Kutupalong Rohingya Refugee Camp

জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি!

পৃথিবীর বৃহত্তম শরণার্থী শিবির। যেখানে দেশি-বিদেশি গাড়ির কনভয় দেখে শিশুরা ভয় পায় না। শিবিরের নাম কুতুপালং।

Advertisement

অনিন্দ্য জানা

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:০০
Share:

রবীন্দ্রনাথ আসেননি ঠিকই। এলে বুঝতেন, এই-ই হল আসল ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’। মূল ছবি: রয়টার্স। ছবি সম্পাদনা: শৌভিক দেবনাথ।

গেল! গেল! গেল! গেল! ত্রাহি-ত্রাহি রব উঠল চলমান গাড়ি থেকে। উইন্ডস্ক্রিনের আবডাল থেকে দেখলাম, একটি ফুট দুয়েক উচ্চতার শিশু রাস্তা পেরোচ্ছে। বগলে প্রায় তার সমান উচ্চতার একটা সফ্‌ট ড্রিঙ্কসের প্লাস্টিকের বোতল। ভাবলেশহীন। একটা আস্ত মাইক্রোবাস যে প্রায় ঘাড়ের উপর এসে পড়ছে, সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞানরহিত।

Advertisement

ইট-বিছানো ধুলোমাখা রাস্তায় সশব্দে ব্রেক কষল মাইক্রোবাস! চারচাকার ঘষটে যাওয়ার শব্দ, আরোহীদের কী-হয়, কী-হয় ভাব সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হেলেদুলে রাস্তা পেরোল ঢুলঢুলে পেন্টুল আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত চেহারাটা। তার পরে সেঁধিয়ে গেল পাশের একটা গলির মধ্যে। অতএব, প্রাণটা গেল না।

পৃথিবীর (পৃথিবীর, ঠিকই লিখলাম) বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে আপনাকে স্বাগত। যেখানে দেশি-বিদেশি গাড়ির কনভয় দেখে শিশুরা ভয় পায় না। কিলবিল করতে করতে অকুতোভয়ে রাস্তা পেরোয়। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি ঠিকই। কিন্তু এই-ই হল আসল ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’।

Advertisement

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথে বাঁ দিকে ঘুরে আরও প্রায় ৩২ কিলোমিটার। শিবিরের নাম কুতুপালং। এই জনপদে (শিবির না বলে ‘জনপদ’ লেখাই সঙ্গত মনে হল, না কি ‘শহর’ই বলা উচিত) সরকারি হিসেবেই বাসিন্দার সংখ্যা ১১ লক্ষ। বেসরকারি হিসেবে সাড়ে ১২ লক্ষ!

অনেক উপর থেকে যেমন দেখতে রোহিঙ্গা শিবির। রয়টার্সের ড্রোনচিত্র।

এই ২০২৩ সালে নয়, ২০১৮ সাল থেকেই কুতুপালং পৃথিবীর বৃহত্তম শরণার্থী শিবির। ১৯৭০ সাল থেকে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা শুরু করেছিলেন। ২০১৭ সালের জুলাই মাসেও এই শিবিরে ৩৪ হাজার শরণার্থী ছিলেন। কিন্তু ২০১৭ সালের অগস্টের শেষ থেকে মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর ফৌজি এবং মায়ানমারের নাগরিকদের একাংশের মারমুখী আক্রমণের ফলে তাঁরা বন্যার জলের মতো ঢুকতে শুরু করেন বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায়। তখন থেকেই এই কুতুপালং শিবির আসন্নপ্রসবার চেহারা নিয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের তৎকালীন দুর্যোগ মোকাবিলা মন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। তাঁরা চলে এলে বাংলাদেশ তাঁদের আশ্রয় দেবে। তখনই বন দফতর কুতুপালংয়ে ৫ হাজার একর জমি বরাদ্দ করে। সেখানে ৩ হাজার একর জমিতে ৮ লক্ষ শরণার্থীকে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়। এক মাসের মধ্যেই সেই সংখ্যা ৭৭ হাজারে পৌঁছে যায়। তার পর যত সময় এগিয়েছে, তত লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে এই জনপদে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা।

রোহিঙ্গারা হলেন মুসলিম সংখ্যালঘু। যাঁরা আদতে মায়ানমারের বাসিন্দা। সেখানকার বৌদ্ধদের দাবি, রোহিঙ্গারা ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’। যে দাবি বিতর্কিত। যে দাবির কোনও জোরালো সাক্ষ্য বা তথ্যপ্রমাণও নেই। কিন্তু ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে নেই-আঁকড়া হয়ে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া তাঁদের আর উপায়ই বা কী?

টিলার উপর থেকে নীচের দিকে তাকালে দেখা যায় লগবগে সব কাঠামো। তার্পোলিনের ছাউনি। কাঁটাতারের বেড়া। তার ভিতরে ভিতরেই ঘুপচি সংসার আর গেরস্থালি। কিন্তু কী নেই সেখানে! কাঁচা মাটির মেঝে, বাঁশের বেড়া আর ঝোড়ো বাতাসে উড়ে যাওয়ার মতো ছাউনি নিয়ে ছোট ছোট ইস্কুল আছে। সেখানে শিক্ষক আছেন। দরমার বেড়ার ঘরে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার আছে। টেলিভিশনে মেসির বিশ্বকাপ জয় দেখা আছে। হাতে-পায়ে নাচানো ফুটবল আছে। থান কাপড় ডাঁই-করা দর্জির দোকান আছে। তৈজসপত্রের ব্যবসা আছে। সব্জির বাজার আছে। মণিহারি ব্যবসা আছে। আছে বিভিন্ন গোষ্ঠীবিন্যাস। আছে অপরাধ। অস্ত্র। খুন-জখম। আছে মাদক, অস্ত্র আর সোনার চোরাচালানে যোগ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা। আছে পাকিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘আরসা’ (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) মৌলবাদী জঙ্গিদের নিরন্তর উস্কানি। আছে মাঝেমধ্যেই উদ্ধার-হওয়া অত্যাধুনিক রাইফেল, বুলেটের ম্যাগাজিন, গ্রেনেড, মাদক। আর আছে প্রকৃতির নিয়মে জন্ম এবং মৃত্যু।

আর আছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবিমিশ্র গুণগান। তিনি এই রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব না নিলে কে জানে কোথায় যেতেন এঁরা!

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে বিশ্ব রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান আরও সযুত করতে চেয়েছিল। তা যে হয়নি, তা-ও নয়। ছবি: রয়টার্স।

কিন্তু যাঁরা বলেন, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশ গুলিসুতো খেয়ে ফেলেছে (সুকুমার রায় স্মর্তব্য), তাঁরা কি ভুল বলেন? সম্ভবত নয়। লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে বিশ্ব রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান আরও সযুত করতে চেয়েছিল। তা যে হয়নি, তা-ও নয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য (এ দেশের ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া ও খাওয়ানো কোনও কঠিন কাজ নয়) যে কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের মতোই ছিল। তখন বিভিন্ন বিদেশি সাময়িকীর প্রচ্ছদে শেখ হাসিনা। সঙ্গে শিরোনাম: ‘মাদার অফ হিউম্যানিটি’। পাশাপাশিই হাসিনা বলেছিলেন, ‘‘মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই সাময়িক সময়ের জন্য আশ্রয় দিচ্ছি আমরা। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জন্য এখানে সাময়িক ভাবে থাকাখাওয়া, চিকিৎসা-সহ প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করা হবে। আমরা আছি আর্ত মানবতার সেবায়।’’

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ‘সাময়িক’ শব্দটি লক্ষণীয়। প্রণিধানযোগ্যও বটে। তার পর থেকে বাংলাদেশ আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সময়ে মায়ানমারে ফেরানোর উদ্যোগ নিয়ে এসেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটা হলেও হতে পারত। কিন্তু তার মধ্যেই মায়ানমারে পট পরিবর্তন হয়ে যায়। সু চি-র সরকার চলে গিয়ে আসে ফৌজি শাসন। ফলে রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন আটকে পড়ে কুতুপালংয়ের টিলার আবডালে। বাড়তে থাকে তাঁদের সংখ্যা। চাপ বাড়তে থাকে বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর। অনেককে ভাসান চরে নিয়ে গিয়ে প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা হয়েছিল। যা খুব ফলপ্রসূ হয়নি।

বাংলাদেশ আশা করেছিল, ভারত সরকার বিষয়টি নিয়ে মায়ানমারের সঙ্গে মধ্যস্থতা করবে। কিন্তু নয়াদিল্লি নীতিগত ভাবে তাতে রাজি নয়। যদিও ভারতে অন্তত তিনটি রোহিঙ্গা শিবির রয়েছে। কিন্তু তা বাংলাদেশের শিবিরের ভয়াবহ আয়তনের তুলনায় নস্যি!

কুতুপালংয়ের শরণার্থী শিবিরে এ ভাবেই চলে ছোটদের লেখাপড়া। — নিজস্ব চিত্র।

কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে কাঁটাতারের বেষ্টনীর মধ্যে অফিসঘরের চত্বরে যখন পৌঁছল ভারতীয় সাংবাদিকের দল, তখন সেখানে পার্ক করা রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী বিষয়ক শাখা ‘ইউএনএইচসিআর’-এর লোগো আঁকা গাড়ি। দেখে মনে পড়ল, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গেই সাতটি বিদেশি সংগঠনের অর্থে চলত এই রোহিঙ্গা শিবির। যাদের মধ্যে অনেকে করোনা অতিমারির সময় দেশে ফিরে গিয়ে আর এ দিক মাড়ায়নি। তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে। ‘ইউএনএইচসিআর’-এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে আশ্রয়-নেওয়া ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য ব্যয় হয়েছে ৮৮ কোটি ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৭,২০০ কোটি টাকা! সেই ব্যয়ের মাত্রই ৪৪ শতাংশ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সাহায্য আসবে বলে প্রতিশ্রুতি মিলেছে। বাকি আর্থিক বোঝা চেপেছে বাংলাদেশের ঘাড়ে।

‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম’ কর্মসূচি থেকে ক্যাম্পে দু’বেলা খাবার পান, বলছিলেন জিয়াউর রহমান। পরনে জ্যালজ্যালে শার্ট-ট্রাউজার্স। দাঁতে পানের ছোপ। থুতনিতে নুর। থাকতে থাকতে বাঙাল ভাষাটা পরিষ্কার শিখে ফেলেছেন। পেটের টান তো। কিছু দিন আগেও ৪৮ হাজার মানুষের এই ক্যাম্পের (এমন মোট ৩৪টি ক্যাম্প আছে কুতুপালংয়ে। যেটির অফিসের চৌহদ্দির ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, তার পাশের শিবিরের বাসিন্দার সংখ্যা ৫৪ হাজার) একটি স্বাস্থ্যশিবিরে কাজ করছিলেন। আপাতত কর্মহীন। জিয়াউর বলছিলেন, মায়ানমারের রাখাইন (আদিযুগের আরাকান) থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে তিন দিন, তিন রাত হেঁটেছেন। সঙ্গে ছিলেন মা আর দুই বোন।

জিয়াউরের পাশে দাঁড়ানো আরও সারি সারি মুখ। তাঁরা অভ্যস্ত গলায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। স্মার্টফোনের ক্যামেরার সামনে নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়ে পড়েন। প্রশ্ন করি, আর ফিরতে চান না মায়ানমারে? ছিন্নমূল যুবক মুখগুলো পরস্পরের দিকে তাকায়। তার পরে এ পাশে-ও পাশে যন্ত্রের মতো মাথা নাড়ে। সেই মস্তক সঞ্চালনে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বোঝা যায় না। শুধু বোঝা যায়, তাঁদের পায়ের তলায় শিকড় গজিয়ে গিয়েছে। সেই শিকড় কতটা গভীরে প্রোথিত তাঁরাই জানেন। তাঁদের কোনও পরিচিতি নেই। তাঁদের কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই। রোহিঙ্গারা চান, নিজেদের মূলস্রোতে মিশিয়ে ফেলতে। মূলস্রোত আবার তা চায় না।

কতক্ষণ ছিলাম কুতুপালংয়ে? মেরেকেটে আধ ঘণ্টা। ওইটুকু সময়ে কি বোঝা যায় ১১ লক্ষ (মতান্তরে সাড়ে ১২ লক্ষ) মানুষের যাপন? যায় না। শুধু জেগে থাকে সফ্‌ট ড্রিঙ্কসের বোতল আঁকড়ে রাস্তা পেরোতে থাকা গাড়ির কনভয়ের সামনে উদাসীন শিশু। রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি।

(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement