UNFCCC COP 28

লাভের লোভ, প্রকৃতির রোষ আর আমাদের টিকে থাকার খতিয়ান নেওয়ার গল্প লিখতেই এ বারের কপ ২৮

বৃহস্পতিবার দুবাইয়ের এক্সপো সিটিতে শুরু হয়েছে উষ্ণায়ন রোখার উপায় সন্ধানের বার্ষিক আন্তর্জাতিক বৈঠক। চলতি বুলিতে যাকে বলি ‘কপ’ তা আসলে রাষ্ট্রপুঞ্জের ছাতার তলায় আয়োজিত কনফারেন্স অব পার্টিজ়ের সংক্ষিপ্ত রূপ।

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:০৪
Share:

দুবাইয়ের এক্সপো সিটিতে শুরু হয়েছে উষ্ণায়ন রোখার উপায় সন্ধানের বার্ষিক আন্তর্জাতিক বৈঠক। ছবি: রয়টার্স।

ট্রেনে ফিরছিলাম পুরী থেকে। সহযাত্রী ৮০ জনের একটি দল। এঁরা সকলেই রেফ্রিজারেটর, এসি-র মতো বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন পণ্যের বিক্রেতা। পুরী গিয়েছিলেন একটি উৎপাদক সংস্থার ডাকা সম্মেলনে যোগ দিতে। স্বাভাবিক ভাবেই খুব আড্ডা চলছে ওঁদের। পুরোটাই ব্যবসা ঘিরে। আর এই আড্ডায় কান পেতেই জানলাম, গত গ্রীষ্মে তাঁরা যত এসি বিক্রি করেছেন তা নাকি অভুতপূর্ব। এঁদের অনেকেই তাই পরিকল্পনা করছেন কী ভাবে গ্রীষ্মের চাহিদা মেটাতে আগে থেকেই গুদাম ভরে রাখবেন!

Advertisement

এ ছিল কালকের ঘটনা। আর আজই ভেসে এল উষ্ণায়নকে ঠেকানোর সব লক্ষ্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ১৭ নভেম্বর বিশ্ব জুড়ে উষ্ণতার গড় মাত্রা শিল্পায়নের আগের তাপমাত্রা ছাড়িয়ে আরও ২ ডিগ্রি উপরে থাকার খবর। এই তীব্রতা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে উষ্ণায়নের প্রকোপকে শিল্পায়নের আগের তাপমাত্রা থেকে ১.৫ ডিগ্রি উপরে উঠতে না দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে তা রূপায়নে ব্যর্থ আমরা যে আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি তা নিয়ে আর খুব একটা সংশয়ের জায়গা নেই। গ্লোবাল মেটিওরোলজিক্যাল অরগানাইজ়েশন বা বিশ্ব জলবায়ু পর্যবেক্ষণ সংস্থা এ-ও জানিয়েছে যে বিশ্বের ইতিহাসে বিগত আট মাস ছিল উষ্ণতম! এবং এই প্রবণতা যে কমার দিকে এমন কোনও তথ্য এখনও আমাদের হাতে নেই।

এসি বিক্রেতাদের হাতে বাজারের নাড়ি। তাঁরা গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝে নিয়েছেন ঠান্ডা করার যন্ত্রের বাজারই তাঁদের কাছে লাভ করার জন্য পাখির চোখ। তাঁদের কাছে বিশ্ব জলবায়ু পর্যবেক্ষণ সংস্থার তথ্য নতুন কোনও সিদ্ধান্তের জায়গা তৈরি করে না।

Advertisement

এক দিকে লাভের অঙ্ক আর অন্য দিকে হারানোর অসহায়তা। ঝঞ্ঝাদীর্ণ উপকূলবাসীর কাছেও উষ্ণায়নের নানান তথ্য অর্থহীন। কারণ তাঁরাও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির অভিঘাত নিজেদের জীবনের মূল্যে বুঝে নিচ্ছেন। বঙ্গোপসাগরে পঞ্চাশের দশকের তুলনায় সাইক্লোনের সংখ্যা বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। কিন্তু উপকূলবাসী এই তথ্য বুঝে নিচ্ছেন নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের কষ্টের মূল্যে।

আর এই আবহেই বৃহস্পতিবার দুবাইয়ের এক্সপো সিটিতে শুরু হয়েছে উষ্ণায়ন রোখার উপায় সন্ধানের বার্ষিক আন্তর্জাতিক বৈঠক। চলতি বুলিতে যাকে বলি ‘কপ’ তা আসলে রাষ্ট্রপুঞ্জের ছাতার তলায় আয়োজিত কনফারেন্স অব পার্টিজ়ের সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি ২৮তম বৈঠক বলে ‘কপ২৮’ নামে অভিহিত হচ্ছে। মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচানোয় লাভের অঙ্ক এবং সেই লাভ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের পকেটে ভরে দেওয়ার কৌশল খতিয়ে দেখতে। যদিও ১৭ নভেম্বরের ঘটনা বিগত ২৭টি বৈঠকের সাফল্যের উপর একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিয়েছে।

কারণ এই ভাবে চললে রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে ব্যবহারযোগ্য জমির ৯০ শতাংশ ব্যবহারের অনুপযুক্ত হওয়ার রাস্তায় হেঁটে ফেলবে, বিশ্বের শস্য উৎপাদন হ্রাস পাবে তিন থেকে ১২ শতাংশ। আর একই সঙ্গে বাড়বে অসৎ ব্যবসায়ীদের অত্যাচার। শস্য উৎপাদনের উপর উষ্ণায়নের এবং যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব জুড়েই খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। ঠিক কতটা তা-ও আমরা নিজেদের পকেটের উপর চাপ থেকেই বুঝতে পারছি। কিন্তু এর প্রভাবে বিশ্ব জুড়েই দারিদ্র শুধু নয়, বাড়বে অপুষ্টির প্রকোপও। রাষ্ট্রপুঞ্জের আশঙ্কা, বিশ্বের জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ সরাসরি এর মূল্য চোকাবেন নিজের জীবন দিয়ে।

তৈরি হয়েছে আরও নানান সমস্যা। আর তাই এ বারের সম্মেলনে মূল আলোচ্য:

• বাতাসের বিষ কত দ্রুত কমানো যায় তার রাস্তা খোঁজা যাতে আগামী সাত বছরের মধ্যেই (২০৩০ সাল) উষ্ণায়নের প্রকোপকে আয়ত্তের মধ্যে আনা যায়!

• একটা বিরোধ উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে থেকেই গিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলির অভিযোগ, উন্নত দেশগুলি উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। এবং এই দেশগুলি যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্পদশালী হয়েছে সেই প্রযুক্তি উষ্ণায়নের কারণে বলিতে চড়ছে। তাই উষ্ণায়নের দায় চোকাতে উন্নত দুনিয়াকে উন্নয়নশীল দেশগুলির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে যাতে তাদের উন্নয়ন ব্যাহত না হয়। আগের বিভিন্ন সম্মেলনে এই নিয়ে আলোচনা হয়েছে, ব্যবস্থাও হয়েছে কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয়নি। তাই এ বারের সম্মেলনে পরিবেশ বাঁচানোর জন্য আর্থিক সহায়তা ব্যবস্থাকে কী ভাবে ঢেলে সাজানো যায় তা বার করার চেষ্টা করা হবে।

• পরিবেশ বাঁচানোর রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে যাতে প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে বিরোধ না তৈরি হয় তা দেখেই ভবিষ্যতের কর্মসূচি তৈরি করা।

• কপ যাতে সর্বজনীন হয়ে ওঠে তা নিশ্চিত করা।

আমাদের সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য পদক্ষেপ করতে প্রয়োজন সম্মিলিত আয়োজনের। সেই বোধ আজকের নয়। বহুদিনের। কিন্তু তবুও লাভের লোভ আর সাধারণ মানুষের সেই লোভের বলি হয়ে ওঠার ইতিহাসের শুরু সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই। প্রাথমিক ভাবে সেই লোভের চরম প্রকাশ ছিল যুদ্ধে আর তার প্রাথমিক বলি সব সময়ই ছিল সাধারণ মানুষ। আজ সেই লোভের দর কষাকষির বলি প্রকৃতিও যার প্রাথমিক অভিঘাতের শিকারও কিন্তু সেই সাধারণ মানুষ। এর সব থেকে বড় উদাহরণ সোমালিয়া।

সোমালিয়ার মানুষের প্রাথমিক খাদ্য মাংস। আর তাই সাধারণের জীবিকা পশুপালনও। আর খাদ্যশস্যের জন্য গোটা দেশটি আমদানির উপর নির্ভরশীল। গত দু’বছর ধরে প্রায় দুর্ভিক্ষের অবস্থা সেখানে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে উষ্ণায়নের সব থেকে বড় বলি যে তিনটি দেশ তার অন্যতম সোমালিয়ায় দীর্ঘ খরার কারণে পশুপালন কঠিন হয়ে উঠেছে। আর ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে খাদ্যশস্যের আকাশচুম্বী দামের কারণে প্রায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি দেশটিতে। মাথায় রাখতে হবে উষ্ণায়ন ঠেকানোর মূল প্রতিবন্ধকও কিন্তু সেই লাভেরই লোভ যা অনেকাংশেই সবুজায়নকে ঠেকাচ্ছে। সে অ্যামাজ়নের অরণ্যই হোক বা ভারতের উন্নয়নের নামে বৃক্ষবধই হোক। সমস্যাটার মূল জায়গা একই।

প্রকৃতি নিধনে লাভের লোভ ঠিক কতটা দায়ী তার আরও বড় উদাহরণ বোধহয় ট্রাম্পের আমেরিকা। ২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে আনেন। তাঁর যুক্তি ছিল এই প্রচেষ্টায় আমেরিকার অর্থনীতির যে ক্ষতি হবে তা তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে হতে দিতে পারেন না। চার বছর আমেরিকা এই চুক্তির বাইরে থাকায় তাদের প্রকৃতি দূষণের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণই ছিল না। গত বছর মিশরে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর দেশকে উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে এই প্রচেষ্টায় আবার শামিল করেন। উল্লেখ্য, প্যারিস চুক্তি হল উষ্ণায়নের রোখার পদক্ষেপের মেরুদণ্ড।

ধনী আর দরিদ্রের ফারাক করতে পারে না প্রকৃতি। তার শাসন নিরপেক্ষ। দুবাইয়ের বৈঠকে কিন্তু গত ২৮ বছরের লড়াইয়ের একটা হিসাব নিয়েই পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করা হবে। লক্ষ্য ২০৩০-এর মধ্যেই উষ্ণায়নের প্রকোপকে বাগে আনা। তা পারা গেল কি না সে তো দেখা যাবে পরে। কিন্তু ব্যর্থতার খতিয়ানের প্রেক্ষিতে আগামীর পদক্ষেপ কতটা ফলপ্রসূ হবে তা বিচার করার ভূমি এই বৈঠকেই নির্ধারিত হওয়ার কথা। কিন্তু তার জন্য আমাদের ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement