অধিকার: গত লোকসভা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের সামনে লাইন। ১৭ এপ্রিল ২০১৯, দিলারাম, দার্জিলিং। —ফাইল চিত্র।
কালিম্পং থেকে দার্জিলিং যাচ্ছিলাম, ভোটের আগে সফরে। তিস্তাবাজারের কাছে যখন, ফোনটা এল। ও প্রান্তে শাসক দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা। কণ্ঠস্বর ভারী। উদ্বেগ কিছুটা ঢেকে রাখতে চেয়েছেন পেশাদার রাজনীতিকের মতো। জানতে চাইলেন, পাহাড় কী বলছে? অর্থাৎ, তাঁর দলের আশা কতটা?
২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের আগে সে এক সন্ধিক্ষণ। তারও দু’বছর আগে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পর থেকে বিমল গুরুং আর পাহাড়ে নেই। নতুন করে উত্থান হয়েছে জিএনএলএফ-এর। গুরুংয়ের মোর্চার দুই নেতা বিনয় তামাং ও অনীত থাপা দল ভেঙে যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। একদা গুরুং-ঘনিষ্ঠ অমর সিংহ রাইকে নিজেদের প্রতীকে প্রার্থী করেছে শাসক দল। লড়াইটা বিনয়দের সামনে রেখে তৃণমূলের সঙ্গে পাহাড়ের বাকি দলগুলির। এবং সম্মিলিত বিরোধীদের প্রার্থী বিজেপির। বস্তুত, বিজেপির প্রচেষ্টাতেই এক ছাতার তলায় চলে এসেছিলেন বিমল গুরুং ও মন ঘিসিংয়ের মতো যুযুধান দুই শক্তি। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল সিপিআরএম-সহ পাহাড়ের বাকি দলগুলি।
রবিবার পাহাড়ে, কী আশ্চর্য, সেই ২০১৯ সালের ছবিটাই যেন নতুন করে ফিরে এল। ব্যতিক্রম অবশ্যই কিছু আছে। যেমন, চার বছর আগে মন ঘিসিংয়ের দলে ছিলেন অজয় এডওয়ার্ড। ২০২১ সালে তিনি গড়েন নতুন ‘হামরো পার্টি’। প্রশ্ন ছিল, তিনি কি বিজেপির হাত ধরবেন? সরাসরি না হলেও অজয় চলে এলেন বিরোধী জোটে। যে বিনয় তামাং ছিলেন ২০১৯ সালে তৃণমূলের প্রচারের পুরোভাগে, তিনিও এখন বিরোধী জোটে।
এ বারে এক দিকে অনীত থাপার প্রজাতান্ত্রিক মোর্চাকে সঙ্গে নিয়ে তৃণমূল, অন্য দিকে বাকি সব বিরোধী। ২০২১ সাল থেকে যে বহুদলীয় ভোটযুদ্ধ দেখছিল পাহাড়, সেটা আবার চলে এল দুই প্রধান শক্তির লড়াইয়ে। ২০২৪ সালে লোকসভা ভোট। তার চূড়ান্ত সলতে পাকানোর কাজ শেষ হয়ে গেল এই ভাবেই।
এই নতুন সমীকরণের দু’টি দিক আছে। একটি হল, পাহাড়ের জোট রাজনীতিতে বিজেপির পুনরুত্থান। এই কাজে তারা বরাবরই দক্ষ। কিন্তু মানতেই হবে যে, পাহাড়ে কাজটা এ বারে কঠিন। ২০২০ সালের অক্টোবরে হঠাৎ অজ্ঞাতবাস থেকে আত্মপ্রকাশ করে বিমল গুরুং বলেছিলেন, বিজেপির সঙ্গে তিনি আর নেই। তিনি তৃণমূলের সঙ্গে জোটের কথা ঘোষণা করেছিলেন একতরফা ভাবেই। গত এক বছরের চেষ্টায় সেই বিমলের সঙ্গে সেতুবন্ধন করতে পেরেছে বিজেপি। তার পরে তাঁকেই কাজে লাগিয়েছে অজয়কে বিরোধী জোটে আনতে। মন ঘিসিংয়ের সঙ্গে মনকষাকষিতেই জিএনএলএফ ছেড়েছিলেন অজয়। ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে দার্জিলিং আসনটি চেয়েছিলেন অজয়। কিন্তু বিজেপির অঙ্গুলিহেলনে সেই আসনে প্রার্থী করা হয় নীরজ জিম্বাকে। অজয় নতুন দল গঠন করে দার্জিলিং পুরসভা জিতে নেন। সেই অজয়ের মান ভাঙিয়ে নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি। যদিও মন আর অজয়ের দ্বন্দ্ব এখনও লেগে রয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত বিরোধীরা আশাবাদী, সেই সমস্যা মিটিয়ে নেওয়া যাবে।
নিজেদের পুরনো সঙ্গী সিপিআরএম বা জিএনএলএফ-এর সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হতে দেয়নি গেরুয়া শিবির। সামনে রাখা হল গোর্খাদের স্বাভিমানের বিষয়টি, যা নিয়ে বিজেপিরই মদতে পুষ্ট একটি সংগঠন নিয়মিত কর্মসূচি করে দিল্লিতে। তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতেই সেই সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বিমল।
এই মুদ্রার একটি উল্টো পিঠও রয়েছে। সেই পিঠে রয়েছে শাসক দল তৃণমূল। পাহাড় নিয়ে বরাবরই তাদের একরোখা মনোভাব রয়েছে। তার কিছুটা দেখা গিয়েছিল ২০১৭ সালে, অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সামলানোর সময়ে। তার চার বছর পরে, বিধানসভা ভোট থেকেই কিন্তু হাওয়া বিজেপির বিপরীতে ঘুরতে শুরু করে। ত্রিমুখী লড়াইয়ে ভোট কাটাকাটি সত্ত্বেও বিজেপি জোট পাহাড়ের একটি আসন হারায়। তার পরে দার্জিলিং পুরসভায় অজয় এবং শেষে জিটিএ-তে অনীতের উদয়। বিমলও তখন স্তিমিত।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন কয়েকটি চোখে পড়ার মতো অবস্থান নেয় তৃণমূল। প্রথমত, বিমল নিজে থেকে তৃণমূলের সঙ্গে জোট ঘোষণা করলেও তাঁকে কোনও দিন খুব কাছে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করেননি তৃণমূল নেতৃত্ব। বিমলের প্রত্যাবর্তনে মূল কারিগর ছিল আইপ্যাক। কিন্তু বিভিন্ন কারণে যখন বিমল ক্ষুব্ধ, তা নিয়ে আলোচনার রাস্তা তৈরির চেষ্টা হয়েছিল কি? যাঁর সঙ্গে জোট করে তৃণমূল পুরভোটে লড়েছে, তাঁর কথা শোনার সময় হয়েছিল কি কারও? ঠিক সেই সময়েই বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তা যান বিমলের কাছে। এর পর মোর্চা নেতার সুখে-দুঃখে বিজেপি নেতাদেরই তাঁর পাশে দেখা গিয়েছে।
দ্বিতীয় জন অজয় এডওয়ার্ড। দার্জিলিং পুরভোটে জেতার পরে অজয়ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করার বার্তা দেন। কিন্তু সেই হাতও কি ধরতে কেউ এগিয়ে এসেছে? মুখ্যমন্ত্রীর সফরে বা কলকাতায় অনীত থাপা যতটা গুরুত্ব পেতেন, তার কতটা অজয় পেয়েছেন? তার পরে জিটিএ ভোটের শেষে দার্জিলিং পুরসভায় অজয়ের দল ভাঙলেন অনীত। এই ‘কৌশল’-এ তৃণমূলের ইন্ধন ছিল বলেও পাহাড়ে জোর কানাঘুষো। তৃণমূলের এক নেতার নাম এই সূত্রে বার বার উঠে এসেছে। তিনি এখনও মনে করেন, জিটিএ ভোটে যেমন বিরোধীরা একজোট হয়ে কিছু করতে পারেননি, এ বারেও পারবেন না।
কিন্তু পরিস্থিতি কি একই রকম রয়েছে? বিশেষ করে অজয়ের দল ভাঙার পরেও? যে সাধারণ মানুষ এক বছর আগেও অজয় ও অনীতের কথা বলে পাহাড়ে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতেন, তাঁরা কি এখনও একই মনোভাব পোষণ করছেন? পাহাড় রাজনীতির কেউ কেউ একান্ত আলোচনায় বলছেন, সমতল থেকে নেতারা গিয়ে সেখানকার রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব খাটাবেন, এটা এখনও পাহাড় মানতে পারে না। এই বোঝা তৃণমূলকে আবারও বইতে হতে পারে। সেটা শুধু আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটেই নয়, এক বছর পরের লোকসভা ভোটেও।
প্রশ্ন উঠছে, এই দেওয়াল লিখন কি তৃণমূল নেতৃত্ব পড়তে পারলেন না, না কি পড়তে চাইলেন না? নিজেদের ঘনিষ্ঠ কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলেই শুধু সিদ্ধান্ত নিতে চান? তাঁরা কি জানেন, অজয়ের দল ভাঙার ব্যাপারে কতটা আগ্রহী ছিলেন অনীত থাপা? বিমল গুরুংকে এক কথায় খারিজ করে কি আরও একটা ভুল করেনি তৃণমূল?
এটা ঠিকই যে, শেষ কথা বলে মানুষ। এত বছর পরে পাহাড়ের লোকজন পঞ্চায়েত ভোটের সাক্ষী থাকবে। এই ভোট পাহাড়ের গ্রামে গ্রামে উন্নয়নের দরজা খুলে দেবে। সংঘাতদীর্ণ ইতিহাসকে পিছনে ফেলে হয়তো নতুন নেতৃত্ব এগিয়ে আসবেন। একই সঙ্গে এই ভোট আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনেরও দিকনির্দেশক হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে গোর্খাদের ঐক্যকে সামনে রেখে তৈরি মহাজোট যদি তত দিন পর্যন্ত বজায় থাকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে কি এখন থেকেই ‘অ্যাডভান্টেজ’ বিজেপি হয়ে গেল? এর জবাব সব পক্ষের কাছেই জরুরি।