মানুষকে বাঁচতে হবে, বাঁচাতেই হবে। সুন্দরবনের সঙ্গে অন্য গ্রাম ও শহরে জলাশয় ব্যবহার বিষয়েও সচেতন হতে হবে। এত দিন বিশুদ্ধ পানীয় জল নিয়ে চিন্তা বাড়ছিল। এ বার দেখা যাচ্ছে, পরিবেশে সব রকম জল যথাসাধ্য দূষণমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া দরকার।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি