প্রতীক্ষা: গান্ধীমূর্তির পাদদেশে বিক্ষোভরত এসএসসি-র চাকরিপ্রার্থীরা। ২৫ এপ্রিল, ২০২২। ছবি: সুমন বল্লভ
সকালে খবরের কাগজ খুললে ইদানীং দুর্নীতি এবং বেনিয়ম ছাড়া কিছুই আর চোখে পড়ে না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দুর্নীতি, নিয়ম-না-মেনে চলা ইত্যাদি গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোনও কাজ যদি সহজে, টাকাপয়সার লেনদেন ছাড়াই হয়ে যায়, তা হলে আমরা আজকাল চমৎকৃত হই— নিজের মনেই ভাবি, আজ সকালে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম! কোনও সৎ, ঋজু শিরদাঁড়ার মানুষ দেখলে মনে হয়, ঈশ্বর দর্শন হল বুঝি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পকলা, সিনেমা, সবেতেই দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শাসকের মন জুগিয়ে-না-চলা বেয়াড়া লোকেদের শায়েস্তা করার সংস্কৃতি। তাই সর্বত্র স্তাবকতা ও চাটুকারিতার হিড়িক— যে ভাবেই হোক, নিজের আখেরটুকু গোছাতে হবে। তার জন্য চরম নির্লজ্জ হতেও আপত্তি নেই। দুর্নীতি, স্তাবকতা ও চাটুকারিতা এখন মিলেমিশে একাকার।
শিক্ষার কথাই ধরা যাক। শিক্ষা এমন একটি বিষয়, সমাজে এবং অর্থব্যবস্থায় যার গুরুত্বের কথা বাড়িয়ে বলা অসম্ভব। শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়তে সাহায্য করে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল প্রাথমিক শিক্ষা, যা ভবিষ্যৎ নাগরিকদের ভিত তৈরি করে। আর সেই প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগেও বিপুল দুর্নীতি। ভাবা প্রয়োজন যে, কেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য এত দুর্নীতি হবে। কারণটা বুঝতে কষ্ট হয় না— যে অঞ্চলে শিল্প বলে কিছুই নেই, অর্থাৎ শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের চাকরির বাজার প্রায় নেই বললেই চলে, সেখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য বহু যুবক-যুবতী জান কবুল করবেনই। খেয়াল রাখা ভাল যে, রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের সন্তানরাও বাঁকা পথে প্রাথমিক শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করছেন। মাধ্যমিক স্তরেও একই গল্প। নিয়োগের ক্ষেত্রে এমনই ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে যে, নিত্য দিন কারও না কারও চাকরি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
শিক্ষক যদি ভাল না হন, তা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পঙ্গু হবে। আর, তেমন জনগোষ্ঠী নিয়ে কোনও দেশ এগোতে পারে না, আমরাও পারব না। যথাযথ মানবসম্পদ উন্নয়নের সুফল পেতে সময় লাগে। এই সত্যটি অনুধাবন করার জন্য যে শিক্ষা, মনন ও দূরদৃষ্টির প্রয়োজন, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের নেতাদের মধ্যে তার অভাব প্রকট। তাই আমাদের অধঃপাতে যাওয়াও অব্যাহত। এখন কলেজের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন রকম অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির অভিযোগ আগের আমলেও উঠেছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা আগে হইনি।
শিক্ষা নিয়ে অন্য প্রহসনটি হল অনলাইন পরীক্ষা। ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশ হলে বসে অফলাইন পরীক্ষা দিতে চাইছে না, অনলাইন পরীক্ষা চাইছে। কারণটা জলের মতো সহজ— এরা সবাই অসৎ পথ অবলম্বন করে নম্বর পেতে আগ্রহী। কিন্তু যেটা দুর্ভাগ্যজনক যে, সেই কথাটা এমন স্পষ্ট ভাবে বলতে এদের কোনও লজ্জা নেই। এরা সর্বসমক্ষে টুকলি করার অধিকার দাবি করছে। আরও হতাশাজনক হল, এদের অনেকের মা-বাবাও অনলাইন পরীক্ষার পক্ষে সওয়াল করছেন। সাধারণত মা-বাবারা সন্তানদের সুশিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেন, সৎ পথে থাকার শিক্ষা দেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি একটি বৃহত্তর সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে নির্দেশ করে।
এ রকম একটি ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি করা শুরু হয়েছে যে, আজকাল দুর্নীতির আশ্রয় না নিলে জীবনে কিছু করা যাবে না। এই ভাবনার পিছনে যে যুক্তিটা রয়েছে, সেটা এই রকম— যদি এক জন দুর্নীতির আশ্রয় নেন, তা হলে বাকিদের সৎ থাকাটা বোকামি, কারণ দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিটি সমস্ত সুফল নিয়ে যেতে পারেন, এবং বাকিরা হয়তো কিছুই পাবেন না। তাই, যদি এক জন দুর্নীতির আশ্রয় নেন, তা হলে বাকিদেরও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এই ভাবনা থেকেই একটি সর্বব্যাপী দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার জন্ম হতে পারে।
যদি সমাজে সুযোগের অভাব না থাকে, তা হলে দুর্নীতির প্রয়োজন কম পড়ে— অর্থাৎ যদি অর্থনৈতিক ও তার সঙ্গে সামাজিক উন্নয়ন যথেষ্ট পরিমাণে হয়, সে ক্ষেত্রে দুর্নীতি কম থাকার সম্ভাবনা। তার মানে কি উন্নত দেশে দুর্নীতি নেই? আছে, কিন্তু দৈনন্দিন-জীবনের দুর্নীতি বা ‘পেটি করাপশন’ তুলনায় অনেকটাই কম। যা আছে, তা প্রধানত উচ্চস্তরের দুর্নীতি, সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে তার প্রত্যক্ষ আঁচ কম লাগে। এই বিষয়টি নিয়ে অর্থশাস্ত্রের দুনিয়ায় প্রচুর তথ্য-নির্ভর গবেষণা আছে, উৎসাহী পাঠক খুঁজে দেখতে পারেন। তাই, দৈনন্দিন-জীবনের দুর্নীতির চক্র যদি ভাঙতে হয়, তবে শাসকের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মন দেওয়া উচিত।
কিন্তু সেটা যে বেশ পরিশ্রমসাধ্য! তার থেকে যেমন চলছে চলুক, ক্ষমতায় থাকাটাই মোক্ষ। ক্ষমতায় থাকার জন্য যদি জনকল্যাণের নামে দানসত্র খুলতে হয়, এবং তার জন্য যদি খেটে খাওয়া কর্মচারী ও অন্যদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করতে হয়, তাতেও আপত্তি নেই। অতএব, কিছু দিন পর ভাল কোনও ছাত্র আর সরকারি শিক্ষা জগতে আসবেন না, ভাল কোনও ডাক্তার সরকারি হাসপাতালে চাকরি নেবেন না। তাতে সরকারি পরিষেবার মান হ্রাস পাবে, এবং তার ফলে স্বজনপোষণের পথ যে আরও একটু সুগম হবে না, তা কে বলতে পারে?
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, ‘অভাব থেকে দুর্নীতি, না স্বভাব থেকে দুর্নীতি?’ এই নিয়েও বিহেভিয়রাল ইকনমিকস বা আচরণবাদী অর্থনীতিতে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে স্বভাব না অভাব, কোনটার বেশি প্রভাব, সেটিও একটি গবেষণার বিষয়বস্তু। কিন্তু দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও নির্লজ্জতা যে একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
অর্থনীতির তাত্ত্বিক গবেষণায় এটিও দেখানো হয়েছে যে, সামান্য একটু দুর্নীতি আসলে সমাজের পক্ষে ভাল। যদিও গবেষণালব্ধ এই ফলাফলটি অনেকেরই অপছন্দ হতে পারে, নৈতিকতায় বাধতে পারে, এটি নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা হতে পারে, কিন্তু ফলাফলটি আছে, এবং ধারণাটি ইতিবাচক। কিছু ক্ষেত্রে কিছু ভাল কাজ তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করতে হয়তো একটু নিয়ম এ দিক-ও দিক করা শ্রেয়। নিয়মের গেরোতে আটকে গেলে হয়তো কাজটি হবেই না। অনেক ক্ষেত্রে ‘গ্রিজ় মানি’ একটি কাজকে মসৃণ ভাবে সময়ে সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, সমাজের সর্বত্র ব্যাপক দুর্নীতি থাকতে হবে— অর্থনীতিতে ‘সামান্য’ দুর্নীতির কথাই বলা হয়েছে, সর্বব্যাপী নয়। বাংলার দুর্নীতিকে এই যুক্তিতে না দেখাই বোধ হয় ভাল।
আমাদের রাজনৈতিক নেতারা যেমন র্যাশনালি বা যুক্তিসঙ্গত ভাবে দুর্নীতি করছেন, আবার সমস্যাটি হয়তো কিছুটা স্বভাবজাত। এঁদের প্রায় কারও প্রাচুর্যের অভাব নেই, কিন্তু তাও দুর্নীতি তাঁদের চরিত্রগত হয়ে গিয়েছে। আর একটি সম্ভাব্য কারণ হয়তো রাজনীতিকে একটি পেশা ও সুযোগ হিসেবে দেখা। ‘সুযোগ’, অর্থাৎ নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়া— জনগণের সেবা করার বা দেশের জন্য ভাল কিছু করার সুযোগ নয়। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে এক জন একটি রাজনৈতিক দলের উচ্চ স্তরে জায়গা পান, এবং নেতা বা মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পান। এই ক্ষমতায় থাকাকালীন যতটা সম্ভব নিজের জন্য ও নিজের প্রিয়পাত্রদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার জন্য যা যা করার, সব কিছু করতেই তাঁরা রাজি। এখানে সঠিক-বেঠিক নিয়ে ভাবার কোনও ইচ্ছা কারও নেই। তাই আমাদের অঞ্চলে শিল্প না থাকতে পারে, কিন্তু দুর্নীতি, সামাজিক অবক্ষয় ও সুবিধাবাদকে আমরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। সেটাই বা কম কী?
অর্থনীতি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়