প্রতীকী ছবি।
আমরা একটা সামাজিক যুদ্ধে ঢুকে পড়েছি। বিভিন্ন বর্ণ ও বিভিন্ন স্তরের মধ্যে এই যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধে রূপান্তরিত করার চেষ্টাও অন্তহীন। গত কুড়ি বছর ধরে এই সামাজিক যুদ্ধ বাংলায় চলেছে। বামফ্রন্ট শাসনে কিছু আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সংস্কারের ভিত্তিতে যে সামাজিক ভারসাম্য ও শান্তি এসেছিল, তা ২০০১ থেকে ভাঙতে শুরু করে। ২০০৫-০৬ থেকে ভাঙন ত্বরান্বিত হয়। শিল্পায়নের জন্য বা তার নামে কৃষকের জমি কেড়ে নেওয়া, খাদ্য গণবণ্টন ব্যবস্থার সঙ্কট, দলীয় একাধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও রাজ্যের অর্থনৈতিক অধোগতি সামাজিক যুদ্ধের পটভূমি রূপে কাজ করেছে।
গত দশ বছরে রাজ্যে জনবাদী প্রশাসন সঙ্কটের কিছু দিক সামলেছে। কিছু ক্ষেত্রে লক্ষণীয় উন্নতি হয়েছে। জনসমাবেশের চরিত্র পাল্টেছে। অধোবর্গ ও নারীদের উপস্থিতি জনবাদী রাজনীতিতে চোখে পড়ার মতো। এই প্রশাসন ও রাজনীতির চরিত্র, পদ্ধতি ও লক্ষ্য বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক স্বতন্ত্র স্থান নিয়েছে। অন্য অনেক জিনিসের মতো এই বিশেষ রাজনীতি ও প্রশাসনের ভিত্তিও অতীতের মধ্যে। ভাল-মন্দ মিলিয়ে বামফ্রন্ট শাসনের বেশ কিছু দিক জনবাদী রাজনীতিতে আছে। এর কোনও বিকল্প বাংলার রাজনৈতিক প্রবাহে আজ পাওয়া মুশকিল। নানা রাজনৈতিক শক্তি জনবাদীদের অনুকরণ করবে। ভোটের ফল যা-ই হোক, রাজ্য রাজনীতিতে জনবাদীদের স্বাক্ষর অনেক দিন থেকে যাবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, জনপ্রিয়তাবাদী বা জনবাদী রাজনীতির এত যদি আধিপত্য, তবে এই নির্বাচনের এমন তীব্রতা কেন? সামাজিক যুদ্ধ কেন এমন শ্বাসরোধকর পরিবেশ সৃষ্টি করছে? সামাজিক যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কি আর বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির হাতে রয়েছে, না কি সামাজিক সংঘর্ষ তার নিজস্ব তীব্রতা অর্জন করছে সংঘর্ষের নিজস্ব বিধিতে?
স্পষ্টত, নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক শক্তি, রাষ্ট্রশক্তি ও সমস্ত দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদী শক্তি বাংলা দখলে উদ্যত। হিন্দু ধর্মের আবেদন ও তাকে সর্বগামী করার লক্ষ্যে উন্নয়নের প্রলোভন, এই নির্বাচনের এক বৈশিষ্ট্য। তার সঙ্গে যুক্ত ভারতের সামগ্রিক পুনর্গঠনের প্রকল্প: উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বাংলাদেশ, নেপাল, বঙ্গোপসাগর— সমস্তকেই সেই পুনর্গঠনের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার প্রকল্প। বৃহৎ শক্তিরূপে ভারতের উত্থানে কাঁটা হল এই স্বপ্নের শরিক হতে পশ্চিমবঙ্গের অনীহা, জনবাদী অর্থনীতির অন্য অভিমুখ ও সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রধানতম সমালোচক রূপে বাংলার জনবাদীদের উত্থান। এই প্রতিরোধকে জটিলতর করেছে পশ্চিমবঙ্গের সমাজের ভঙ্গুর অবস্থা। বিভিন্ন শ্রেণি, গোষ্ঠী, বর্ণ ও অঞ্চলে বিভক্ত বাংলা ‘বাঙালি এক হউক’ আবেদনে পুরনো পথে সাড়া দেবে না। এই আবেদনকে নতুন রূপ দিতে হবে। অন্য দিকে, সমাজের এই বিভাজনরেখাগুলি নয়া উদারনীতিবাদী আগ্রাসনের রণনীতিতে বিপুল ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং হবে।
এই নির্বাচন প্রধানত দু’পক্ষের সংগ্রামের রূপ নিলেও, যাকে আজ তৃতীয় বিকল্প বলা হচ্ছে তা বাঙালি জনসমাজের এই ভঙ্গুর দশার প্রতিফলন। দুটো কথা আজ প্রায় আপ্তবাক্যে পরিণত হয়েছে। এক, বাংলার গৌরব হৃত। কেউ বলছেন, গত দশ বছরের কুশাসনের ফল। কেউ বলছেন, এই দুর্দশা বহু কালের। দুই, বাঙালি সমাজের সামনে ধূসর ভবিষ্যৎ। কাগজে, টিভির পর্দায়, বক্তৃতায়, বিবৃতিতে, ইস্তাহারে অজস্র বার উচ্চারিত হতে হতে এমন এক অবস্থা হয়েছে, যে মনে হচ্ছে এই দুই আপাত-সত্যই এ-বার সংগ্রামের ভিত্তি। ২০১৬’য় বিরোধীদের রণধ্বনি ছিল: গণতন্ত্র ফেরাও। এ-বারের ধ্বনি: হৃতগৌরব বাংলাকে উদ্ধার করতে হবে।
হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে নয়া উদারনীতিবাদী রাজনীতির প্রধান অভিমুখ হল সমাজের বিভিন্ন বিভাজনরেখাকে নির্দয় ভাবে ব্যবহার করে নতুন নতুন গোষ্ঠী সৃষ্টি করা। পুরনো সম্প্রদায় বা সমাজ বা গোষ্ঠীগুলিকে স্বতন্ত্র বা বিশেষ পরিচিতি দেওয়া। এতে বাজার অর্থনীতির আখেরে লাভ। নাগরিকত্ব নামক অলীক প্রতিশ্রুতিতে বেঁধে মতুয়া সম্প্রদায়কে দলিত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এক গোষ্ঠীতে পরিণত করার চেষ্টা চলছে, যার সঙ্গে বাউরি বাগদি রাজবংশী পৌণ্ড্রক্ষত্রিয় ইত্যাদি সম্প্রদায়ের কমই মিল থাকবে। দলিত ঐক্য অধরা থেকে যাবে। আবার, গ্রামাঞ্চলে মধ্যবর্ণ ক্রমে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকছে।
জনবাদী রাজনীতির একটি কর্তব্য: বিভাজন-অভিমুখী রাজনীতি ও নির্বাচনী কৌশলকে পরাস্ত করা। কাজটা দুরূহ, কারণ সমাজের এই বিভাজনগুলি অনস্বীকার্য। নয়া উদারবাদী অর্থনীতিতে তা আরও প্রকট হবে। অন্য দিকে, জনবাদী রাজনীতিকে সমস্ত দরিদ্রের প্রতি মন দিতে হবে। সাধারণ জনকল্যাণ নীতি এবং বিশেষ সম্প্রদায়, অঞ্চল ইত্যাদির দিকে মনোযোগ, এই দ্বৈত কর্তব্য সহজ নয়। কিন্তু নয়া উদারবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত জনসমাবেশের অন্য পথ নেই।
এই সমস্যাকে পাশ কাটিয়েও যাওয়া যাবে না। সামাজিক ন্যায়ের দাবি যত সাধারণ উন্নতি, সুরক্ষা ও জনকল্যাণের নীতি এবং কর্মসূচির মতো গুরুত্বপূর্ণ হবে, জনসমাবেশ ততই বাঁধা পড়বে প্রশাসনিকতার মোড়কে। বিহারে সামাজিক ন্যায়ের সংগ্রামের ইতিহাস পশ্চিমবঙ্গে ছায়া ফেলবে না, বাংলার রাজনীতি বিশুদ্ধ, নির্মল, বামপন্থী, উদারনৈতিক চিন্তার শ্রীভূমি হয়ে থাকবে, এ-চিন্তার ভিত্তি কোথায়? কাজেই মাহিষ্য তিলি ইত্যাদি সম্প্রদায়ের সংরক্ষণ নমশূদ্রকে নাগরিকত্ব প্রদানের মতোই নয়া উদারবাদী রাজনীতির পাথেয় হবে। জাতিবর্ণের বিবর্তনের এই দ্বৈত চরিত্র জনবাদীরা সামলাতে চেষ্টা করছেন। এর দীর্ঘমেয়াদি ছাপ থাকবেই।
এই সামাজিক যুদ্ধ, যা নির্বাচনে প্রায় গৃহযুদ্ধের রূপ নিয়েছে, সে-যুদ্ধে মধ্যবর্তী অবস্থান এবং স্তরের ভবিতব্য কী? নয়া উদারনীতিবাদী কর্তৃত্ববাদী দক্ষিণপন্থী রাজনীতি এবং অধোবর্গকে কেন্দ্র করে জনকল্যাণকামী জনবাদী রাজনীতির যে চরম দ্বন্দ্ব, তাতে রাজনীতিতে মধ্যস্থান যাঁরা দখল করে আছেন তাঁরা ‘তৃতীয় বিকল্প’ রূপে অধিক পরিচিত। তাঁদের মধ্যবর্তী অবস্থানের নিয়তি কী দাঁড়াবে? জনবাদীরা এই সমস্যাকে লঘু করে দেখেছেন। নির্বাচনী অঙ্কের হিসেবে সাম্প্রতিক নির্বাচনী ইতিহাসে জনবাদীদের সর্বোত্তম ফলও দেখিয়ে দিয়েছে যে, ভোটারদের অন্তত আরও তিন-চার শতাংশ ভোট জনবাদীদের পেতেই হবে রাজনীতিতে আধিপত্যকে দৃঢ় করতে। তার জন্য দরকার কোনও না কোনও ধরনের মোর্চা। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই বামপন্থী নেতৃত্ব এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মোর্চা গঠন না করে এগোনো যাবে না বা অগ্রগতি স্থায়ী হবে না। মোর্চা গঠনের নানা উপায় থাকতে পারে। কিন্তু জনবাদীরা এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসের পুরনো পথে রয়ে গিয়েছেন, মোর্চা গড়তে সমাজ ও রাজনীতির প্রতি যে বহুত্বমূলক দৃষ্টি দরকার, তার প্রমাণ দিতে পারেননি।
কিন্তু ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও জনবাদী আন্দোলন ও সমাবেশ টিকে আছে। এটা কী ভাবে সম্ভব হল? তাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও পদ্ধতি রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় সৃষ্টিতে কী ভাবে সক্ষম হল? একটা উত্তর: বাংলার জনবাদী আন্দোলন ও রাজনীতি নিজেকে অনেকাংশে পুনরুদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছে। নয়া উদারবাদের বিরোধিতা দৃঢ় হয়েছে, প্রশাসনের কলাকৌশল ও পদ্ধতি জনকল্যাণমুখী হয়েছে। জনসাধারণ সম্পর্কে রাজনৈতিক ধারণা আগের চেয়ে স্বচ্ছ হয়েছে। জনবাদী সমাবেশের নবীকরণের সাংগঠনিক দিকও লক্ষণীয়। পঞ্চাশের উপর বিধানসভার সদস্য এ বার টিকিট পাননি। ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে নতুন জনপ্রতিনিধি বাছার ক্ষেত্রে। সে ঝাড়গ্রামে হোক বা বলাগড়ে। অন্যান্য দলের পুরনো ইতিহাস তুলনা হিসেবে স্মরণীয়। কংগ্রেসের কামরাজ পরিকল্পনা, কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন, ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্ব বদল— এই সবই ছিল দলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু জনবাদী সংগঠনের নানা পরিবর্তন হয়েছে জনবাদী পদ্ধতিতে। যেন নবীকরণের নাট্যচিত্রে কুশীলবরাও জনসাধারণের নানা অংশ। বিপুল সমর্থককুল, অসংখ্য কর্মী, অথচ নির্বাচিত কোনও দলীয় কাঠামো নেই; কিন্তু বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে, ছোট শহরে, সর্বত্র যেন সুনির্দিষ্ট অবয়বহীন আন্দোলন ও সমাবেশ, এক কাঙ্ক্ষিত প্রশাসনকে ঘিরে।
প্রশ্ন থেকে যায়, প্রশাসনিক ক্ষমতায় না থাকলে জনবাদী সমাবেশের অবয়ব কেমন হবে? পথকে ঘিরে যে রাজনীতি, সে কী ভাবে পথে ফিরবে? প্রশাসনে ফিরলেও জনবাদীরা কি নয়া উদারনীতিবাদী আগ্রাসনকে ক্রমাগত প্রতিহত করতে পারবে? মধ্যবর্তী শক্তিগুলিকে স্বপক্ষে আনতে পারবে? এক কথায়, সামাজিক যুদ্ধ চলবে। চলবে রাজনৈতিক সংঘাত। অধোবর্গ বনাম নয়া উদারনৈতিক শক্তির দ্বন্দ্ব তীব্রতর হবে। সমাজের নানা অংশের আচরণ নিজ নিজ স্বার্থে নির্ধারিত হবে। এই অর্থে আমরা এক অঘোষিত গৃহযুদ্ধে প্রবেশ করেছি। স্থির করতে হবে আমরা অধোবর্গের রাজনীতি ও সমাবেশের উপর ভরসা রাখব কি না।
সংযোজন: এই লেখা হয়েছিল উত্তরবঙ্গে শীতলখুচির দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার দু’দিন আগে। বাংলায় যাঁরা আছেন, তাঁরা জানেন বাংলার বাতাসে আজ বারুদের গন্ধ।