শান্তিপুরের পশ্চিম দিকে হরিপুর গ্রাম ছিলো এক সময়ে বর্ধিষ্ণু জনপদ। নদীপথে যোগাযোগের সুবিধা থাকায় সেখানে হরিনদী সংলগ্ন অঞ্চলে সম্ভ্রান্ত মানুষের বসবাস ছিল। এই গ্রামের মাটি অনেক বিখ্যাত মানুষের জন্ম দিয়েছে যাঁরা সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে নিজের ও তাঁর জন্মভূমির সুনাম সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদেরই এক জন কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।
কবি যতীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে কল্লোল গোষ্ঠীর লেখক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছিলেন, ‘‘যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত আমাদের আরাধনীয় ছিলেন — ভাবের আধুনিকতার দিক থেকে যতীন্দ্রনাথের দুঃখবাদ বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব অভিজ্ঞতা। আমাদের তদানীন্তন মনোভাবের সঙ্গে চমৎকার মিলে গিয়েছিল দুঃখের মধ্যে কাব্যের যে বিলাস আছে, সেই বিলাসে আমরা মশগুল ছিলাম। তাই নৈরাশ্যের দিনে ক্ষণে-ক্ষণে আবৃত্তি করতাম ‘মরীচিকা’।’’
যতীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের এই উক্তিটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা রবির কিরণ তখন মধ্যগগনে— কাব্য, উপন্যাস, গল্প, নাটকের জগতে কেউ তাঁকে অতিক্রম করতে পারছেন না। বেশির ভাগ সাহিত্যিকই কোনও না কোনও দিক থেকে রবীন্দ্র অনুগামী, রবীন্দ্র অনুসারী হয়ে পড়েছেন। ঠিক সেই সময়ে আধুনিক কাব্যধারার জগতে একটি স্বতন্ত্র ধারা নিয়ে আর্বিভূত হলেন যতীন্দ্রনাথ।
যতীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যরচনায় রবীন্দ্র অনুকরণ থেকে মুক্ত হয়ে, সাহিত্য ক্ষেত্রে একটি বিশেষ শাখাপথ তৈরি করতে পেরেছিলেন। সেই শাখা পথটিকে আমরা বলি ‘দুঃখবাদ’। সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত সেই তর্ক থেকে দূরে সরে বলা যেতে পারে, সেই নতুন কাব্যমানসের জন্যই তিনি রবীন্দ্রযুগে আপন মহিমায় স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন।
যতীন্দ্রনাথ ১৮৮৭ সালে ২৬ জুন এখনকার গ্রামীণ বর্ধমানের কালনা মহকুমার অন্তর্গত পাতিলপাড়ায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। কবির পৈতৃক নিবাস ছিল নদিয়ার শান্তিপুর শহরের পশ্চিমে হরিপুর গ্রামে। কবির শৈশব কেটেছে হরিপুর অঞ্চলে। পিতা ছিলেন দ্বারকানাথ সেনগুপ্ত, মায়ের নাম মোহিতসুন্দরী দেবী। যতীন ছিলেন বাবা-মায়ের এক মাত্র জীবিত সন্তান, তার আগের চার-পাঁচ ভাইবোন কেউই শৈশব পেরোয়নি। যখন যতীনের বয়স আট বছর, তিনি পড়লেন ম্যালেরিয়ায়। সেই যে রোগ তাঁকে ধরল, সেই রোগ থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি রেহাই পাননি।
ছেলেবেলা থেকেই আমবাগান, অশ্বত্থগাছ, দিগন্ত প্রসারিত মাঠ, বিল, বিশাল চর, পল্লিপথ, পাখপাখালির ডাকের সঙ্গে গ্রাম্যজীবনের দুর্গোৎসব, দোলযাত্রা, মহরমে আত্মীয়স্বজন পরিবৃত হয়ে যতীন্দ্রনাথের মানসলোক গড়ে ওঠে। শৈশবে গ্রামের বিদ্যালয়ে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করতে-করতে যখন তাঁর বয়স বারো বছর, তিনি স্কুলবৃত্তি পেয়ে কলকাতায় কাকার বাড়িতে চলে যান উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য। কলকাতায় পড়াশোনা করতে-করতে দেড় বছরের মাথায় আবার তাঁকে ধরল প্লেগে। কিন্তু প্লেগ তাঁকে কাবু করতে পারল না। প্লেগমুক্তির কিছু দিন পরে পড়লেন টাইফয়েডে। যন্ত্রণায় পেটের নাড়ি ছেয়ে গেলেও এ যাত্রায় ফের প্রাণে বেঁচে গেলেন।
রোগে-রোগে ভুগে যতীনের শরীর হয়ে গেলো শীর্ণকায়। বাড়ির লোকে মনস্থির করতে পারছেন না, তাঁকে দেশের বাড়ির পাশের গ্রামের স্কুলে পড়াবেন না কলকাতায়। সেই সময়ে তাঁর বাবা বালেশ্বরে চাকরির সুবাদে যতীনকে সেখানে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। দিন যত গেল, বালেশ্বরের জল-হাওয়ার গুণে কয়েক মাসে যতীন্দ্রনাথের শরীরের হতশ্রী দশা দূর হতে লাগল। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে সুখ নেই। কিছুদিন বাদে বাবার চাকরি চলে গেল। তাঁকে আবার কলকাতায় ফিরতে হল।
কলতাতায় ফিরে ১৯০৩ সালে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স, ১৮ বছর বয়েসে জেনারেল আ্যসেম্বলিজ় ইনস্টিটিউশন (বর্তমানে স্কর্টিশ চার্চ কলেজ) থেকে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক বন্ধুর পরামর্শে যতীন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলেন। শিবপুরে ভর্তি প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘‘...পদ্মপুকুরের সন্নিকটে বসেই প্রবেশিকা পরীক্ষা করলেন সেখানকার ডাক্তার। বুকের মাপ, দেহের ওজন সবই কম হল। তখন ডাক্তারবাবু একটা পরীক্ষা করলেন। সেটা তৃতীয় প্রহরের নিদাঘ রৌদ্রে দূরের একটা অশ্বত্থগাছ দেখিয়ে বললেন— ঐ পর্যন্ত জোরে ছুটে গিয়েই ফিরে এস। হাঁপিয়ে গেলেও সেটা পারলাম।... তখন ডাক্তার করুণাপরবশ পাশ করিয়ে দিলেন অর্থাৎ বুকের মাপ দেহের ওজন ইত্যাদি বাড়িয়ে লিখে দিলেন। ইঞ্জিনিয়ার হবার জন্য কোমর বাঁধলাম।’’
কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে যতীন লেখাপড়া চালাতে লাগলেন পুরোদমে। কিন্তু সমস্যা এসে জুটল ওয়ার্কশপে। তিনি লিখছেন, ‘‘প্রথম বছর ছুতোরখানার কাজ। প্রথমেই প্রত্যেককে রেলের স্লিপারের মতো একটা কাঠ দিয়ে হাত করাতের সাহায্যে সেটাকে ফালাফালা করে চিরতে বলা হল। সেই সামান্য কাজটুকু সুসম্পন্ন করার পর আসল কাজ শেখানো হবে। দু তিন দিনের মধ্যে দু হাতে ফোস্কা পড়ে, গলে ঘা হয়ে গেল, কিন্তু কাঠ বির্দীর্ণ হল না। দু চার জন তার পরই সরে পড়লেন অভিভাবকদের বহু টাকা নষ্ট করে।... আমরা গরীবের ছেলে, প্রাণপণে কাজ ও পড়া চলিয়ে যেতে লাগলাম।’’
এই ভাবে নিরলস পরিশ্রম করতে-করতে কবি ছুতোরশাল-কামারশাল-কণ্টকিত বিদ্যার পরীক্ষায় শেষ পর্যন্ত কষ্টসৃষ্টে পাশ করলেন। পাশ করার পরে প্রথম ট্রেনিং পড়ল ঢাকায়। তা শেষ করে আসার পরে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে-তে সার্ভেয়ার পদে প্রথম যোগ দেন। এবং মাত্র ১২ দিন বাদেই ১৯১৩ সালে নিজের পিতৃভূমি নদিয়ায় জেলা বোর্ডের চাকরিতে যোগদান করেন।
কলেজে পড়ার সময়ে এক বার বন্ধু মিহিরের সঙ্গে যতীনের তর্ক বাধে। স্মৃতিকথায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘‘মিহির বলে, রবীন্দ্রনাথের মতো কবি বাংলায় জন্মায়নি, সে উত্তপ্ত হয়ে জানায় নবীন সেনের ‘কুরুক্ষেত্র’ যে পড়েছে সে ও কথা বলবে না। কিছু দিন পূর্বে আমরা ‘কুরুক্ষেত্র’ পড়েছিলাম, মাইকেলের ‘সীতা ও সরমা’ অংশ, হেমচন্দ্রের ‘অশোকতরু’ প্রভৃতি দশ-বিশটা কবিতা পড়া ছিল, বাল্যকালে পিশিমার কাশীরাম দাসের মহাভারতখানি লুকিয়ে কয়েকবার শেষ করেছি, গ্রামের মুচিপাড়ায় ও কুলোপাড়ায় বারোয়ারি পূজায় কবির গান ও তর্জার লড়াই আমরা শুনেছি। কিন্তু রবি ঠাকুরের কবিতা আমরা তখনও পড়িনি, গান দু দশটা শুনেছি। মিহির মৃদু হেসে বলল— নবীন সেন ও রবীন্দ্রনাথে কি তফাৎ সেটা বোঝাবার জন্য রবিবাবুর কাব্যগ্রন্থাবলী তোমাদের দেব, আগামী বর্ষবকাশে পড়ে দেখো তারপরে তর্ক কোরো। মিহির প্রদত্ত আড়ে-দীঘে সমান, একখানি প্রকাণ্ড রবীন্দ্র কাব্যগ্রন্থাবলী নিয়ে ছুটির সময়ে হরিপুরে এলাম। পড়ে দেখে আমরা তো অবাক। হায় নবীন সেন, এই বিদ্যা নিয়ে মিহিরের সঙ্গে তর্ক করা হচ্ছিল।’’ (চলবে)