২০১৮ সালের মে মাসে চাকরিসূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসি। সঙ্গী আমার স্ত্রী। প্রথম দেড় বছর উইসকনসিন রাজ্যের মিলওয়াকি নগরে থাকার পরে ২০১৯ সালের নভেম্বর এর শেষে আমরা স্থান পরিবর্তন করি, সেটাও চাকরিসূত্রে। বর্তমানে আমরা মিশিগান রাজ্যের রচেস্টার হিলস শহরের বাসিন্দা। আমার কর্মস্থান বাড়ি থেকে ৭ মাইল দূরে ট্রয় শহরে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনা ভাইরাস পজিটিভ রুগীর সন্ধান মেলে জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখ। দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের একটি রাজ্য, ওয়াশিংটনে। তারপরে ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য রাজ্যে। ক্যালিফোর্নিয়া, ইলিনোই, ওরেগনসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন রাজ্যে করোনা রোগীর খোঁজমিলতে থাকে। বিষয়টির গুরুত্ব তখনও আমরা অনুধাবন করতে পারিনি। আমাদের রাজ্যে তখনও কোনো পজিটিভ কেস ছিল না। ফেব্রুয়ারিতে দেশের অন্যান্য প্রান্তে থাকা বন্ধুদের কাছে শুনছিলাম কী ভাবে মানুষের মনে ধীরে ধীরে ভীতির সঞ্চার হচ্ছে, কী ভাবে মানুষ প্রয়োজনের থেকে বেশি নিত্য সামগ্রী ঘরে জমায়েত করছে।
আমাদের রাজ্যেও যেকরোনা আক্রমণ করবে তা অবশ্যম্ভাবী ছিল। ফেব্রয়ারি মাস থেকেই কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছিল, বার বার হাত পরিষ্কার করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য সকলকে অনুরোধ করা হচ্ছিল। তখনই বাজার থেকে উধাও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক । মার্চ মাসের ১০ তারিখ প্রথম খবর টা এলো।
মিশিগান এর প্রথম দুই করোনা রোগীর খোঁজ মিলল। তার মধ্যে এক জন আমাদেরই কাউন্টিতে। রাজ্যে ঘোষিত হল জরুরি অবস্থা। মার্চের ১১ তারিখ রাজ্যের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি, স্কুল ও কলেজ নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থা কে অনলাইনে পরিবর্তন করার কথা জানাল। মার্চের ১২ তারিখ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, রোজকার মত কর্মস্থানে পৌঁছেছি সকাল ৮টা তে। অন্যান্য দিনের মতোই সবকিছু চলছিল, হঠাৎ ১০টা নাগাদ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সবাই কে নিয়ে মিটিং ডাকা হলো। আমাদের জানান হলো আমাদের টিমের একজনের স্ত্রী শ্বাসকষ্টজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি। তাদের দুই জনেরই করোনা টেস্ট করতে দেওয়া হয়েছে, রিপোর্ট যতক্ষণ না আসছে, আমরা সবাই যেন বাড়ি থেকে কাজ করি। ভয়, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ মিলিয়ে মিশিয়ে অফিসে তখন এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। সবারই মনে একটাই প্রশ্ন, আমি কি ইতিমধ্যেই আক্রান্ত? যদি হই, তাহলে ততক্ষণে আমাদের বাড়ির লোকেরাও হয়ত আক্রান্ত। একরাশ চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সেইদিনই সন্ধেবেলা সবাইকে ইমেল এর মাধ্যমে অফিস থেকে জানান হলো যে আমাদের কলিগ এবং তার স্ত্রী-র রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। স্বস্তি কাকে বলে, তা যেন সে দিন নতুন করে অনুভব করলাম। যাই হোক, আমাদের অফিস এ ফেরত যাওয়া আর হয়নি, অনির্দিষ্টকালের জন্য ওয়ার্ক ফ্রম হোম শুরু হয়। এ দিকে রোগীর সংখ্যা ২ থেকে বেড়ে ২৫ হয়ে ওঠে মার্চের ১৩ তারিখেই। বুঝতে পারি এ বারে নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার সামগ্রী ঘরে মজুত করার দিন এসে গেছে। সেই দিনই বাজার করতে বেরিয়ে আরেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, ওয়ালমার্ট, টার্গেট ইত্যাদি সুপারমার্কেট গুলো তে দুধ, চিনি, লবণ, পাউরুটি থেকে শুরু করে মাংস, সামুদ্রিক ফ্রোজেন মাছ সবকিছুই অমিল। স্টোরে কর্মরত স্টাফদের কাছে শুনলাম, প্রত্যহ সকালে স্টক রিফিল করার কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। পরদিন সকালবেলা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বিভিন্ন স্টোর ঘুরে যথাসম্ভব খাদ্যসামগ্রী মজুত করলাম এবং সেই থেকে শুরু হল যাকে বলে হোম কোয়ারান্টিনে থাকা।
ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশে ন্যাশানাল এমার্জেন্সী ঘোষণা করেছেন। ধীরে ধীরে বার, পাব, রেস্তোরা, জিম সব কিছুই বন্ধ করে দেওয়া হলো। মার্চের ২৪ তারিখ রাজ্যে সংখ্যাটা যখন ১৭৯১ এবং মৃত ৯, তখন সারা রাজ্যে ১৪ এপ্রিল অব্দি ‘স্টে অ্যাট হোম’- এর নির্দেশ দেন গভর্ণর। অর্থাৎ নির্দেশিত ভাবে শুরু হলো লকডাউন। ভারতের মতো অত কঠোর নিয়মাবলী এই দেশের লকডাউন অবলম্বন করেনি। গ্রসারি করতে যাওয়া, ওষদুধ কিনতে যাওয়ার পাশাপাশি দু’বেলা হাঁটাহাঁটি বা জগিং, রেস্তরাঁয় টেকওয়ে ব্যবস্থা, গণপরিবহন ব্যবস্থা অনেক ছিল খোলা। এর মধ্যে সারা দেশের মতো আমাদের রাজ্যেও সংখ্যাটা বাড়তে বাড়তে ভয়াল রূপ নিতে থাকে। মার্চ মাসের শেষ থেকে এপ্রিল এর প্রথম সপ্তাহের প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি করে কেস বাড়তে থাকে আমাদের মিশিগানে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে মৃত্যুও। মিশিগান তখন সারা দেশে আক্রান্তের সংখ্যা অনুযায়ী নিউ ইয়র্ক ও নিউ জার্সির ঠিক পরেই অর্থাৎ ৩ নম্বরে। বাড়িতে দমবন্ধ পরিস্থিতি, বাইরে ভয়াল অতিমারির আমন্ত্রণ, এর মধ্যে ভরসা শুধু ব্যালকনিতে গিয়ে একটু তাজা হাওয়ার নিশ্বাস।
এরই মধ্যে গভর্ণর বাড়িতে থাকার নির্দেশ বাড়িয়ে ৩০ এপ্রিল অবধি করলেন। আজকে ১৯ এপ্রিল, যখন এই প্রতিবেদন লিখছি, তখনও পর্যন্ত রাজ্যে ৩১ হাজার ৪২৪ জন এই মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত, মৃত ২৩৯১। বিশেষজ্ঞরা মতামত দিচ্ছেন, কোনও আক্রান্ত যেখান দিয়ে হেঁটে যাবেন, তার রেসপিরেটরি ড্রপলটস কিছুক্ষণ হাওয়া তে ভেসে থাকতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে সেখান দিয়ে অন্য একজন হেঁটে গেলে এই ভাইরাস বায়ুবাহিত হয়ে তাঁর শরীরে প্রবেশ করতে সক্ষম। বেশ বুঝতে পারছি মজুত খাদ্যদ্রব্য শেষ হলে অনলাইনে অর্ডার করাই এখন নিরাপদ। এখানের বেশিরভাগ স্টোর ই কন্টাক্ট লেস পিক আপ চালু করেছে, কিন্তু সেখানেও স্লট পাও খুবই দুরূহ। এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো শেষ তিনদিন যাবত আমাদের রাজ্যের রাজধানী ল্যানসিং এ বেশ কিছু মানুষ জমায়েত হয়ে এই ‘স্টে আট হোম’ নির্দেশ এর বিরোধিতায় সামিল হয়েছেন। খবর এর কাগজ বা সংবাদমাধ্যমে এখনও পর্যন্ত ভারতের অনেকের সচেতনতা বোধ, নিরন্তর দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার অনেক উদাহরণ ই দেখেছি, কিন্তু মানুষ বোধয় সব দেশেই একই রকম হয়। একটি প্রথম বিশ্বের দেশ হয়েও আজ এই ধর্না, যার দরুণ হয়ত শুধুই কিছু পজিটিভ কেস এর বৃদ্ধি ঘটবে, কোথাও গিয়ে সমগ্র মানবজাতি কে বসাই একই পংক্তিতে।
এ তো গেল এখানের কথা। কিন্তু দুশ্চিন্তার এখানেই শেষ নয়। আমাদের পরিবার পরিজন বেশিরভাগই সবাই ভারতে রয়েছেন। অধিকাংশই বয়স্ক। প্রত্যহ খবরে ভারতের করোনা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি দেখে আমাদের কপালের চিন্তার রেখাগুলো যেনো আরও ঘনীভূত হয়। দু’বেলা ফোন করে খোঁজখবর নেওয়া আর সতর্ক করা ছাড়া আর কী বা করতে পারি আমরা? তবুও বলতে হয়, যে ভাবে অনেক আগেই কঠোর লকডাউন এর আশ্রয় নিয়েছে ভারত, তাতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার আগেই হয়ত আশার আলো দেখা যাবে । এত গুলো উন্নত দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো যেখানে এই মারণ ব্যাধির কাছে হার মানতে বাধ্য হলো, সেখানে ভারতবর্ষ তার বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে কি পরিস্থিতিতে পরতে পারে, তা ভেবেই শিউরে উঠতে হয়।
আজকের খবর অনুযায়ী গোটা আমেরিকা তে ৭ লক্ষ ৬৪ হাজার ১৭৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ঝরে গেছে ৪০ হাজার ৫৯১ টি প্রাণ। এরই মধ্যে আশার আলো, এই ভাইরাস এর সঙ্গে মারণ যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন ৭০ হাজার১৭২ জন মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে সংক্রমণের শিখর পেরিয়ে এসেছি আমরা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির চাকা অনেকদিন যাবত বদ্ধ। অনেক মানুষ ইতিমধ্যে চাকরি হারিয়েছেন। বেকারত্ব পৌছেছে সর্বকালীন শিখরে। তাই আর দেরি না করে প্রতিটি রাজ্যে কে ৩টি ধাপে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার কথা ঘোষণা করেছেন ফেডারেল গভর্নমেন্ট। কিন্তু মনে একটি প্রশ্ন খোঁচা মারছে, বাইরে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে গিয়ে আরও বিপদ ডেকে আনব না তো?
যদি তাই হয়, আমরা কি প্রস্তুত একটা যুদ্ধ পুরোপুরি জিতে ওঠার আগেই আরেকটি যুদ্ধে নামার জন্য?
অয়ন মণি
রচেস্টার হিলস, মিশিগান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)