অন্তহীন: ‘নিরাপত্তা’র খোঁজে ভূখণ্ডের উত্তর থেকে দক্ষিণে আসা গাজ়ার মানুষ। ২২ নভেম্বর ২০২৩। পিটিআই।
সব সীমান্ত শেষ হয়ে গেলে আমরা কোথায় যাব? আকাশ ফুরিয়ে গেলে পাখিরা কোথায় উড়বে?— প্যালেস্টাইনের কবি মাহমুদ দরবেশ-এর কবিতার পঙ্ক্তি মনে রেখে ফিডা কিশতা (নীচের ছবিতে) তাঁর তথ্যচিত্রের নাম রেখেছিলেন হোয়্যার শুড দ্য বার্ডস ফ্লাই। ফিডা গাজ়ার মেয়ে, এখন প্রবাসী। ভিডিয়ো ক্যামেরায় সামাজিক অনুষ্ঠানের ছবি তুলতেন। ২০০৪ সালে ইজ়রায়েলের হানায় তাঁদের বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। ক্যামেরাটিকে সঙ্গী করে কাজে নামেন অষ্টাদশী ফিডা। তথ্য সংগ্রহের কাজ। ছ’সাত বছর ধরে সংগৃহীত গাজ়ার মানুষের জীবন ও মৃত্যুর দিনলিপি থেকে এক দশক আগে তিনি তৈরি করেছিলেন এই তথ্যচিত্রটি। সম্প্রতি কলকাতায় ‘পিপল’স ফিল্ম কালেক্টিভ’ গোষ্ঠী আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ছবিটি দেখার সুযোগ হল।
ঘণ্টাখানেকের তথ্যচিত্রটির অনেকখানি জুড়ে আমরা দেখি ২০০৮-০৯ সালে গাজ়ায় ‘অভূতপূর্ব’ ইজ়রায়েলি আক্রমণের পরিণাম। হ্যাঁ, ভূমধ্যসাগরের তীরে ওই একফালি জমিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি হয়ে বাঁচেন যে কুড়ি-বাইশ লাখ প্যালেস্টাইনি মানুষ, যাঁদের প্রায় অর্ধেকের বয়স আঠারোর নীচে, তাঁদের উপর পরাক্রমী ইজ়রায়েলি রাষ্ট্রের অগণিত আক্রমণের ইতিহাসে তখনও পর্যন্ত সেটিই ছিল সবচেয়ে বিধ্বংসী অভিযান। তার পরে ক্যালেন্ডার নিজের নিয়মে এগিয়েছে, ক্ষমতার নিয়মে তৈরি হয়েছে ধ্বংসের নব নব রেকর্ড। সেই ধারাতেই ২০২৩ সালে গাজ়ার অধিবাসীরা আবার অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের শিকার, প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু অভূতপূর্ব প্রত্যাঘাতের গৌরবে উদ্ভাসিত, সেই আলো সহস্র ‘ফসফরাস বোমা’র দীপ্তিকে হার মানায়। এ বারের ধ্বংসলীলা শুধু পরিমাণে নয়, গুণমানেও নতুন রেকর্ড গড়েছে। মরণাপন্ন রোগী আর সদ্যোজাত শিশু-সহ হাসপাতালও এই যুদ্ধে— কোল্যাটারাল ড্যামেজ নয়— মারণাস্ত্রের পরিকল্পিত নিশানা। এবং সেই পরিকল্পনা দুনিয়ার হাটে বিশেষজ্ঞদের সার্টিফিকেটও অর্জন করেছে। নামজাদা আন্তর্জাতিক পত্রিকার সবজান্তা প্রবন্ধে ধর্মাবতারসুলভ পবিত্র নৈতিকতার সুরে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে: নেতানিয়াহু কি গাজ়ার হাসপাতালে আক্রমণের পক্ষে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ দাখিল করতে পেরেছেন? অর্থাৎ, যথেষ্ট ‘প্রমাণ’ দিলে হাসপাতালে রাষ্ট্রীয় বোমা বর্ষণও— পৈশাচিক সন্ত্রাস নয়— যুক্তিসঙ্গত, ন্যায্য, জায়েজ়! স্বজনবান্ধবদের নিধনে নারাজ তৃতীয় পাণ্ডবকে কুরুক্ষেত্রে নামাতে বদ্ধপরিকর তাঁর সারথি মহোদয়ও এমন যুক্তি উচ্চারণের আগে অন্তত এক বার ঢোঁক গিলতেন। এ ঘোর কলিতে বিশেষজ্ঞদের সে সব বালাই নেই।
কিন্তু ফিডা-র ছবি বিশেষজ্ঞদের চৌকাঠ মাড়ায়নি, তিনি গাজ়ার মানুষের কাছে গিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁদের যন্ত্রণাময় জীবন ও অসহায় মৃত্যুর ছবি তুলেছেন। দেখিয়েছেন, যখন সেখানে মারণাস্ত্রের ধারাবর্ষণ হয় না, সেই ‘স্বাভাবিক’ সময়েও অধিবাসীদের জীবন কতখানি দুর্বিষহ। পঁচিশ মাইল লম্বা ও সর্বাধিক সাড়ে সাত মাইল চওড়া ভূখণ্ডটি থেকে বেরোনো এবং সেখানে ঢোকা সতত কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত। খাবারদাবার থেকে ওষুধপত্র পর্যন্ত কিছুরই কোনও নিশ্চয়তা নেই। রুজি রোজগারের সুযোগ যতখানি সীমিত তার চেয়েও বেশি অনিশ্চিত। যেমন, এই ছবির বেশ কিছুটা জুড়ে আছেন উপকূলের মৎস্যজীবীরা। সমুদ্রের যেটুকু দূরত্বে মাছ ধরতে যাওয়ার আইনি অধিকার দেওয়া আছে, সেটুকুতেও তাঁরা প্রায়শই যেতে পারেন না— ইজ়রায়েলি অফিসাররা মর্জি মাফিক অনুমোদিত অঞ্চল থেকেও মৎস্যজীবীদের হটিয়ে দেয়, কথা না শুনলে গুলি ছুটে আসে। ছবির একটি দৃশ্যে বিদেশি মানবাধিকার কর্মী জেলে-নৌকায় দাঁড়িয়ে আর্ত চিৎকার করেন: “তোমরা কী চাও? আমরা এখানে নিরস্ত্র, ওঁরা বৈধ এলাকায় মাছ ধরছেন, তোমরা গুলি করছ কেন?” টহলদার লঞ্চ থেকে সিপাই-সান্ত্রিদের জবাব আসে, “এখান থেকে চলে যাও। এখনই।” রাষ্ট্র মানে প্রশ্নের উত্তর নয়, সামান্যতম যুক্তি নয়, ট্রিগারে হাত রেখে নিক্ষিপ্ত হুকুম।
এই দৃশ্যাবলি আমাদের সামনে রেখে ফিডা অমোঘ প্রশ্নটি তোলেন: এ রকম কেন হবে? বছরে ত্রিশ বার কচলানো রাষ্ট্রনীতির ভাষ্যপাঠে কিংবা হামাস বনাম জ়ায়নবাদ নিয়ে ওরা-বনাম-এরা মার্কা সওয়াল-জবাবে তাঁর এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে না। তাঁকে কূটনীতির বক্তৃতা শোনাতে গেলে তিনি চোখে চোখ রেখে জানতে চাইবেন: গাজ়ার মানুষ তো অন্য গ্রহ থেকে আসেনি, তারা কেন মানুষের মতো বাঁচতে পারবে না? আর সব কথা থাকুক, শিশুরা কেন চোখের সামনে তাদের মা, বাবা, দাদা, দিদি, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, প্রিয়তম বন্ধুদের অতর্কিতে মরে যেতে দেখবে?
—নিজস্ব চিত্র।
এমনই এক শিশুর নাম মোনা সামোনি। ২০০৮-এর অভিযানে সে তার মা এবং বাবা-সহ বহু প্রিয়জনকে হারিয়েছিল। বোমাবর্ষণের আগে ওদের পরিবারকে একটি বাড়িতে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছিল, ওঁরা ভেবেছিলেন ওঁদেরই নিরাপত্তার জন্য। তার পরে সেই আশ্রয় লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্রেরা ছুটে এল। সেই অস্ত্র ইজ়রায়েলের নিজের তৈরি না আমেরিকার উপহার, কে জানে। জানার দরকারই বা কী? মোদ্দা কথাটা তো ফিডা একবাক্যেই জানিয়ে দেন। আকাশে বোমারু বিমানকে সাক্ষী রেখে তাঁর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে: ওরা এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন কাস্ট লেড’, আমরা বলি ‘ম্যাসাকার’।
মোনা সামোনির কাহিনি ফিডাকে জানিয়ে তাঁর বন্ধু বলেছিলেন, মেয়েটার সঙ্গে এক বার দেখা করো। ফিডা-র মনে হয়েছিল, দশ বছরের মেয়ে, তার কাছে আর কী বা জানা যাবে? তবু গিয়েছিলেন কথা বলতে। এবং তার পরে ফিরে গিয়েছেন বার বার। দেখেছেন, ওই মেয়ে কী একাগ্র স্মৃতিতে ধরে রেখেছে তার চোখে দেখা বিধ্বংসের প্রতিটি দৃশ্যকণা, কী নিপুণ ভাবে সে জানিয়ে যায় কোন মৃত্যুদূত বাড়ির ঠিক কোন জায়গায় আছড়ে পড়েছিল, কাকে কী ভাবে আঘাত করেছিল, কে কার পরে মারা গিয়েছিলেন। ফিডা স্তম্ভিত হয়ে তাকে দেখেন, তার কথা শোনেন, স্তম্ভিত ক্যামেরা ছবি তুলে চলে। মোনার সঙ্গে ক্রমশ তাঁর পরিচয় নিবিড় হয়, সে নিজের কথা বলে চলে, আর খাতার পাতা উল্টে উল্টে ছবি দেখায়। অনেক ছবি এঁকেছে সে, এঁকেই চলেছে। মা, বাবা, দিদি, জামাইবাবু, বন্ধুর বাড়ি, বোমারু বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, ইজ়রায়েলি সেনা। ক্যামেরার সামনে একের পর এক ছবি আসে, মোনা নীরবে তাদের গায়ে মাথায় আঙুল বোলায়। এক বার অস্ফুটে বলে: ওদের কথা খুব মনে পড়ে। তার প্রশান্ত মুখে এক চিলতে ম্লান আলো। ও রকম মর্মান্তিক প্রশান্তি জীবনে খুব কম দেখেছি।
অসামান্য তথ্যচিত্রটি দেখতে দেখতে বার বার মনে হচ্ছিল— পিপল’স ফিল্ম কালেক্টিভ-এর উদ্যোক্তারাও বললেন সে-কথা— পর্দায় যাদের দেখছি, গত কয়েক সপ্তাহে তাদের কত জন নেই হয়ে গিয়েছে, কত জনের জীবনে নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়, কোনও দিন জানতেও পারব না। পনেরো বছর আগে সব-হারানো ওই মেয়েটি, হিসাব-মতো যার বয়স এখন বছর পঁচিশ, সে কোথায় আছে, কেমন আছে, আছে কি না... অসহায়, নিষ্ফল উদ্বেগ বোধ করা ছাড়া আর কিছুই করণীয় নেই আমাদের। প্যালেস্টাইনের মানুষকে আমরা বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারব, এমন স্বপ্ন দেখার কোনও মানে নেই।
কিন্তু এই ছবি, এমন সব ছবি এবং আলোকচিত্র এবং কথা ও কাহিনি যদি আমরা আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি, তা হলে আমাদের নিজেদের চার পাশের অন্ধকার কিছুটা সরানো যাবে না কি? অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষমতার অধীশ্বররা তাঁদের স্বার্থসিদ্ধির অনন্ত তাড়নায় অগণিত মানুষের জীবনে যে সর্বনাশ ঘটিয়ে চলেছেন, তার বাস্তব ছবিগুলো নিরন্তর বহু মানুষকে দেখাতে পারলে উদাসীন, নিষ্ক্রিয়,
নিশ্চিন্ত সমাজের মৃতদেহে জীবনসঞ্চার ঘটবে না? অগণন শিশুর ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহগুলিকে চোখের সামনে পেশ করলেও আমাদের মনে রেখাপাত করবে না, তার পরেও আমরা একই রকম জোর গলায় ‘মারের বদলা মার’ দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করে যাব? যেতে পারব?
বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করবার কোনও কারণ দেখি না। আমরা যাইনি মরে আজও। কেবল চোখজোড়াকে অন্য দিকে সরিয়ে রেখেছি। সরিয়ে রাখতে পেরেছি। পেরেছি বলেই চতুর্দিকে প্রতিনিয়ত রকমারি পিশাচলীলা চলছে, আমরা হাত উল্টে বলছি ‘কী আর করা যাবে’, কিংবা সেই পৈশাচিকতার ‘যুক্তি’ খুঁজে নিচ্ছি। অতএব, আমরা যাতে চোখ সরাতে না পারি, তার ব্যবস্থা করা দরকার। দেশে ও দুনিয়ায়, ঘরে এবং বাইরে, কাছে অথবা দূরে ক্ষমতাবান বা ক্ষমতাবতীদের অন্তহীন অন্যায়ের মর্মান্তিক পরিণামগুলিকে প্রতিনিয়ত আরও আরও আরও চোখের সামনে নিক্ষেপ করা দরকার এবং প্রশ্ন তোলা দরকার: এ রকম কেন হবে? এটাই এখন কাজ। আমাদের সকলের কাজ।