‘নতুন তৃণমূলের ধারক’ সভায় সভায় বলছেন, ‘‘লিখে রাখুন। সেভেন ডাবল এইট ডাবল সেভেন, সেভেন ডাবল এইট ডাবল সেভেন। সরাসরি আমাকে ফোন করবেন!’’ মূল ছবি: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজ থেকে।
সাপ্তাহিক পুঁথির হেডিং ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল— ‘এটা কি টু ফোর ফোর ওয়ান ওয়ান থ্রি নাইন?’ না কি গানটা কোথাও একটা গুনগুন করছিল? ফোন নম্বর শুনেই শিরোনামটা ভেসে এল?
কোথায় নব্বই দশকের মোবাইল-পূর্ব পৃথিবী আর কোথায় এই একুশ শতকের অব্যর্থ এবং একান্ত পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম! কিন্তু তা-ও কোথাও একটা সেই মিলে গেল। মিলে গেল আকুতিতে। মিলে গেল পাশাপাশি সাজানো আপাত নৈর্ব্যক্তিক কিছু সংখ্যার কচকচি পেরিয়ে আহ্বানে। ভিন্ন পরিস্থিতি। ভিন্ন আঙ্গিক। ভিন্ন পরিসর। তবু ‘টু ফোর ফোর ওয়ান ওয়ান থ্রি নাইন’-এর সঙ্গে মিলে গেল ‘সেভেন ডাবল এইট ডাবল সেভেন, সেভেন ডাবল এইট ডাবল সেভেন’।
বাংলার রাজনীতিতে এই ১০টি সংখ্যার প্রাদুর্ভাব বছর দেড়েক। এর দাতা এবং গ্রহীতা একজনই। যিনিই নম্বর দেন, তিনিই ফোন পেতে চান— অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই এর পোশাকি নাম ‘এক ডাকে অভিষেক’। যিনি ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর শাসক তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন এবং তার পর থেকেই ‘নতুন তৃণমূল’ তৈরির সাধনা শুরু করেছেন। আসলে শুরু করেছেন তৃণমূলের অন্দরে ‘সাফাই অভিযান’। যে অভিযানের অভিজ্ঞান তিনি অহরহ রেখে যাচ্ছেন প্রকাশ্যে কড়কানি দিয়ে, ‘‘সময় দিচ্ছি, এখনও শুধরে যান! নইলে যে ওষুধ প্রয়োগ করব, তাতে কিন্তু আর শুধরোনোর সময় পাবেন না।’’ অথবা, ‘‘কে, কোথায়, কী করছেন, তার সব খবর আমার কাছে আছে। সব খবর পৌঁছয়।’’ ৭৮৮৭৭-৭৮৮৭৭ সেই অভিযানেরই অঙ্গ।
আবেগের যে ঝোড়ো হাওয়ায় তৃণমূলের রকেট-উত্থান হয়েছিল একদা, অভিষেক তা যথাসম্ভব অক্ষুণ্ণ রেখেই দলকে বাঁধতে চাইছেন কর্পোরেট সংস্কৃতিতে। একটা সময়ে চালু রসিকতা ছিল, তৃণমূল দলটা চলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঁধের নীল ঝোলা ব্যাগ থেকে। এখন আর সে দিন নেই। এখন অভিষেকের নেতৃত্বে ঝোলাব্যাগ থেকে সদর্পে বেরিয়ে তৃণমূল তার সরব, উচ্চকিত এবং জোরদার উপস্থিতি নিয়ে অবিরত দেখা দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কারণ, ‘ক্যাপ্টেন’ (তৃণমূলের অন্দরে অভিষেকের অনুগামীরা তাঁকে এই নামেই ডেকে থাকেন) মনে মনে বিশ্বাস করেন ‘শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ’। মনে করেন, লোহাই লোহাকে কাটতে পারে। মনে করেন, বিজেপির আইটি সেলের সঙ্গে লড়তে গেলে নিজেদের আগ্রাসী সমাজমাধ্যম-দুরস্ত করা ছাড়া উপায় নেই।
তিনি নিজে কি আবেগ-রহিত? নাহ্। কিন্তু তিনি প্রকাশ্যে আবেগ দেখানোতেও বিশ্বাসী নন। পরিচিতেরা জানেন, ২০১৯ সাল থেকে পরিবারের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকেন না এই মধ্য তিরিশের যুবক। কারণ, তিনি মনে করেন, রাজনীতি করতে গেলে ১০০ শতাংশ সময় দিয়েই করা উচিত। সেখানে পরিবার, পরিজন ইত্যাদি দ্বিতীয় সারিতে থাকবে। দ্বিতীয়ত, তাঁর যে দৈনন্দিন জীবনধারা (আজ এখানে কাল সেখানে। প্রায় সারাদিন এবং কখনও কখনও রাতেও বাড়িতে দলসমাগম), তার সঙ্গে খামোকা তাঁর পরিবার মানিয়ে নিতে যাবে কেন? সে জন্য দুই নাবালক সন্তানের সঙ্গে তাঁর সশরীরে দেখা হয় সপ্তাহান্তে অথবা কোনও পারিবারিক অনুষ্ঠানে। কয়েক ঘণ্টার জন্য। বাকিটা ভিডিয়ো ফোনকল-এ।
রাজনৈতিক তিতিক্ষা? কৃচ্ছ্রসাধন? আত্মত্যাগ? হতে পারে। আবার হতে পারে দলের অন্দরে ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত স্থাপনের সুচিন্তিত পদক্ষেপ।
বস্তুত, অভিষেক যে পদক্ষেপই নিচ্ছেন, দলের অন্দরে ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপনের জন্যই। আর্থিক অনিয়ম, বে-হিসেব দুর্নীতি, গা-জোয়ারি এবং গোষ্ঠীলড়াইয়ের যে বদনাম গত ১১ বছরে ক্ষমতাসীন তৃণমূলের গায়ে আষ্টেপৃষ্টে সেঁটে বসেছে, তা ধুয়ে ফেলতে গোটা দলকে এক দৈত্যাকার ওয়াশিং মেশিনে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন দলের ‘অঘোষিত’ দু’নম্বর। কঠিন কাজ। খুব কঠিন! হারকিউলিসের একা একা বিপুলায়তন আস্তাবল সাফ করার মতোই প্রায় দুঃসাধ্য। গ্রিসের প্রাচীন উপকথা বলে, বীর হারকিউলিস নদীর খাতটাই ঘুরিয়ে আস্তাবলের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়ে যাবতীয় আবর্জনা ধুয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে এক উপকথা মাত্র। ফলে তাতে কিছু রং চড়ানোও থেকে থাকবে। তৃণমূল কঠোর এবং রূঢ় বাস্তব! যে বাস্তব বলছে, এক দশক টানা শাসনক্ষমতায় থেকে বড়-মেজো-সেজো এবং কুচো নেতাদের মজ্জাগত হয়ে গিয়েছে বিনা আয়াসে এবং পরিশ্রমে অভীষ্টলাভের অভ্যাস। আর দলের অন্দরেই তার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বসে আছেন অভিষেক!
বরাবরই তিনি খানিক অন্তর্মুখী। অপ্রগল্ভ। তবে তাঁর রসবোধও কম নয়। নইলে সাংবাদিকতায় দুই প্রজন্মের মধ্যে অনায়াসে জায়গা করে-নেওয়া প্রবীণ সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ বৃত্তে বলতে পারতেন না, ‘‘এ তো সুব্রত বক্সি! পুরনো তৃণমূলেও ছিলেন। নতুন তৃণমূলেও আছেন।’’ বলতে কি, নিজস্ব পরিবৃত্তে খানিক বেশিই স্বচ্ছন্দ (সে কে-ই বা নন) অভিষেক। যাকে অধিকাংশই ‘ঔদ্ধত্য এবং উন্নাসিকতা’ বলে ব্যাখ্যা করেন। সে দলের ভিতরে হোক বা বাইরে। তবে সময়ের প্রয়োজনে (না কি দাবিতে) সে প্রকৃতিও বদলেছেন অভিষেক। আত্মনির্মিতি ঘটেছে তাঁর। এখন তিনি অনেক বেশি আগুয়ান।
সাফল্য (২০২১ সালের কঠিনতম ভোটে দলের সর্বময় নেত্রী মমতার পাশাপাশি তিনিও কঠোর পরিশ্রম করে সফল হয়েছিলেন) এবং সেই সাফল্যজনিত ক্ষমতা এক আশ্চর্য আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দেয় মানুষের মধ্যে। যে আত্মবিশ্বাস অভিষেকের ভিতর থেকে ঠিকরে বেরোয়। যে আত্মবিশ্বাস প্রকাশ্য সভায় সটান বলে, ‘‘আমি এক কথার ছেলে। আমার জেদ কঠিন। যা করতে পারব বলি। যেটা করতে পারব না, সেটাও বলে দিই।’’ এতটাই সাহস সেই প্রত্যয়ের এবং এতই স্পষ্ট তার বিচ্ছুরণ যে, অনেকে ভাবেন, যা চাইছেন, সেটা করার জন্য যে কোনও রাস্তাতেই হাঁটতে পারেন অভিষেক। তাঁর সামনে যে বাধাই আসুক, বুলডোজ়ারের মতো গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে যাবেন। কিন্তু রাজনীতিতে কোথাও একটা বোধহয় বিনির্মাণেরও প্রয়োজন হয়। হতে পারে। তবে সে খতিয়ান ভবিষ্যৎ নেবে। আপাতত দেখা যাচ্ছে, জনসভায় অভিষেকের বক্তব্য শুনে বিরোধী বিজেপির মুখপাত্রও চ্যানেলের বিতর্কে বলতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘‘উনি কিন্তু খুব ভাল কথা বলেন।’’
ঠিকই। তাঁর শত্রুরাও স্বীকার করবেন, অভিষেক নিজের বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারেন। নিজের বিশ্বাসে অনড় থাকেন। পাশাপাশিই জানেন, কোথায় কখন কোন কথাটা বলতে হয় বা হয় না। যেমন সরাসরি এই সত্যের সঙ্গে মানিয়ে নেন, ২০১৯ সালের লোকসভায় তাঁরা জোরালো ধাক্কা খেয়েছিলেন। ৩০-৩২টা আসন পাবেন ভেবে ২২-এ গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২১ সালের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন এবং চাকা ঘুরিয়ে ছেড়েছেন। তার পর থেকেই আবার ২০২৪-এর লোকসভা এবং পর্যায়ক্রমে ২০২৬-এর বিধানসভার মঞ্চ তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছেন। কারণ, সেটাই রাজনীতিকের ‘উচিত’ কাজ। যেমন এখনও গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন, রাজনীতিতে অবসরের বয়স থাকা উচিত। সে ষাট, পঁয়ষট্টি, সত্তর বা পঁচাত্তর— যা-ই হোক না কেন। কিন্তু তা আর প্রকাশ্যে বলেন না।
দুর্ঘটনা-পরবর্তী পর্যায়ে স্টেরয়েড-সমৃদ্ধ ওষুধের আধিক্যে মুটিয়ে গিয়েছিলেন। পরিশ্রম করে প্রায় ৩০ কিলো ঝরিয়েছেন। সপ্তাহে চার থেকে পাঁচ দিন ট্রেডমিল করেন। অতীতের টেবো টেবো গালের ‘বেবি ফ্যাট’ ঝরে গিয়ে হনুর হাড় ঠেলে উঠেছে। মুখাবয়বে স্পষ্ট চোয়ালের রেখা। ডায়েট সংক্রান্ত অনুশাসন-টাসন নেই। রাতে খাওয়ার পর এখনও একটা করে চকোলেট খান। আর বাড়তি ক্যালরি ঝরিয়ে ফেলেন প্রত্যহ। মণিবন্ধে বাঁধা থাকে ফিটনেস ব্যান্ড। রোজ ১০ হাজার ‘স্টেপ’ হল তো? যদিও নিজের বদলের কথা জিজ্ঞাসা করলে মৃদু হেসে বলেন, ‘‘আমি তো কোনও বদল দেখতে পাই না। আগেও দাড়ি রাখতাম না। এখনও রাখি না।’’
কিন্তু মুখে যা-ই বলুন, অভিষেক নিজেও ভিতরে ভিতরে বদলের কথা বিলক্ষণ জানেন। ঠাহর করলে বোঝা যায়, পরিধেয় থেকে শুরু করে অন্তরাত্মা— সব কিছুতেই অনিবার্য বদল এসেছে তাঁর। তৃণমূলের টিপিক্যাল লম্বা ঝুলের কুর্তা, চুড়িদার পাজামা এবং ঢাউস স্নিকার্সে তাঁকে কদাপি দেখা যায় না। বরং তিনি অনেক স্বচ্ছন্দ শার্ট-ট্রাউজার্স আর চামড়ার মামুলি স্লিপার্সে।
এবং বক্তৃতা! এ কথা লিখলে আশা করি কেউ রে-রে করে তেড়ে আসবেন না যে, একমাত্র মমতাকে বাদ রাখলে তৃণমূলের নেতানেত্রীদের মধ্যে অভিষেকই এখন এক নম্বর বক্তা। কাটা কাটা উচ্চারণ, শব্দচয়ন, কোন শব্দের উপর কখন জোর দিতে হবে, সেই প্রয়োজনটুকু প্রায় অধীত অভ্যাসের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন এই যুবক। দীর্ঘ বক্তৃতা হোক বা সংক্ষিপ্ত, কোথাও কোনও হোঁচট নেই। উচ্চারণে গলদ নেই। সাংবাদিক বৈঠকে যে ভাষায় প্রশ্ন, প্রশ্নকর্তার দিকে সটান তাকিয়ে সেই ভাষাতেই জবাব (বাংলা, ইংরেজি বা হিন্দিতে)। নিজেকে নিয়মিত অনুশীলন এবং অনুশাসনের কড়া চাবুক না-মারলে এগুলো এমনি এমনি হয় না।
তৃণমূল স্তরের কর্মীরা বিশ্বাস করেন, ঘাসফুলের তলায় যে বেনোজল জমে তার গোড়া আলগা করে দিচ্ছে, এই ঝকঝকে যুবক আন্তরিকতা নিয়ে ঝাঁটা-হাতে তা সাফ করতে নেমেছেন। ছবি: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজ থেকে।
সবচেয়ে বড় কথা— জনতার সামনে ঝুঁকতে শেখা। মাথা নত করতে শেখা। এবং সেই সহবত-সঞ্জাত প্রক্রিয়ায় মাটির সঙ্গে সেতুবন্ধন। ২১ জুলাইয়ের সভায় বৃষ্টির ক্ষুরধার ছাঁটের মধ্যে যে ভাবে তিনি জনারণ্যের সামনে নিজের মাথার ছাতা সরিয়ে দিলেন বা কেশপুরের সভায় যে ভাবে সর্বসমক্ষে তিন জন একেবারে সাধারণস্য সাধারণ মানুষের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন (নিজে ‘ব্রাহ্মণসন্তান’ হয়েও), তাকে বিরোধীরা ‘নাটক’ বলতে পারেন। ‘দেখনদারি’ বলতে পারেন। কিন্তু ভিতরের ভাবনাটা সম্ভবত অস্বীকার করতে পারবেন না। যে ভাবনার মধ্যে রয়েছে ‘নেত্রী’ থেকে ‘দিদি’ হয়ে ওঠার মতোই ‘নেতা’ থেকে ‘দাদা’ হয়ে ওঠার দীর্ঘ এবং পরিকল্পিত যাত্রা।
সেই যাত্রা কি নিষ্কণ্টক? নাহ্। তৃণমূলের অন্দরে এখনও কিছু সন্দিগ্ধু রয়েছেন। যাঁরা ঠারেঠারে বলেন অভিষেকের জনতার সঙ্গে মিশতে পারার ‘অক্ষমতা’র কথা। বলেন, রাহুল গান্ধীর মতো অভিষেকেরও উচিত ‘বাংলা জোড়ো যাত্রা’ করা। যাতে তিনি জনগণের সঙ্গে ‘নাড়ির টান’ তৈরি করতে পারেন। অভিষেক নিজে তেমন কিছু ভাবেন কি? মনে হয় না। কারণ, নিজস্ব পরিকাঠামো ব্যবহার করে তিনি রাজ্য জুড়ে ‘জনযোগাযোগ’ করতে শুরু করেই দিয়েছেন। বাংলায় একটি ‘সমান্তরাল প্রশাসন’ চলতে শুরু করেছে গড়গড়িয়ে। কিন্তু নবান্নের সঙ্গে তার কোনও বিরোধ নেই। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে হাঁকডাক না-করে পৌঁছে যাচ্ছেন ‘দাদার দূত’। দাদার ‘অদৃশ্য চোখ’। যা নিয়ে অভিষেকের কোনও রাখঢাক নেই। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘আমি সকলের উপর একটা অদৃশ্য চোখ রাখছি। সব খবর আমার কাছে পৌঁছয়। সে দু’ঘণ্টা পরেই হোক বা দু’দিন পরে।’’
আশ্চর্য নয় যে, তাঁর সেই আশ্বাস বেদবাক্যের মতো আঁকড়ে ধরছেন তৃণমূল স্তরের কর্মীরা। কারণ, তাঁরা বিশ্বাস করেন, ঘাসফুলের তলায় যে বেনোজল জমতে জমতে তার গোড়া আলগা করে দিচ্ছে, এই ঝকঝকে যুবক আন্তরিকতা নিয়ে ঝাঁটা-হাতে তা সাফ করতে নেমেছেন।
দলের অন্দরে তাঁর সমালোচকেরা (দলধৌতির যে ‘মিশন’ তিনি নিয়েছেন, তাতে সমালোচনা হতে বাধ্য) অবশ্য বলেন, অভিষেক গোয়া জিতে দেখাতে পারেননি। ফলে তিনি এখনও ‘নেতা’ নন। মেঘালয় এবং ত্রিপুরা সে দিক থেকে তাঁর কাছে চ্যালেঞ্জ বইকি! যেমন চ্যালেঞ্জ ‘বিরোধীশূন্য’ ক্ষমতাসক্তির হাতছানি এড়িয়ে রক্তপাতহীন এবং ‘দাদাগিরি’ না করে পঞ্চায়েত ভোট পার করা।
কিন্তু তার চেয়েও বৃহত্তর এবং সুদূরপ্রসারী চ্যালেঞ্জ সম্ভবত ‘ক্ষমতাসীন’ হয়ে রাজনীতি করা। তিনি যখন সংসদীয় রাজনীতিতে এসেছেন, তখন রাজ্যে তাঁর দল ক্ষমতায়। তিনি যখন দলের দায়িত্ব পেয়েছেন, তখন তাঁর দল তদবধি কঠিনতম ভোটটি বিপুল ভাবে জিতে উঠেছে। ফলে প্রশাসনে অভিষেকের ‘প্রভাব’ অবিসংবাদী। যে প্রশাসন এখন তাঁর আজ্ঞাবহ, সেই প্রশাসন যখন তাঁকে বিরোধী আসনে দেখবে, তখন অভিষেকের নেতৃত্ব কালের কষ্টিপাথরে যাচাই হবে।
তাঁর হিতৈষীরা অবশ্য বলেন, বিরোধী পক্ষে থাকার অভিজ্ঞতা যে অভিষেকের একেবারেই নেই, তা নয়। তিনি অত্যন্ত কাছ থেকে মমতাকে দেখেছেন। দেখেছেন কার্যত একার হাতে জগদ্দল পাথরসম দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের সিপিএম শাসনকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার লড়াই। কিন্তু দুষ্টু লোকেরা মানলে তো! তারা তো আর সত্যি সত্যিই ‘ভ্যানিশ’ হয় না। বরং অবিরাম গুঞ্জন চলতে থাকে। চলতেই থাকে। কিন্তু তাতে কান দিলে অভিষেকের চলে না। বিশেষত, তাঁর মাথায় যখন দলনেত্রীর বরহস্ত রয়েছে। রয়েছে। ঠিকই লিখলাম।
গত শনিবার কেশপুরে অভিষেকের সভা দেখতে দেখতেই ঝপ করে গানটা মনে পড়েছিল। ‘নতুন তৃণমূলের ধারক’ বলছিলেন, ‘‘লিখে রাখুন। সেভেন ডাবল এইট ডাবল সেভেন, সেভেন ডাবল এইট ডাবল সেভেন। এই নম্বর দিয়ে গেলাম। সরাসরি আমাকে ফোন করবেন!’’
মনে হচ্ছিল, এত দিন ‘রং নম্বর’-এ ডায়াল করে ভুক্তভোগী মুখগুলো মঞ্চের নীচ থেকে বলছে, ‘‘এটা কি ৭৮৮৭৭-৭৮৮৭৭? অভিষেক তুমি পারছ কি শুনতে?’’
অভিষেক কি পারছেন? শুনতে?
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)