Homophobia

সমকামভীতি: অ-সুখ এবং তার প্রেসক্রিপশন

সমকামভীতি এক ধরণের মানসিকতা, যা অজস্র ভুল ধারণার যোগফল। অনেকেই এই মনোভাব পোষণ করেন। এই মানসিকতার কারণে নিজের অসুবিধা না হলেও অন্যের ক্ষতি হয়। অনেকেই সমপ্রেমীদের পায়ে পা দিয়ে অসম্মান করে ফেলেন।

Advertisement

অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১১:৫৯
Share:

কে কোন ‘কামী’ ভুলে যান! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

‘গে’ বা ‘লেসবিয়ান’ শুনলেই কি আপনি আঁতকে ওঠেন? রেগে যান? কিংবা ‘হোমো’ বলে খিল্লি করেন? ঘাবড়াবেন না। আপনার সম্ভবত ‘সমকামভীতি’ আছে। সমকামভীতি মানে ওঁদের দেখলেই ‘বাবা গো-মা গো’ বলে দৌড় দেওয়া নয়। সে তো ভয়ের একটা প্রকাশ। অন্য রকমের প্রকাশও আছে। আগেভাগেই তেড়ে যাওয়ার মধ্যেও ‘এই বুঝি আক্রান্ত হলাম’-এর ভয় থাকে! বেড়ালের অ্যান্টিসিপেটরি রোঁয়া ফোলানের মতো।

Advertisement

বিষমকামীদের সঙ্গে শত্রুতা করবে বলে কেউ সমকামী হন না। অস্ত্র নামিয়ে ফেলতে পারেন। আপনি সুরক্ষিত। সমকামভীতি কোনও অসুখ নয়। এটি জিনবাহিত নয়। তবে পরিবেশলালিত।

সমকামী মানুষদের মধ্যেও নিজেকে নিয়ে লজ্জা বা ভীতি থাকতেই পারে। অনেকে সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন টের পাওয়ার পর নিজেই নিজেকে ভয় পেয়ে যান। কেউ কেউ সমকামবিরূপ ক্যাম্পে নাম লেখান। ‘হোমোঅ্যাগ্রেসিভ’ মন্তব্য করেন। অন্যকে বোঝাতে চান, আমি সমকামী নই! এ বড় যন্ত্রণার। নিজের থেকে নিজে পালানোর বিফল প্রয়াস।

Advertisement

সমকামভীতি এক ধরণের মানসিকতা, যা অজস্র ভুল ধারণার যোগফল। অনেকেই আপনার মতো এই মনোভাব পোষণ করেন। এই মানসিকতার কারণে নিজের অসুবিধা না হলেও অন্যের ক্ষতি হয়। অনেকেই সমপ্রেমীদের পায়ে পা দিয়ে অসম্মান করে ফেলেন। লোকসমক্ষে, নেটমাধ্যমে সমকামীদের আক্রমণ করতে গিয়ে নিজেদের অজ্ঞতা জাহির করে ফেলেন। অনেক সময় অন্যকে নিয়ে চটুল মজা করতে গিয়ে নিজেরাই হাসির খোরাক হন। যৌনরুচির স্বাধীনতা নিয়ে যে যে সংগঠন কাজ করছে তাদের রোষের মুখে পড়েন। এবং সেই প্রথম টের পান, এঁরাও সংখ্যায় কম নন।

ভিন্ন হলেও এঁরা একা নন।

বিষয়টি এতদূর অবধি গড়াতে দেবেন না। হোমোফোবিয়া থাকলে অবিলম্বে সচেতন হন। অযথা আতঙ্কিত হবেন না। অন্যকে ব্যস্ত করবেন না। গোড়া থেকে সাবধান হলে নিজে নিজেই হোমোফোবিয়া কাটিয়ে ফেলা সম্ভব। প্রথমেই একটা সহজ ‘টার্গেট’ স্থির করুন। না-না, সমকামীদের টার্গেট করার কথা বলছি না। ওটা তো আপনি বিনা চেষ্টাতেই পারছেন। চেষ্টা করে পারতে হবে, এমন একটা টার্গেট ঠিক করার সময় এসেছে।

দু’টি সহজ টার্গেটের উদাহরণ দিচ্ছি—

১। সমকাম, উভকাম, রূপান্তরকাম— মানে যাদের যাদের দেখলেই আপনার গা রি-রি করে, তাদের প্রতি প্রীতির দরকার নেই। তাদের নিয়ে ভীতি রাখবেন না। ঘৃণা রাখবেন না। হোমোনিউট্রাল থাকুন। উদাসীন থাকুন। আক্রমণাত্মক হবেন না।

২। কার কী কামনা, কে কোন ‘কামী’ ভুলে যান। অন্য মানুষকে বা তাঁর যাপনকে সমর্থন করতে না পারলেই বিরোধিতা করবেন না। সম্মান করতে না পারলেই অসম্মান করবেন না। নিজের অপছন্দ নিজের দায়িত্বে রাখুন।

এই অবধি পড়েই খুব কঠিন মনে হলে কিংবা আমার পিণ্ডি চটকাতে ইচ্ছে হলে থামুন। বাকি পথের জন্য আপনি এখনও প্রস্তুত নন। গোটা জীবন পড়ে আছে। ধীরে ধীরে শিখবেন। যাঁরা এত অবধি পড়ে তেমন বিচলিত হলেন না, যাঁদের নিজেকে বদলানোর সাহস মনের মধ্যে ইতিমধ্যেই উঁকি দিচ্ছে, এই লেখার বাকি অংশটি তাঁদের জন্য। প্রথমদিকে অসুবিধা হবে। মাঝে মাঝে বিরক্তি আসবে। কমেন্টে গাল দিতে আঙুল নিশপিশ করবে। করুন। কিন্তু ওখানেই আটকে গেলে সমকামভীতি ঝেড়ে ফেলার যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, সেটি অকালে বিনষ্ট হবে।

যদি ধৈর্য ধরে নীচের এই বিষয়গুলি বোঝার চেষ্টা করেন, তাহলে হোমোফোবিয়া থেকে মুক্তি নিশ্চিত।

• আপনার সঙ্গে না মিললেই অন্যের যৌনতা ‘বিকৃত’ বা ‘অস্বাভাবিক’ নয়। যারা মানুষের আচরণের গতিপ্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করে, সেই মনোবিজ্ঞান বহু বছর আগেই বলে দিয়েছে, সমকাম অত্যন্ত স্বাভাবিক। কোনও মনোরোগ চিকিৎসক যদি সমকামী মানুষকে মন বদলাতে জোর করেন তবে সেই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নিতে পারে।

• সংখ্যায় বেশি মানেই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া ভুল। বেকারত্ব সংখ্যায় বাড়লে সেটা কি স্বাভাবিক হয়ে যায়? সংখ্যায় কারা বেশি, তারও ঠিক ছবি আপনার কাছে নেই। থাকার কথাও নয়। যে দেশে মোটে চার বছর আগে আইন পাল্টে বলতে হয়, সমকামিতা অপরাধ নয়, সেখানে ক’জন সমকামী আত্মপ্রকাশ করতে ভরসা পাবেন? তাঁরা অদৃশ্য মানেই কিন্তু অশরীরী নন।

• সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামবেন না। অমুকেরটা ভাল, তমুকেরটা খারাপ বলে কিছু হয় না। আপনারটা আপনার ভাল লাগলেই হল।

• অন্যের যৌনরুচি, যৌনপরিচয় সম্পর্কে আগ বাড়িয়ে মন্তব্য করবেন না। তিনি নিজে জানান না দিলে অনুমান করার প্রয়োজন নেই। তিনি জানালেও তাঁর হয়ে বাকিদের কাছে নুন-ঝাল সহযোগে এই তথ্যটি প্রচার করতে যাবেন না। লোভ হবে। কিন্তু সে লোভ সংবরণ করাও সম্ভব।

• যৌনরুচি একটি তথ্য। সেই ব্যক্তির বয়স, উচ্চতা, ঠিকানা ইত্যাদির মতোই একটি তথ্য। তিনি আম ভালবাসেন বা আমসত্ত্ব ভালবাসেনের মতো আরেকটি তথ্য। গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ব্যক্তিগত তথ্য। এটি গালাগাল হিসেবে কার্যকরী নয়।

• যৌনরুচি ‘মিম’ বা রসিকতার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হলে সজাগ হন। যাঁরা হাসছেন, শেয়ার করছেন, তাঁরাও সমকামভীত । তাঁদের নিয়ে ‘সেল্‌ফ হেল্প গ্রুপ’ বা ‘হোমোফোবিক অ্যানোনিমাস’ শুরু করতে পারেন। সমকামভীতি কাটিয়ে ফেলার ধাপগুলি একসঙ্গে চর্চা করলে উৎসাহ পাবেন। অনেকে একসঙ্গে উপকৃত হবেন।

• যৌনরুচি ছোঁয়াচে নয়। সমপ্রেমীদের সঙ্গে মিশলে আপনিও তাঁদের মতো হয়ে যাবেন না। তাঁরাও আপনাকে অনুকরণ করে নিজেকের যৌনতা বদলাতে আগ্রহী নন।

• সবাই সমকামী হয়ে গেলে মানুষ জন্মাবে না, এই ভয় অমূলক। যৌন অভিরুচির ভিন্নতা আগেও ছিল। এখনও থাকবে। কেউ দলে কম পড়বে না। সমকামীদের সম্মান করা মানে অন্যদের সমকামী হতে উদ্বুদ্ধ করা নয়। সমকাম, উভকাম, রূপান্তরকাম, বিষমকাম, নিষ্কাম— এর কোনওটাই বুঝিয়েসুজিয়ে বানিয়ে দেওয়া যায় না। অতএব নিরুপদ্রব সমান্তরাল অবস্থান সম্ভব।

উল্লিখিত ধাপগুলি পরপর মনে না রাখলেও চলবে। মুখস্ত করবেন না। আত্মস্থ করুন। মূল ধারণাটি বোঝার চেষ্টা করুন। বুঝতে অসুবিধে হলে আরেকবার শান্ত হয়ে পড়ুন। তারপরেও একান্তই কিছু বুঝতে না পারলে শেষ ধাপটি আয়ত্ত করা যায় কিনা দেখুন।

• অন্যের যৌনতা সংক্রান্ত কৌতূহল বয়ে বেড়িয়ে মাথাকে অযথা চাপ দেবেন না।

(লেখক মনোবিদ। মতামত নিজস্ব)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement