প্রতীকী ছবি।
কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প ঘিরে প্রতিবাদের ঢেউ এখন অনেক স্তিমিত এবং তরুণেরা সেনাবাহিনীর এই অস্থায়ী নিয়োগ প্রকল্পে ঠান্ডা মাথাতেই আবেদন করছেন। কারণ, তাঁদের সামনে অন্য কোনও বিকল্প পথ খোলা নেই।
বাস্তবের মাটিতে দাঁড়ালে বোঝা যায়, বিষয়টি সরকারি নিয়োগ ব্যবস্থার এক বৃহত্তর প্রবণতা এবং স্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক এবং অস্থায়ী— প্রায় এক ধরনের জাতপাত-ভিত্তিক বিভাজনের দিকে ইঙ্গিত করে। এদের মধ্যে প্রথম স্তরটিতে কর্মরতরা পরবর্তী দু’টি স্তরের থেকে অনেকটাই বেশি বেতন পান এবং সেই বেতনক্রম (বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই) বাজারের অন্য ক্ষেত্রগুলির তুলনায় ভাল। সেই কারণে বিষয়টির মধ্যে সামঞ্জস্য আনতেই সরকার এবং তার এজেন্সিগুলি পরবর্তী দুই স্বল্পবেতনের স্তরে অধিক মাত্রায় নিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। এর প্রকৃত অর্থ যাঁরা অনুধাবন করতে চান, তাঁরা ২০১৯-এর ব্যঙ্গাত্মক হিন্দি ছবি ‘ঈব আল্লে ঊউউ’ দেখে নিতে পারেন।
ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপ মূলত দুই চেহারায় অবতীর্ণ হচ্ছে। এক দিকে পড়ে থাকা অঢেল শূন্যপদে নিয়োগ বন্ধ রাখা হয়েছে, যার ফলে ডাক ব্যবস্থার মতো ক্ষেত্র রীতিমত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয় প্রবণতাটি মারাত্মক। বহু ক্ষেত্রেই সরকারি কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রে মাসের পর মাস বেতন বকেয়া থেকে যাচ্ছে। স্কুল শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, আশা-কর্মী— যা-ই হন না কেন, আপনি ভুগছেন, ভুগেই চলেছেন। সরকারের এক বড় অংশের কর্মচারীদের জন্য মাসান্তে বেতনপ্রাপ্তির বিষয়টি আর নিশ্চিত নয়।
সুতরাং সরকারি মালিকানাধীন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলির ‘সেরা নিয়োগক্ষেত্র’ হিসেবে সুনাম আর নেই। এক বেসরকারি মালিকানাধীন সংস্থার কর্মী বেতন বাকি রাখা বা না-দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। কিন্তু যখন বেতন না পেয়ে সরকারি কর্মচারীরা আদালতের দ্বারস্থ হন, হতাশাগ্রস্ত বিচারকদের সামনে উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেন, বেতন দেওয়ার মতো অর্থের জোগান আর নেই।
চুক্তিভিত্তিক এবং অস্থায়ী কর্মচারীদের কাছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে হিসেবে আর একটি ব্যাপার রয়ে যায়। সেটি এই যে, দশকওয়াড়ি বেতন কমিশনের কোনও সুফলই তাঁরা পান না। পাঁচ বছর আগে বেতন কমিশন ঘোষণা করেছিল, সর্বনিম্ন বেতনক্রম হবে মাসিক ১৮ হাজার টাকা। এই অঙ্কটি যত ‘নিম্ন’-ই হোক না কেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ এটুকুও পান না। অন্য দিকে, স্থায়ী সরকারি কর্মচারিরা যে শুধুমাত্র সেই অঙ্কটি লাভ করেন, তা নয়। সেই সঙ্গে পান মহার্ঘভাতা, আবাসনের সুবিধা ইত্যাদিও। সর্বোপরি থাকে চাকরির নিশ্চয়তা এবং অবশ্যই অবসরকালীন ভাতা ও আজীবন চিকিৎসার সুবিধার মতো বিষয়গুলি। ঘটনা আরও সমস্যার দিকে চলে যায় যখন এক পদ-এক পেনশনের সিদ্ধান্ত সশস্ত্র বাহিনীর অবসরকালীন ভাতার সামগ্রিক পরিমাণকে বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে তোলে। এমন একটা সময় আসে, যখন প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বেতনের পরিমাণ দ্বিগুণ হয় কিন্তু একই ক্ষেত্রে অবসরকালীন ভাতার পরিমাণ তিন গুণ বৃদ্ধি পায়।
মূলত দু’টি বিষয় সরকার এবং তৎসংলগ্ন সংস্থাগুলিকে স্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ থেকে বিরত থাকতে উৎসাহ দিয়েছিল। এর প্রথমটি অবশ্যই ব্যয়সংক্ষেপ। দ্বিতীয়টি উৎপাদনশীলতা। কোনও কাজ সুসম্পন্ন করার পরে কোনও পুরস্কারের ব্যবস্থা নেই, কর্মীদের কাজে উৎসাহ দিতে কোনও ভাতা বা ‘ইনসেন্টিভ’ও নেই। একই সঙ্গে বিভিন্ন আইন ও তার অনুষঙ্গ ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতাও সীমিত রেখেছে। শোনা যায়, যে সব শিক্ষক তুলনামূলক ভাবে ভদ্রগোছের বেতন পেয়ে থাকেন, তাঁদের অনেকেই বাড়িতে বসে থেকে অন্য কাউকে ‘বকলমা’ দিয়ে বিদ্যালয়ে পড়াতে পাঠান। এই বকলমাধারীরা সেই শিক্ষকের বেতনের একাংশ পেয়ে থাকেন বলেও শোনা যায়। আবার এ-ও শোনা যায় যে, অফিসকর্মীরা বেআইনি কোটা পদ্ধতি চালু করে রেখেছেন, যার ভিত্তি তাঁরা দিনে ক’টি চিঠি পাঠাচ্ছেন, তার উপর প্রতিষ্ঠিত।
সুতরাং চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের সংখ্যা চার বছরে দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ লক্ষ ৩০ হাজার। সামগ্রিক সরকারি নিয়োগে তাঁদের অংশ ক্রমেই বাড়ছে। সে দিক থেকে দেখলে ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প এই ব্যয়সংক্ষেপ-যুক্তিকে সেনাবাহিনীতে প্রয়োগ মাত্র— প্রথম স্তরভুক্তদের অবসরকালীন ভাতাকে ছেঁটে ফেলতেই যেন এই প্রকল্পের অবতারণা। এক বার এতে সম্মতি জানালে প্রজন্ম পরম্পরায় এই অন্যায় চলতে থাকবে। ইতিমধ্যে এক নিষ্ফল হস্তক্ষেপও দেখা গিয়েছে। কয়েক বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছিল যে, স্থায়ী এবং চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের মধ্যে বেতন ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে কোনও বিভেদ রাখা যাবে না। ভারতীয় রেল সম্ভবত একমাত্র সংস্থা, যারা এই বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য একটি পোর্টাল চালু করে। সরকারের বাকি সংস্থাগুলির কোনওটিতেই সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ কোনও অর্থই বহন করে আনেনি। সর্বত্র বেতনক্রমের ক্ষুরধার বৈষম্যই কৌলিক হয়ে দাঁড়ায়।
এই ‘জাতপাত ভিত্তিক’ ব্যবস্থা সহজে বিদায় নেবে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে যখন নতুন এক শ্রম আইন চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগের বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করছে (যদিও অন্য ক্ষেত্রে এবং অপেক্ষাকৃত কম বিশ্বস্ত সূত্রে খবর, অসংগঠিত এবং অস্থায়ী ক্ষেত্রে কিছু বেশি সুবিধা প্রদানের কথাও জানা গিয়েছে)। তা সত্ত্বেও বেতন কমিশনকে এমন নির্দেশ দেওয়া সম্ভব নয় যে, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে স্থায়িত্বের ধারণাটিকেই বিলোপ করা হোক। যদি কিছুই না করা যায়, তা হলে অন্তত দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে বলবৎ করা হোক। কিন্তু এ ধরনের সংস্কার সাধন যে কতখানি দুরূহ, তার ধারণা পাওয়া যায় তখন, যখন কোনও কোনও রাজ্য সরকার স্থায়ী এবং যথাযথ ভাবে নির্ধারিত পেনশন ব্যবস্থা থেকে পিছিয়ে এসে (‘অস্থায়ী’ বলে বাতিল করে) এক সুবিধাদানের প্রকল্প চালু করছে। আমেরিকান অর্থনীতিবিদ ম্যানকার ওলসন বহু দিন আগেই এই বিষয়ে সাবধান করেছিলেন যে, সুরক্ষাপ্রাপ্ত স্বার্থগোষ্ঠীগুলি যেন-তেন-প্রকারেণ তাদের সুবিধার পথ ঠিকই বার করে নেবে।