প্রতীকী ছবি।
এখন ভোটের বাজার। সব রাজনৈতিক দলই ভোট চাইতে বেরিয়ে দরাজ হাতে নানান ভাতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে ভরিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু আসল কথাটা বলেছেন এক ভোটার— “শুধু সরকারি ভাতায় জীবন চলে না।” ঠিকই তো। জীবন চালাতে গেলে জুড়ে থাকতে হয় বহমান আর্থিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে। আর কোথাও গিয়ে রাজনৈতিক উচ্চারণে বিকাশ শব্দটি নানা ভাবে উচ্চারিত হলেও, মাইকে কিন্তু ক্রমাগত চলছে সেই ভাতা ভিক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিই।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব জানেন যে বাজার ক্রমাগত হাঁটছে দারিদ্রায়নের পথে। বাড়ছে তুলনামূলক দারিদ্র। তুলনামূলক বললাম এই কারণে যে, বাজারের যা অবস্থা তাতে পকেটের টান ক্রমবর্ধমান। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে সকলেরই। শুধু বিত্তের তরতমে জীবন যাপনের চাপের একটা হেলদোল তো হবেই। উচ্চবিত্তের (অতি বড়লোকরা অবশ্য আরও বড়লোক হয়েছেন। তাই তাঁরা এই আলোচনায় বাদ) এই আঘাত সামলানোর ক্ষমতা নিম্নবিত্তের থেকে স্বাভাবিক ভাবেই বেশি। কিন্তু তার মানে এই নয়, তাঁরাও আহত নন। তাঁদেরও আয়ের উপর কোপ কিন্তু কম পড়েনি।
মাথায় রাখতে হবে, দৈনন্দিন খরচ বাড়ছেই। রান্নার গ্যাসের দাম আকাশ ছোঁয়া। নেট বাজারে কিছু কিনলে আগে যাঁরা মোটর সাইকেলে বাড়িতে জিনিস পৌঁছে দিতেন, তাঁরা অনেকেই এখন পারলে সাইকেলই ব্যবহার করছেন তেলের খরচ বাঁচাতে। চাকরিজীবীর জীবনেও আর্থিক অনিশ্চয়তা ক্রমবর্ধমান। ব্যবসার অবস্থা খারাপ হলে কর্মীদের আয়ের উপর তো কোপ পড়বেই। আর তা পড়ছেও। দরিদ্রের সংখ্যা বাড়লে কিন্তু দেশের বৃদ্ধিও ব্যাহত হবে। আর তা হবে অর্থনীতির সহজ নিয়মেই। সংকুচিত বাজারের কারণেই।
প্রতীকী ছবি।
উল্টোদিকে চারপাশে ভাবটা এমন, আর্থিক বৃদ্ধি হলেই এই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বাজার তার নিজের নিয়মে বৃদ্ধির সুফল দরজায় দরজায় পৌঁছে দেবে। হলে ভালই হত। কিন্তু দুঃখের কথা, তা যে হয় না তা অ্যাডাম স্মিথও বলে গিয়েছিলেন। আর্থিক বৃদ্ধি জরুরি। কিন্তু শুধু আর্থিক বৃদ্ধিতেই অসাম্য দূর করা যায় না।
এটা অনস্বীকার্য, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে কোভিডের ছোবলে বাজার মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কোভিড আবার ফিরছে। এবং সাংঘাতিক ভাবেই। তাই সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরানোর কারণ অবশ্যই তৈরি হয়েছে। কিন্তু ভোটের আবহে সেই সংশয়ের ছাপ এখনও আমরা দেখছি না। কোনও রাজনৈতিক নেতার মুখেই এ নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য দেখা যাচ্ছে না। এটাও অনস্বীকার্য, সংবাদমাধ্যমেও কিন্তু চোখের সামনে আসা কিছু সূচক যা যথেষ্ট ভয়ের তা নিয়েও শিরোনাম খুব একটা চোখে পড়ছে না।
তবে ঘুরে দাঁড়ানোটা জরুরি। এবং এমন ভাবে যাতে, দারিদ্রায়নের গতি আটকানো যায়। গত ২৬ মার্চ, নীতি আয়োগের শীর্ষ আধিকারিক, অমিতাভ কান্তের একটি মন্তব্য এখানে প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, “দারিদ্র বিলির বদলে, আর্থিক বৃদ্ধির সুফলকে ভাগ করে নিতে হবে।” আমরা যদি বিকাশের ব্যাখ্যা হিসাবে এই উচ্চারণকেও মেনে নিই, তা হলেও কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের অর্থনীতি হাঁটছে এর ঠিক উল্টোপথে।
ভারতে বিগত কয়েক বছরে দারিদ্রায়ন গতি পেয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানসম্পদ উন্নয়ন প্রতিবেদন-২০১৯ বলছে, আয়ের সিঁড়িতে প্রথম ১ শতাংশের আয় যখন বৃদ্ধি পেয়েছে ২১৩ শতাংশ, তখন আয়ের নিরিখে সিঁড়ির নীচের ৪০ শতাংশের আয় বেড়েছে মাত্র ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ আয়ের বৈষম্য বাড়ছেই! গতি পাচ্ছে দারিদ্রায়ন। এই তথ্য কিন্তু কোভিডের আগের অর্থনীতিকে ঘিরে।
কোভিডের কল্যাণে এই অধোগতির হার আরও বেড়েছে। পিউ রিসার্চ সংস্থার সমীক্ষা বলছে ভারতে উচ্চবিত্ত উচ্চ মধ্যবিত্ত হয়েছে, উচ্চ মধ্যবিত্ত মধ্যবিত্ত হয়েছে আর নিম্ন মধ্যবিত্ত দরিদ্র হয়েছে (চার্ট)। দরিদ্রের তালিকায় যোগ হয়েছে আরও ৭ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ। এর মূলে অবশ্যই রয়েছে অতিমারি এবং আর্থিক সংকোচন।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
বৃদ্ধির হার কমলে দারিদ্র বাড়ে। কিন্তু বৃদ্ধির হার বাড়লেই যে দারিদ্র হইহই করে কমবে তার কিন্তু কোনও নিশ্চয়তা নেই। নিশ্চয়তা নেই বলেই অমিতাভ কান্ত বলেছেন বৃদ্ধির সুফল ভাগ করে নেওয়ার কথা। মাথায় রাখতে হবে ২০১৬ থেকে ২০১৯ আমাদের দেশের বৃদ্ধির হার ক্রমাগত পড়েছে। আর তার কুফল হিসাবে দারিদ্রও বেড়েছে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। বৃদ্ধির হার বাড়লেই দারিদ্র কমে না তাল মিলিয়ে। তার জন্য প্রয়োজন শুধু মাত্র দেশ জুড়ে ছোট সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধিই নয়, প্রয়োজন এমন ছোট সংস্থা যারা শ্রমনিবিড়। না। এর মানে এই নয় যে উচ্চ প্রযুক্তির সংস্থার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন এমন নীতির যা এই সব ছোট সংস্থাকে এমন ভাবে বড় হতে উত্সাহ দেবে যাতে তারা শ্রমনিবিড় থেকে উচ্চ প্রযুক্তির সংস্থায় বেড়ে উঠতে পারে। ভারত সরকারের প্রাক্তন আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন এই নীতির অভাবকেই দায়ী করেছেন দেশের কর্মসংস্থানহীনতা বৃদ্ধির কারণ হিসাবে। বড় হয়ে ওঠা সংস্থাকে সরবরাহ করার জন্য তৈরি হবে আরও শ্রমনিবিড় ছোট সংস্থা। অব্যাহত থাকবে কর্মসংস্থান তৈরির প্রক্রিয়াও। আর, এতে আরও একটা উপকার হবে। বাজারে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদাও বাড়বে। সেই চাহিদা পূরণে শ্রম দক্ষতাও বাড়বে। আর এখানেও কিন্তু সরকারি নীতির একটা বড় ভূমিকা থাকবে। আর তা হল শিক্ষা পরিকাঠামো তৈরির। ভারতে যার অভাব কিন্তু প্রকট।
উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে, দারিদ্র বাড়লে কিন্তু বৃদ্ধিও ক্ষুণ্ণ হয়। মধ্য ও নিম্নবিত্তের চাহিদাই কিন্তু যে কোনও অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। তাঁদের সংখ্যা এবং চাহিদার চরিত্র যা তাতেই বাজার চলতে থাকে। সহজ উদাহরণের সমস্যা অনেক তবুও বোঝার জন্য গাড়ির চাহিদার দিকে চোখ রাখা যাক। বাজারে মার্সেডিজের তুলনায় কিন্তু ছোট গাড়ির চাহিদা অনেক বেশি। কারণ মার্সেডিজ কিনতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা ছোট গাড়ি কিনতে পারে এমন মানুষের থেকে অনেক কম। সাধারণ সাবান থেকে শুরু করে সাধারণ জীবনের সাধারণ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদাই কিন্তু আর্থিক বৃদ্ধির মূলে। হাজার কোটির সম্পদের অধিকারীর চাহিদায় কিন্তু বৃদ্ধির উনুনে আঁচ দেওয়া যায় না। আর দারিদ্র বাড়লে এই চাহিদাতে টান পড়ে। ব্যাহত হয় বৃদ্ধি।
অমিতাভ কান্ত এটা জানেন বলেই দারিদ্র বিতরণ করার থেকে বৃদ্ধির সুফল ভাগ করে নেওয়ার উপর জোর দিয়েছেন। বাজারের অদৃশ্য হাতের কিন্তু এই শক্তি নেই যাতে বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজের থেকে এই সুফল ভাগ করে দিতে পারে সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়াই। যদি তা হত তা হলে নীতি আয়োগের শীর্ষ আধিকারিককে বৃদ্ধির সুফল ভাগ করে নেওয়ার উপর জোর দিতে হত না। তিনি জোর দিতেন আর্থিক বৃদ্ধির উপর। এবং বাজারের সেই অদৃশ্য হাতটা বাকি কাজ করে দিত। সমস্যা একটাই। ক্রমবর্ধমান অসাম্য সেই নীতির পঙ্গুত্বকেই বড় প্রকট করে তুলছে।