GDP

গাছ কাটলেও জিডিপি পুষ্ট হয়, অরণ্যসৃজনও বাতাস দেয় জিডিপি-র পালে! এ এক অদ্ভুত হিসাব

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে পরিবেশ ধ্বংসের কথা জিডিপি-তে উল্লিখিত থাকে না। কিন্তু আজকের অর্থ-ভাবনায় বিষয়টিকে মাথায় রাখতেই হবে।

Advertisement

টি এন নাইনান

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:০৯
Share:

জিডিপি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ফাইল চিত্র।

মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি সম্পর্কে আধুনিক ধারণাটিও কম করে নয় দশকের পুরনো। ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস সম্মেলনে এটি ‘প্রাইমারি ইকোনমিক মেজ়ার’ হিসাবে গৃহিত হয়, যার ফলস্বরূপ প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) এবং বিশ্ব ব্যাঙ্ক। সমালোচকরা গোড়া থেকেই বিষয়টির নিন্দা এই বলে করে থাকেন যে, এতে প্রাধান্যের জায়গায় যুদ্ধ, অসাম্য এবং মানবিক প্রগতির মতো বিষয়গুলি উল্লিখিত হয়নি। অন্য দিকে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশ নিয়েও জিডিপি মাথা ঘামায় না। জলবায়ুগত পরিবর্তন মানুষের জীবনে যে বিভিন্ন রকমের প্রভাব রেখে যাচ্ছে, তা নিয়ে জিডিপি আদৌ ভাবিত নয়। খেদের বিষয় এই যে, গাছ কাটা হলে তা জিডিপি-কেই পুষ্ট করে। আবার, নতুন অরণ্যসৃজনও জিডিপি-রই পালে বাতাস দেয়।

Advertisement

এই বিশেষ কারণেই হয়তো জিডিপি সাম্প্রতিক কালে তার গুরুত্ব হারাচ্ছে। যদি কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশগত পরিবর্তন বন্ধ করার ব্যাপারে সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে নজরে রাখা হয়, তা হলে দেখা যাবে যে, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন, বিদ্যুৎচালিত গাড়ি তৈরি ইত্যাদির ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বহু শিল্প-কারখানার পুনর্বিন্যাসেও লগ্নি করা হচ্ছে। কোনও কোনও দেশে কয়লা-নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি বন্ধ করে পুনর্নবীকরণযোগ্য উপকরণ-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। প্রায় সব দেশই এই বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। পেট্রল বা ডিজেল-চালিত গাড়ির বিক্রি এই মুহূর্তে বিশ্বে এমন এক শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে বসে আছে যে, এর পর তা দ্রুত কমতে থাকবে এবং বিদ্যুৎচালিত গাড়ির উৎপাদন ও বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত করবে। আগামী দশকের মধ্যেই সাবেকি বৃহদাকার শিল্প-কারখানার যুগ অতীত হতে থাকবে।

এই বিভিন্ন রকমের ওলট-পালট আর বাধা-বিঘ্নের সময়ে জিডিপি কিছুটা বিভ্রান্তিও তৈরি করতে পারে। এক মাত্র নিট জাতীয় উৎপাদন বা এনডিপি (জিডিপি থেকে অবমূল্যায়নকে বাদ দিলে যা পাওয়া যায়) পারে বর্তমান সম্পদের একতরফা বিলোপ বা ক্রমবর্ধমান অবমূল্যায়নের মধ্যেকার উথাল-পাথালকে নিয়ন্ত্রণ করতে। যদি কোনও কয়লা-চালিত শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের বদলে সৌরবিদ্যুৎ বা হাওয়াকল চালু করা হয়, তা হলে এনডিপি-র নেওয়া হিসাব অনুযায়ী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কয়লা-চালিত কারখানাটির উচ্ছেদের ব্যাপারটিকেও মাথায় রাখতে হবে। সেখানে জিডিপি কেবল মাত্র সৌরবিদ্যুৎ বা হাওয়াকলের উৎপাদনটুকু হিসেব করে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে।

Advertisement

ইতিমধ্যেই অর্থনীতির ‘প্রোডাক্টিভ অ্যাসেট’ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অবমূল্যায়নের বিষয়টিও গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। ১৯৫০-১৯৭৫ সালের মধ্যে ভারতের জিডিপি এবং এনডিপি-র মধ্যেকার ব্যবধান (অর্থাৎ অবমূল্যায়ন) ৬ শতাংশের থেকে কিছু বেশি ছিল। এই মুহূর্তে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশে। কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমানো বা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ এই পরিবর্তনশীল সময়ে জিডিপি ও এনডিপি-র মধ্যেকার ফারাককে আরও বাড়াবে। কারণ, কার্বন-নিবিড় উৎপাদন আরও বেশি পরিচ্ছন্ন পরিবর্তের পথ খোলা রাখে, বিশেষ করে কার্বন-নিবিড় উৎপাদন-যন্ত্রের উপযোগের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রেলপথের ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত ডিজ়েল ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে, অচিরে যার অধিকাংশই সাইডিংয়ে পড়ে থাকবে (অথবা রফতানি করা হবে), অন্তত যত দিন না পর্যন্ত রেলপথের সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিকরণ সম্ভব হচ্ছে।

এই বিষয়টি এবং অন্যান্য পরিবর্তনগুলির হিসাব কিন্তু অবমূল্যায়নের সম্পূর্ণ ছবিটিকে তুলে ধরতে পারবে না। কারণ, বৃহৎ অর্থনীতির ক্ষেত্রে সাধারণত যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, এমনকি যখন সেগুলি পুঁজির সংগঠনকে স্বীকারও করে, সেই সময়েও তারা প্রাকৃতিক সম্পদকে হিসাবের মধ্যে আনে না। জলসম্পদ, অরণ্য সম্পদ, পরিচ্ছন্ন বাতাস ইত্যাদি হিসাবের বাইরে থাকে। ভারতের ভূগর্ভস্থ জলের মাত্রায় পতন কয়েক দশক ধরেই লক্ষ করা যাচ্ছে। শস্য উৎপাদক রাজ্যগুলিতে এর প্রতিফলনও দেখা যাচ্ছে। বায়ুদূষণ গণস্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। গাঙ্গেয় সমভূমিতে তাপমাত্রার ক্রমাগত বৃদ্ধি কাজের সময়কে কমিয়ে আনছে। হিমালয় অঞ্চলে যে সব বাঁধ নির্মিত হয়েছে, সেগুলি পরিবেশের ক্ষতি করেই চলেছে। জোশীমঠের বাসিন্দারা তা মর্মে মর্মে টের পাচ্ছেন। বাঁধগুলি নিজে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। ২০২১ সালে দু’টি নির্মীয়মাণ বাঁধ জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল, এ কথা মনে রাখা দরকার।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিল্পগত পরিবর্তনে এই বিষয়গুলি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এবং ক্রমাগত এগুলি বেড়েই চলেছে। এর একটি ফল হল এই যে, লগ্নি এবং তা থেকে প্রাপ্য ফলের অনুপাতে এগুলি বৃদ্ধি নিয়ে আসবে অথবা প্রতি একক উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজির এককের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাবে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাথমিক পরিচায়ক হিসাবে জিডিপি-র নির্ভরযোগ্যতা কমতে থাকে।

এর উল্টোদিকে এনডিপি-র প্রতি আরও মনঃসংযোগ কিন্তু যথেষ্ট নয়। এমন ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশটির তরফে অর্থনীতির ব্যালান্স শিট-এ উল্লিখিত অ্যাসেট এবং লায়াবিলিটিগুলির প্রতি, প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পদের প্রতি নজর রাখা প্রয়োজন। এমন ব্যালান্স শিটে জিডিপি এবং এনডিপি-কে পাশাপাশি রেখে দেখা প্রয়োজন। ঠিক যে ভাবে কোনও কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা সেই সংস্থার ব্যালান্স শিটে উল্লিখিত অ্যাসেট এবং লায়াবিলিটির পাশাপাশি আয় ও ব্যয়ের হিসাবকেও খতিয়ে দেখেন, তেমন নজরদারির প্রয়োজন এখানেও রয়েছে। প্রায়শই ব্যালান্স শিট অতি গুরুত্বপূর্ণ নথি হয়ে দাঁড়ায়। যদি পরিবেশগত পরিবর্তন অর্থনীতিকে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য করে, তা হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান্যের বিষয়টিতেও অনিবার্য ভাবে পরিবর্তন আসবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement