ব্যাঙ্ক যাতে কোনও ভাবেই দেউলিয়া না হয়।
অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন বেন বার্নানকে, ডগলাস ডায়মন্ড এবং ফিলিপ ডিবভিগ— ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক সঙ্কট বিষয়ে তাঁদের মৌলিক গবেষণার জন্য। নোবেল কমিটি জানিয়েছে যে, অর্থব্যবস্থায়, বিশেষ করে আর্থিক সঙ্কটের সময়ে, ব্যাঙ্কের ভূমিকা কী, এ বিষয়টি আরও ভাল ভাবে বুঝতে এঁদের গবেষণা আমাদের সাহায্য করেছে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বার্নানকে-ডায়মন্ড-ডিবভিগের স্বতন্ত্র কিন্তু সমগোত্রীয় গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল আমাদের বার বার সাবধান করেছে যে, ব্যাঙ্ক যাতে কোনও ভাবেই দেউলিয়া না হয়।
১৯৮৩-তে জার্নাল অব পলিটিক্যাল ইকনমি-তে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ডায়মন্ড ও ডিবভিগ ব্যাখ্যা করেছিলেন, কেন ব্যাঙ্কের দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বরাবরই প্রবল। আসলে ব্যাঙ্কের সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যেই তার মারণ-বীজ লুকিয়ে থাকে।
আধুনিক ব্যাঙ্ক গ্রাহকদের নানা ধরনের পরিষেবা দিয়ে থাকে। তবে ব্যাঙ্কের মূল ব্যবসা ঋণ দেওয়া-নেওয়ার। ব্যাঙ্কের কাছে আমরা সঞ্চয় গচ্ছিত রাখি। তার বিনিময়ে ব্যাঙ্ক আমাদের একটি পূর্ব-ঘোষিত কিন্তু সময়ে-সময়ে পরিবর্তনযোগ্য হারে সুদ দেয়। গ্রাহকরা চাইলে তাঁদের সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে যে কোনও সময় আমানত তুলতে পারেন। আমানতকারীদের সুদ মেটাতে গেলে ব্যাঙ্কের আয় চাই। সেই আয় আসে ব্যাঙ্ক ঋণ থেকে। লগ্নিকারীদের মূলধনের প্রধান উৎস হচ্ছে ব্যাঙ্ক থেকে নির্দিষ্ট সুদের বিনিময়ে ঋণ। আমরা বাড়ি-গাড়ি কিনতে, শিক্ষার প্রয়োজনে বা অন্য কোনও কারণেও ধার নিই।
এই সহজ গল্পে একটা প্রগাঢ় সমস্যা রয়েছে। ব্যাঙ্কের কাছে গচ্ছিত আমানত হচ্ছে ব্যাঙ্কের লায়াবিলিটি বা দায়। যখনই গ্রাহক এসে তাঁর আমানতের একাংশ বা পুরোটাই তুলতে চাইবেন, ব্যাঙ্ককে তৎক্ষণাৎ তাঁকে তাঁর ইচ্ছামতো টাকা দিতে হবে। কিন্তু ঋণগ্রহীতাকে ব্যাঙ্ক নির্দিষ্ট সময়ের আগে ঋণ ফেরত দেওয়ার কথা বলতে পারে না। তা হলে দেখা যাচ্ছে, ব্যাঙ্কের যা সম্পদ (দীর্ঘমেয়াদে প্রদত্ত ঋণ), তা সহজে এবং সহসা নগদে পাল্টে দেওয়া যায় না। অথচ ব্যাঙ্কের লায়াবিলিটি বা দায় পুরোটাই ‘লিকুইড’, মানে যে কোনও সময়ে নগদে সম্পূর্ণ পরিবর্তনযোগ্য। ব্যবসার ধরনটাই এমন হওয়ার ফলে ব্যাঙ্কের সামনে বরাবর দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। কোনও এক সকালে যদি সব আমানতকারী তাঁদের গচ্ছিত ধনরাশি ফেরত চান, পৃথিবীর সেরা ব্যাঙ্কেও লালবাতি জ্বলবে। কারণ, গ্রাহকদের জমা রাখা আমানত থেকেই তো ব্যাঙ্ক ঋণ দিয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদের সে সব ঋণ তো চাওয়ামাত্রই ফেরত পাওয়া যাবে না। তা হলে উপায়?
ডায়মন্ড-ডিবভিগের উল্লিখিত পেপারে এবং ডায়মন্ড একক ভাবে ২০০৭ সালে ইকনমিক কোয়ার্টারলি-তে প্রকাশিত ‘ব্যাঙ্কস অ্যান্ড লিকুইডিটি ক্রিয়েশন: আ সিম্পল এক্সপোজ়িশন অব দ্য ডায়মন্ড-ডিবভিগ মডেল’ শিরোনামের প্রবন্ধে এই সিদ্ধান্তেই এসেছিলেন যে, সরকারের আমানত বিমা প্রকল্প ব্যাঙ্ককে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারে। গ্রাহকরা যদি জানেন যে, অমুক ব্যাঙ্ক কখনও ফেল করতে পারে না, তা হলে সেই ব্যাঙ্ক সত্যিই কখনও দেউলিয়া হবে না। প্রশ্ন হল, সেই বিশ্বাস আসবে কী করে? এর সহজ রাস্তা হচ্ছে আমানত বিমার ভরসা। অথবা, সরকার নিজেই যদি সেই ভরসা দেয়। ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্তকরণের পিছনে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সেই ভরসার জায়গা তৈরি করা।
ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হলে অর্থনীতিতে কতটা কু-প্রভাব পড়ে, এ নিয়ে বার্নানকেরা বিস্তর লেখালিখি করেছেন। ডায়মন্ড-ডিবভিগ মডেল যে বছর বেরোল, সেই ১৯৮৩ সালেই আমেরিকান ইকনমিক রিভিউ জার্নালে বার্নানকে ‘নন-মনিটরি এফেক্টস অব দ্য ফাইনানশিয়াল ক্রাইসিস ইন দ্য প্রপাগেশন অব দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এর ঠিক কুড়ি বছর আগে লেখা মিল্টন ফ্রিডম্যান ও অ্যানা শোয়ার্টজ়-এর গ্রন্থ আ মনিটরি হিস্ট্রি অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস, ১৮৬৭-১৯৬০-এর পরিপূরক গবেষণা হিসেবে বার্নানকের লেখায় আর্থিক সঙ্কটে ব্যাঙ্কের ভূমিকার কথা সবিস্তার ও গভীরতর ভাবে উঠে আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক যদি তার নিজস্ব বোধ ও বুদ্ধিমতো মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে পারে, তাতে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিও তাদের সম্পদ ও দায়ের মধ্যে একটি সুষম ভারসাম্যের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এমন আদর্শ পরিস্থিতিতে আর্থিক সঙ্কট বা মন্দার মতো ভয়াবহতা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যায়। এই কথাগুলোই উর্জিত পটেল ও বিরল আচার্যরা সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করে বিফল হন। রঘুরাম রাজন দীর্ঘকাল ধারাবাহিক ভাবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীন সত্তার সমর্থনে বলে আসছেন। তিনি ডগলাস ডায়মন্ডের সঙ্গে বেশ কিছু সমগোত্রীয় গবেষণাপত্রে সহলেখকও বটে! কাজেই কেউ বলতেই পারেন যে, এই নোবেল প্রতীকী অর্থে হলেও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের স্ব-শাসনের পক্ষেই বার্তা দিচ্ছে।
অর্থনীতি বিভাগ, কাছাড় কলেজ, শিলচর