—ফাইল চিত্র।
টিভি দেখে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেলাম মঙ্গলবার রাতে। তার আগে দমবন্ধ উত্তেজনায় বসে থাকা। পারবেন তো ওঁরা? ট্রলিতে চেপে এক-এক করে বেরিয়ে এলেন ৪১ জন, হাস্যোজ্জ্বল মুখে হাত নাড়ছেন। দমচাপা পাথরটা বুক থেকে নেমে গেল। অগার মেশিন বনাম শ্রমিকের হাতুড়ি, মানুষ বনাম যন্ত্র— সবই মনে হচ্ছে বাতুলতা। এত দিন ভূগর্ভের অন্ধকারে থেকেও যাঁরা মনোবল হারান না, তাঁদের অভিনন্দনের ভাষা নেই। ভোটের বাজারে কোনও বিশ্বগুরু ও তাঁর চেলারা এই ঘটনাকে সাফল্য ভেবে কায়দা করে জয়ঢাক পেটাবেন কি না, সে সব ভাবতেও ইচ্ছা করছে না। একাধিক বার হেঁটে, ঘোড়ার পিঠে দেবভূমিতে গিয়েছি। তাই জানি, এই দমবন্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির কোনও দরকার ছিল না।
চার ধামের মধ্যে ১০,৯২৭ ফুট উচ্চতার যমুনোত্রীই সবচেয়ে কম উচ্চতার। কিন্তু বন্দরপুঞ্ছ শৃঙ্গের নীচে এই রাস্তাটাই সবচেয়ে খতরনাক। চড়াই-উতরাইয়ে ভরা অপ্রশস্ত রাস্তা, কোথাও বা আলগা ঝুরো পাথর। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকেও দেহরাদূন থেকে বাস যমুনোত্রীর ৪৬ কিমি আগে বারকোট শহরে এসে থেমে যেত। সেখানেই হোটেল ও টুরিস্ট লজ। তার পর দু’দিন পাহাড়ি পথে হাঁটা, তাঁবু এবং চটিতে রাত্রিবাস। অতঃপর ওই রাস্তা ধরে বাস এগোল হনুমানচটি অবধি। সেখান থেকে মন্দির এক দিনের রাস্তা, ৮ কিলোমিটার। এখন রাস্তা আরও এগিয়েছে। ৩ কিমি দূরের জানকীচটি। বছর ছয়েক আগেও দেখেছি, ওই ৩ কিলোমিটার পথ পেরোনোর জন্য ভোর ভোর বেরোতে হয়। বারকোট, হনুমানচটি, জানকীচটি কোথাও তীর্থযাত্রীদের অসুবিধা ছিল না। যমুনোত্রীর সঙ্গে গঙ্গোত্রী, কেদার, বদ্রী জুড়ে চার ধামের এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির পরিকল্পনা কোন উর্বর মস্তিষ্কের অবদান?
টুরিস্ট বা ভ্রমণকারী আর পিলগ্রিম বা তীর্থযাত্রী মোটেই এক নন। প্রথম দলের একটু আয়েস দরকার, দ্বিতীয়দের সে রকম নয়। বদ্রীনাথের রাস্তায় ত্রিশের দশকে হৃষীকেশ থেকে হাঁটতে হত, তার পর বাস রাস্তা এগোল রুদ্রপ্রয়াগ অবধি, অতঃপর বদ্রী। এখন ভারতের শেষ গ্রাম মানা অবধি। বাসপথ যে অবধিই হোক, তীর্থযাত্রীর বিরাম ছিল না। নব্বইয়ের দশকেও দেখেছি, জোশীমঠের পরই প্রশস্ত হাইওয়ে শেষ। লেভেল ক্রসিংয়ের মতো কয়েক ঘণ্টা অন্তর গেট পড়ত, এক বার উপরে ওঠার বাস ছাড়ত। তার পর নীচে নামার। পাঁচ বছর আগে দেখে এলাম, প্রশস্ত পথ। ক্রসিংয়ে অপেক্ষার বালাই নেই। জোশীমঠ বেয়েই এ দিকে হিন্দুদের বদ্রীনাথ, ও শিখদের হেমকুণ্ড সাহিব। তীর্থযাত্রীদের অসুবিধা নেই। অনুযোগ বরং শুরু হয়েছে কয়েক মাস আগে বেপরোয়া জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে জোশীমঠে বিপজ্জনক ফাটল ধরার পর। কিন্তু উন্নয়নী এক্সপ্রেসওয়ের তাতে কী আসে যায়!
রাগে গা চিড়বিড় করছে। সিল্কিয়ারা টানেলের পাশে নাগদেবতার মন্দিরে পুজো দিয়েছেন অস্ট্রেলীয় সুড়ঙ্গ বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড ডিক্স, সেটাকে ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে বিশ্বাসের মেলবন্ধন’ বলে টুইট করছেন বিজেপির অমিত মালবীয়। আইটি সেল কি চোখে ঠুলি এঁটে থাকে? ২০১৩ সালে মন্দাকিনীতে বন্যার পর গাড়োয়াল শ্রীনগরে নদীর বুকে দেখে এলাম ধারী দেবীর মন্দির। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির কারণে স্থানীয় ধারী গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর মন্দিরটি ইঞ্জিনিয়াররা সরিয়ে দিয়েছিলেন, তার পরই বন্যা। গ্রামের লোকেরা বললেন, এ রকমই হয়। ধারী দেবী কেদারের শক্তি। স্থানীয় রাজা এক বার মন্দির সরিয়ে দিয়েছিলেন, তার পরই ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয় কেদার। বিজ্ঞান আর বিশ্বাসের মেলবন্ধন নয় শ্রীমালবীয়! আপনাদের উন্নয়নী প্রযুক্তিবিজ্ঞানের বদলে স্থানীয় লোকবিশ্বাসই আমজনতার আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। মন্দাকিনীর সেই বন্যায় রামওয়াড়া শহর ধ্বংস হয়, কেদারমন্দির অদ্ভুত ভাবে বেঁচে যায়। একটা বড় পাথর ভেসে এসে মন্দিরের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ে, হড়পা বানে ছিটকে আসা নুড়ি পাথরগুলো সেই পাথরে ধাক্কা খায়। সেই পাথর এখনও মন্দিরের পিছনে, লোকে ‘ভীমশিলা’ বলে পুজো দেয়। ভাগ্যিস! জনজীবনে ওই বিশ্বাস আছে দেখেই আপনারা বারংবার বেঁচে যান। লুপ্ত রামওয়াড়ায় জঙ্গল সাফ করে এত হোটেল, রিসর্ট হয়েছিল কেন, সেই প্রশ্ন কেউ তোলে না।
এক গাড়োয়ালি বৃদ্ধের কথা মনে পড়ছিল। পঞ্চকেদারের অন্যতম তুঙ্গনাথে থাকতেন তিনি। উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের গাইড বচন সিংহ। একুশ শতকের শুরুতেও কেদারের গৌরীকুণ্ড থেকে তুঙ্গনাথের রাস্তায় চোপতা গ্রামে আসার সবেধন নীলমণি বাসটি ভোর পাঁচটায় ছাড়ত। স্থানীয়রা অনেক অনশন, আন্দোলনের বিনিময়ে বাসটি পেয়েছিলেন। ফলে বাস রুটের নাম ছিল ভুখ হরতাল। কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিলেন বৃদ্ধ, “আপনারা স্যর আশুতোষকে বাংলার বাঘ বলেন, আমরা উমাপ্রসাদকে গাড়োয়ালের বাঘ বলি। উনিই পঞ্চকেদারের এই সব রাস্তা আবিষ্কার করেছিলেন।” এঁদের কারও শ্রমিকদের ইঁদুরকলে আটকে এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির দরকার পড়েনি।
রাস্তা বদলে যায়। একদা কেদারপথে বাসরাস্তা শেষ হত গৌরীকুণ্ডে উষ্ণ প্রস্রবণের আতিথ্যে। এখন সোনপ্রয়াগ থেকে ছোট গাড়ি নিতে হয়। ১৯৬৪ সালে কেদার-বদ্রীফেরত নারায়ণ সান্যাল পথের মহাপ্রস্থান বইয়ে দেখিয়েছিলেন, আগের হাঁটাপথ, তীর্থযাত্রীতে পূর্ণ গ্রাম আর নেই। তৈরি হচ্ছে নতুন জনপদ, বাসের নতুন রাস্তা। ভোরবেলায় রুদ্রপ্রয়াগ থেকে বাস ছেড়েছে, লেখকের বর্ণনা— “গ্রামের পথে কয়েকটা পাহাড়ি কুকুর চিৎকার করে উঠল। কুকুরগুলি বুঝতে পেরেছে ওই বাসের পথেই আসছে সর্বনাশ। যে চটিদার ওকে খাবার দিত ওই বাসই তাকে সর্বস্বান্ত করেছে, যে চায়ের দোকানদার ওকে বিস্কুট দিত, সে মাথায় হাত দিয়ে বসেছে ওই বাসের জন্যই।”
উন্নয়নের ‘পাক্কী সড়ক’ বরাবর এ রকমই ছিল। কিন্তু এখন সে আরও নিষ্ঠুর, অন্ধকার গর্তে ১৬ দিন আটকে রাখার মহাসড়ক।