—ফাইল চিত্র।
যে অর্থে ইংল্যান্ড ইংরেজদের দেশ, ফ্রান্স ফরাসিদের দেশ, ঠিক সেই অর্থেই প্যালেস্টাইন হল আরবদের দেশ। ইহুদিদের এই ভাবে আরবদের উপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় ও অমানবিক (রং অ্যান্ড ইনহিউম্যান)। প্যালেস্টাইনে যা ঘটছে আজ, কোনও নৈতিকতার মাপকাঠি দিয়ে একে সমর্থন করা যায় না (ক্যানট বি জাস্টিফায়েড বাই এনি মরাল কোড অব কনডাক্ট)।— বাক্যগুলি মহাত্মা গান্ধীর, ১৯৩৮ সালের নভেম্বরে লেখা, হরিজন পত্রিকায়। এমন এক-একটা বাক্য বা অনুচ্ছেদ লিখতেন তিনি যা আলোর মতো পথ বিছিয়ে দিতে পারত। স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র ও ভারতীয় নাগরিকের বিবেক কোন দিকে ঝুঁকে থাকবে, তার একটা দিকনির্দেশ রইল এই কথায়।
আর আজ? প্যালেস্টাইনের উপর ইজ়রায়েলের অবর্ণনীয় নৃশংসতার সামনে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব আনা তো দূরস্থান, ‘যুদ্ধবিরতি’র প্রস্তাবটুকুতেও ভারত সম্মতির ভোট দিতে চাইল না। না, কোনও ‘মরাল কোড অব কনডাক্ট’-এর প্রতি এ দেশের আর কোনও দায় বা দায়িত্ব নেই। বিবেকবান ভারতীয় নাগরিকের মাথা আজ নিচু। লজ্জায়, আত্মধিক্কারে।
এখন বিরাট এক সঙ্কটের সামনে দাঁড়িয়ে এই ভারতীয় নাগরিকরা— রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ এড়িয়ে যাঁদের বলতে পারি— উদার গণতন্ত্র, নাগরিক স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় সহিষ্ণুতার সমর্থক। আজকের মোদীয় ভারতে এঁরা ‘লিবারাল’ বলে ঘৃণিত। বাছবিচার ছাড়াই এঁদের এক-একটি বন্ধনীর মধ্যে ঢোকানো হয়েছে: ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’, ‘আরবান নকশাল’। সাম্প্রতিক হামাস-ইজ়রায়েল সংঘর্ষ এঁদের আরও বেশি ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বানাতে চাইছে, কেননা প্যালেস্টাইনের অধিকার মেনে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধতা করাটা নাকি আসলে সন্ত্রাসগোষ্ঠী হামাসকেই সমর্থন করা, ঘুরপথে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের পাশে দাঁড়ানো— অর্থাৎ ‘ভারতদ্রোহে’ স্বাক্ষর করা।
কঠিন পরিস্থিতি। অনস্বীকার্য, ইসলামি সন্ত্রাসের অন্যতম প্রিয় টার্গেট ভারত। তাই এক জাতের জাতীয়তাবাদের চোখে, আজ ইজ়রায়েলকে সমর্থন না করার মানে হামাসকে সমর্থন করা, ইসলামি সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেওয়া। এই সমীকরণ প্রচারে ব্যস্ত হয়েছে কুখ্যাত ‘আইটি সেল’, আরও এক বার ‘লিবারাল’দের ‘দেশদ্রোহিতা’ প্রমাণের সুযোগ এসেছে। সমীকরণটির মধ্যে রয়েছে অসংখ্য গোলমাল। কিন্তু তা বলার আগে দুটো দৃশ্য মনে করে নিই। দৃশ্য এক: বৃদ্ধ ইজ়রায়েলি দম্পতিকে টেনেহিঁচড়ে পণবন্দি হিসাবে আলাদা গাড়িতে ওঠানো হচ্ছে। দু‘জনে আর পরস্পরকে দেখতে পাবেন না, এই আকস্মিক বাস্তবের সামনে পড়ে পরস্পরের দিকে বিস্ফারিত তাকিয়ে, চেঁচিয়ে কেবল মনে করাচ্ছেন ওষুধ খাওয়ার কথাটা। দৃশ্য দুই: চার-পাঁচ বছরের প্যালেস্টাইনি শিশু দাঁড়িয়ে স্বজনদেহ-স্তূপের মধ্যে। উদ্ধারকারীরা নাম জিজ্ঞেস করলেও সে ফ্যালফ্যালে বাক্রুদ্ধ। ট্রমা তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে নিজের নামটুকুও।
মানবই এই ভীষণতায় উৎক্ষিপ্ত করতে পারে মানবজীবনকে। দেখেশুনে, আমরা রাজনীতি করি।
যা বলছিলাম। ইজ়রায়েলকে সমর্থন না করার অর্থ হামাসকে সমর্থন— এই সমীকরণের মধ্যে একটা (ইচ্ছাকৃত? বিকৃত?) সরলীকরণ আছে। আসলে কিন্তু ভারতীয় লিবারালদের অনেকেই ইজ়রায়েল ও হামাস দুই পক্ষের আক্রমণেই শিহরিত। তার মধ্যেও ইজ়রায়েলের অন্যায়টাকে তাঁরা ‘বেশি’ মনে করেন, কেননা একটা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, আর একটা আধুনিকতম অস্ত্র-অর্থ-সমৃদ্ধ পরমাণুশক্তিধর রাষ্ট্রকে সমান করে দেখা অসম্ভব। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সন্ত্রাস চালাতেই জন্ম নিয়েছে, তাই তারা ভয়ের বস্তু, ঘৃণ্য। কিন্তু কোনও সবল রাষ্ট্র যদি নিজেই সন্ত্রাসী হয়ে উঠে নিরস্ত্র অসহায় নিরপরাধ মানুষের নিধনযজ্ঞে মাতে, তারা ঘৃণ্যতর। নোম চমস্কি আমাদের ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন কেন ‘খ্রিস্টান জ়ায়নিজ়ম’ বলে একটি কয়েক শতকের পুরনো ধারা এখন দক্ষিণবাদী পশ্চিম গোলার্ধে ‘জ্যু জ়ায়নিজ়ম’-এর বিরাট সহকারী: প্যালেস্টাইনের উপর ইজ়রায়েলের আক্রমণকে পরম পবিত্র কর্তব্য বলে যারা মনে করে। বোঝা সম্ভব কেন যে-সব দেশ নিজেরাই আন্তর্জাতিক আইনকানুন তৈরি করে, তারা নিজেরাই অতি অনায়াসে গাজ়ায় ভয়ঙ্কর এই মানবাধিকার ভঙ্গ-যজ্ঞে ইন্ধনকারী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অন্যতম নিকৃষ্ট এই ‘ওয়র ক্রাইম’ বা যুদ্ধাপরাধকে ‘চূড়ান্ত অন্যায়’ বলা ছাড়া আর কোনও পথ কি থাকতে পারে কোনও গণতন্ত্রবিশ্বাসী উদারবাদীর পক্ষে, যাঁরা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে নিবেদিত নন, যাঁরা কোনও রাজনৈতিক অন্ধদর্শনে সমাহিত নন? প্রশ্ন না তুলে কি উপায় আছে, যখন হামাসের পিছনে প্যালেস্টাইনের সব মানুষ দাঁড়িয়ে নেই— হামাস কেবল একটি চরমপন্থী দল যারা মানুষকে ঢাল বানিয়ে তাদের পিছনে লুকিয়ে পড়তে সচেষ্ট— কেন হামাসকে শিক্ষা দেওয়ার নামে তাদের উপর নেমে আসবে ইজ়রায়েলের মৃত্যুবোমা? কেন গাজ়ায় জল, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হবে? কেন হাসপাতালে অসুস্থ অথর্ব শিশুযুবাবৃদ্ধদের ছিন্নভিন্ন করা হবে (ছবি)? কী বলে আন্তর্জাতিক যুদ্ধের নিয়মনীতি— সন্ত্রাসীরা যে সব নিরপরাধ আবালবৃদ্ধবনিতাকে ‘মানবঢাল’ করতে চাইছে, সন্ত্রাসবিরোধিতার নামে তাদেরই ড্রোনাঘাতে উড়িয়ে দাও?
রাজনৈতিক মতান্ধরা অবশ্য সন্ত্রাসের পক্ষ নিয়েই কথা বলছেন, কেউ এ দিকের, কেউ ও দিকের। কেউ দক্ষিণে, কেউ বামে। দক্ষিণের অন্ধরা বলছেন, হামাসের হানা যখন হয়েছে, ইজ়রায়েলের কি আত্মরক্ষার অধিকার নেই? উত্তর একটাই। আত্মরক্ষার অধিকার সকলেরই আছে, ইজরায়েলেরও, প্যালেস্টাইনেরও। ইজ়রায়েলের অধিকার মানতে আমরা প্রস্তুত, প্যালেস্টাইনের অধিকার মানতে নই? দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাসের পর সন্ত্রাসবাদীদের দেশটাকে গুঁড়িয়ে না দিয়ে আত্মরক্ষাকারী রাষ্ট্র অন্য পথও নিতে পারে, মনমোহন সিংহের ভারত দৃষ্টান্ত। লস্কর-ই-তইবার আক্রমণের পর পাকিস্তানের উপর বোমা ফেলা হয়নি। কেননা, সেই ভারত জানত, কোনও দেশের সাধারণ নাগরিক আর সন্ত্রাসবাদীদের এক করে দেখা যায় না। তৃতীয়ত, অন্ধদের মধ্যে যাঁরা ধর্মান্ধ, তাঁরা ভাবেন আরবি মুসলিমদের মেরে তাড়িয়ে জায়গা দিতে হবে ইহুদিদের। এঁদের কেবল গান্ধীর কথাটাই আবার বলা যায়: ভারতভূমি ভারতীয়দের দেশ হলে প্যালেস্টাইনিদের দেশও আরবভূমি।
চতুর্থত, এঁরা ইজ়রায়েল ও ভারতের সাদৃশ্য খুঁজে পান, ইসলামি সন্ত্রাস দুই দেশেরই শত্রু বলে। সঙ্কটটা বাস্তব হলেও ‘সাদৃশ্য’টা অবাস্তব। ‘ডিকলোনাইজ়ড’ স্বাধীন ভারত নিজের মানচিত্রের বাইরে কোথাও কাউকে উৎখাত করে নিজেকে সেখানে প্রতিস্থাপিত করেনি। আর ইজ়রায়েল— নিজেই উপনিবেশ স্থাপনকারী।
বামবাদী অন্ধরাও কম সমস্যাজনক নন। ইজ়রায়েল-বিরোধিতা করতে গিয়ে হামাসের দায়িত্ব এঁরা কমিয়ে দেখেন, বা দেখেনই না। অথচ যে অভূতপূর্ব আক্রমণে ছারখার প্যালেস্টাইন, সেটা ঘটবে জেনেই কি হামাস ফন্দি ফাঁদেনি? প্যালেস্টাইনিদের মানবঢাল করে নিজেরা পিছনে লুকায়নি? এই ভয়াবহ ঘটনার বড় অংশীদার তারাও।
কেউ বলছেন: হামাসের সন্ত্রাস আর প্যালেস্টাইন সঙ্কটকে ‘ডি-হাইফেনেট’ (আলাদা) করা যায় না, প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নির্যাতনই হামাসকে তৈরি করেছে। প্রশ্ন হল, আমরা কি সত্যিই পরিপ্রেক্ষিত/হেতু (কনটেক্সট) দিয়ে লক্ষ্য/পথকে (মিনস) ব্যাখ্যা করতে পারি? তবে তো কেউ বলতে পারেন, কাশ্মীর সন্ত্রাসও সমর্থনীয়, কেননা সে হানারও একটা ‘প্রেক্ষিত’ আছেই। উত্তর একটাই: না। হিংসা— বিশেষত নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে হিংসা— পরিত্যাজ্য, সব সময়ে, সব প্রেক্ষিতে।
আসলে, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সংখ্যালঘুদের অন্যায়কে ‘ছোট’ করে দেখার যে বামঘেঁষা প্রবণতা, তা ধর্মান্ধতার মতোই বিপজ্জনক। কোনও সন্ত্রাসবাদী মুসলমান হলেও তিনি নিকৃষ্ট অপরাধে অপরাধী। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে অন্ধ বা দুর্বল হলে শেষ পর্যন্ত জয় হয় উল্টো দিকের ধর্মান্ধেরই— ভারতে তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। কেরলে ইজ়রায়েলবিরোধী সভায় হামাসের প্রাক্তন নেতাকে ডেকে এনে বক্তৃতা দেওয়ানো ঠিক হয়েছে কি না, তা এই প্রসঙ্গেই বিচার্য। উল্টো দিকে, সনিয়া গান্ধী যে ভাবে স্পষ্টাস্পষ্টি হামাসের নিন্দা করে ইজ়রায়েলের বাড়াবাড়িকে তুলোধোনা করেছেন, ভারতের সরকারি অবস্থানকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলেছেন— তার মধ্যে একটা সুচিন্তিত ভারসাম্য ও উদার (লিবারাল) মূল্যবোধ দেখতে পাই।
শেষে একটা কথা। বাম, দক্ষিণ দুই দিকেই একটা চেষ্টা চলছে প্যালেস্টাইনের সঙ্কটটিকে মুসলিমবিরোধিতার আতশকাচ দিয়ে বিচারের। এর চেয়ে ভুল আর বিপজ্জনক কিছু হতে পারে না। এই সঙ্কট ধর্মের নয়, রাজনীতির। একশো চার বছর আগে খিলাফত প্রশ্ন বিশ্বময় ঝড় তুলেছিল, যা ছিল প্রধানত ধর্মীয় আন্দোলন। আর আজ, বিশ্বের মুসলিম সমাজ ও সহমর্মীরা যা-ই বলুন, প্যালেস্টাইন কিন্তু প্রথমত ও প্রধানত এক রাজনৈতিক সংগ্রাম, যাতে মিশে আছে ধর্ম-অনুষঙ্গ। যে সব ইসলামি দেশ প্যালেস্টাইনের পূর্ণ সমর্থক নয়, তাদের দিকে তাকালে বিষয়টা বোঝা সহজ। মিশর এত দিন তার সীমান্ত বন্ধ রেখেছিল কেন? সৌদি আরব কেন নীরব ছিল? রাজনীতি-কূটনীতির ছক মেনেই নয় কি?
এই ছকটাকে এলোমেলো করে দিতেই হয়তো ধর্মের তীব্র জিগির ওঠানোর এত চেষ্টা চলে, আর বামে-দক্ষিণে অনেকেই তাতে মহা-আপ্লুত হয়ে পড়েন। এর মধ্যে একটাই আলোর পথ, যার দিকে গান্ধী নির্দেশ করেছিলেন: মানবতা। যে মানবতা বলে, প্যালেস্টাইন দেশটায় অন্যরা থাকতেই পারেন, কিন্তু প্যালেস্টাইনবাসীর অধিকার তাঁরা হরণ করতে পারেন না। যুদ্ধকালেও না। শান্তিকালেও না।