অশান্তি: ঢাকার রাস্তায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি-সমর্থকদের সংঘর্ষ। ২৮ অক্টোবর, ২০২৩। রয়টার্স।
বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। তার আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল ও হিংসাত্মক হচ্ছে। অক্টোবর মাসে ঢাকায় শাসক আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপি-র মহাসমাবেশ ঘটেছে, বিএনপি সমর্থকদের সঙ্গে স্থানে স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ ও পর দিন দেশব্যাপী হরতাল নির্বাচনী পারদকে চড়িয়ে রেখেছে। কিন্তু তার থেকেও হয়তো গুরুত্বপূর্ণ, নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক তৎপরতা উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। ভারতের জন্যও তার গুরুত্ব কম নয়।
বলে রাখা ভাল, বাংলাদেশ সৃষ্টির মূলে ছিল একটি নির্বাচন, ১৯৭০-এর পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। আরও বিস্ময়, পাকিস্তান সৃষ্টির তেইশ বছর পর সেই প্রথম বার সে দেশে সাধারণ নির্বাচন হয়, তত দিনে ভারতে চারটি সাধারণ নির্বাচন হয়ে পঞ্চমটির প্রস্তুতি চলছে। পাকিস্তান শুধু ভারত থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়নি, ভারতীয় উপমহাদেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির ধারা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়েছে। সংসদীয় নিয়মকানুন মেনে ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিলে পাকিস্তান খণ্ডিত হত না এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী দাবি অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) স্বায়ত্তশাসনের অধিকার নিয়ে পাকিস্তানে যুক্ত থাকত।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসও রীতিমতো জটিল। ১৯৭৩-এর মার্চে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়। এই বিপুল জয়ের দু’বছরের মধ্যেই, ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনে দেশে একদলীয় শাসনের কথা ঘোষণা করা হল। তৈরি হয় একমাত্র শাসক দল বাকশাল, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। এর কয়েক মাস পরেই, ১৫ অগস্ট মুজিব হত্যা ও সামরিক অভ্যুত্থান। এর পর বার বার সামরিক অভ্যুত্থান এবং সামরিক তত্ত্বাবধানে আরও দু’বার নির্বাচন হলেও তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় না। সামরিক প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের জন্য ১৯৯০-এ গঠিত হল অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এর পরিচালনায় ১৯৯১ সালে, অর্থাৎ প্রথম নির্বাচনের ১৮ বছর পরে বাংলাদেশে আবার সাধারণ নির্বাচন হল, তাতে জয়ী হল খালেদা জ়িয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। ১৯৯৬-এ বিএনপি-র শাসনে ফেব্রুয়ারি মাসে যে নির্বাচন হয়, রিগিংয়ের অভিযোগে সব বিরোধী দল তা বয়কট করে, বিপুল আসনে জিতে সরকার গড়ে বিএনপি। কিন্তু দেশে-বিদেশে এর বিপুল নিন্দায় ১২ দিন পর সেই সরকার পদত্যাগ করে। আবার গঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক অরাজনৈতিক সরকার, তার পরিচালনায় ১৯৯৬-এর জুনে নতুন করে নির্বাচন হয়। তখনই বাংলাদেশ সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী করে সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক অরাজনৈতিক সরকার গঠন আইনি করা হয়।
১৯৯৬-এর নির্বাচনে জিতে সরকার গড়ে আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার ২৪ বছর পর। এর পর ২০০১, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক অরাজনৈতিক সরকারের পরিচালনায়। ২০০১-এ জয়ী হয় বিএনপি, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ। এর পর আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১-তে বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক অরাজনৈতিক সরকারের বিষয়টি বাতিল করে দেয়। এর প্রতিবাদে ২০১৪-র জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি যোগদান করেনি, নির্বাচনে ভোটদানের হার ছিল মাত্র ২২ শতাংশ। ২০১৪-র জয়ের পর ২০১৮ সালের নির্বাচনেও ব্যাপক জাল ভোটের অভিযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রায় ৯০ শতাংশ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। গত ১৫ বছর ধরে তারা শাসনক্ষমতায়। আগামী নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামাতের মূল দাবি— তত্ত্বাবধায়ক অরাজনৈতিক সরকার ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন। এ ছাড়া শাসক দলের বিরুদ্ধে সরকারি ক্ষমতা অপপ্রয়োগ করে বিরোধী দলগুলির উপর অত্যাচারের অভিযোগ তো আছেই। এই হচ্ছে বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের দেশীয় প্রেক্ষাপট।
পাশাপাশি বিদেশি প্রেক্ষাপটটিও গুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েক বছর ধরে আমেরিকা বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন। ২০২১-এর ১০ ডিসেম্বর আমেরিকা সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন)-এর বর্তমান ও প্রাক্তন অধিকর্তাদের এবং কয়েক জন অফিসারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সম্প্রতি, ২১ সেপ্টেম্বর আমেরিকান আধিকারিক উজ়রা জ়েয়া নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পরই ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক কার্যকলাপে যে সব সরকারি আধিকারিক, শাসক বা বিরোধী দলের নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী আধিকারিকেরা বাধা দেবেন, তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের লোকজনকেও আমেরিকা সরকার ভিসা দেবে না। ২৮ অক্টোবর হরতালের পর আমেরিকান দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানায় যে তারা, সম্ভাব্য ভিসা-নিষেধাজ্ঞার জন্য সমস্ত সহিংস ঘটনা পর্যালোচনা করবে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে এই উদ্বেগ অস্বাভাবিক। পশ্চিম এশিয়া বা আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশেই বাংলাদেশের মানের গণতন্ত্রেরও অস্তিত্ব নেই। গণতন্ত্রের নামগন্ধ নেই বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ, অর্থ ও প্রযুক্তির নব্য মহারথী চিনেও। (আমাদের বামপন্থী বিরোধী নেতাকুল কি চিনের বিরোধী নেতাদের নাম বলতে পারবেন?) এদের নিয়েই বেশ রাষ্ট্রপুঞ্জ চলছে, অলিম্পিক্স চলছে, আমেরিকা সরকার নিশ্চিন্ত আছে। তা হলে বাংলাদেশের অপরাধ কী? কেউ কেউ মনে করছেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্রমশ চিনের দিকে ঝুঁকছে, বিশেষত চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এ যোগদান আমেরিকা ভাল ভাবে নেয়নি। কারও মত পুরো উল্টো, আওয়ামী লীগের ভারত সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও নির্ভরতা আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া একেবারেই পছন্দ করে না।
এ দিকে ভারতেও সাধারণ নির্বাচনের বেশি দেরি নেই। সুতরাং, বাংলাদেশের নির্বাচনে এই আমেরিকার তৎপরতা ভারতেও ঘটতে পারে বা শুরু হয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি কানাডা সরকারের খলিস্তানপন্থীদের সমর্থন ও সরকারের সম্মতিতে কানাডার রাস্তায় ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার সাফল্য উদ্যাপন করে খলিস্তানপন্থীদের প্যারেডে ট্যাবলো প্রদর্শন— এ-সবেরই নীরব সমর্থন করেছে আমেরিকা সরকার। এই বছর জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমেরিকায় অবস্থানের সময় আমেরিকান কংগ্রেসের ৭৫ জন ডেমোক্র্যাট সদস্য একটি চিঠিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে জানান, তিনি যেন মোদীর সঙ্গে আলোচনায় ভারত সরকার সংখ্যালঘু ও বিরোধীদের উপর যে নিপীড়ন চালাচ্ছে, সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। এই অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে এক ডেমোক্র্যাট সদস্য আমেরিকান কংগ্রেসে একই বিষয়ে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব এনেছেন।
গত দশ বছর ধরে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের প্রধান সংবাদমাধ্যমে, প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, অ্যাকাডেমিক জগতে ভারতের সমালোচনা চলেছে। সুতরাং, ভারতের নির্বাচন নিয়েও তাদের উদ্বেগ বুঝতে অসুবিধা নেই। অনুমান করা যেতে পারে, বাংলাদেশের মতো ভারতের আগামী সাধারণ নির্বাচনেও পশ্চিমি দেশগুলির অবস্থান ও ভূমিকা হতে চলেছে সক্রিয়।