গা ছমছমে একটা দীর্ঘ যাত্রা ঘটে এ বই পড়লে। ছবি: পিক্সঅ্যাবে
অবিকল যমজ দুই বোন। জয়া আর বিজয়া। তাদের মা সব সময়ে তাদের একই রকম পোশাক পরিয়ে রাখতেন। মা ছাড়া কেউ বুঝতেও পারতেন না কে জয়া কে বিজয়া। পাঁচ বছর এ ভাবেই গড়ায়। বাবার অধ্যাপনার চাকরি সূত্রে তারা সেই সময় মুম্বইয়ে থাকত। ঠিক হয় এক ছুটিতে তারা কলকাতা যাবে। কিন্তু বাবা ছুটি না পাওয়ায় দুই মেয়ে আর বাবার বিভাগের এক কর্মীকে সঙ্গী করে মা-ই রওনা হন। কথা হয়, বাবা পরে পৌঁছবেন। কিন্তু কলকাতাগামী ট্রেনটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়ে। বহু লোকের মৃত্যু হয়। মা, সঙ্গী ভদ্রলোক এবং একটি মেয়ে মারা যায়। অন্য মেয়েটিকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মেয়েটি প্রাণে বেঁচে গেলেও তার পূর্বস্মৃতি লোপ পায়। সে জয়া না বিজয়া— সেটা মনে করতে পারে না। দুর্ঘটনার পর তার নতুন জীবন শুরু হয় নতুন নামে। আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হয় স্মৃতির ভাঁড়ার। কিন্তু অমৃতাকে প্রায়শই পড়তে হয় পরিজনের প্রশ্নের মুখে— সে জয়া না বিজয়া? এই প্রশ্নে সে আতঙ্কিত হয়ে উঠতে থাকে। চিকিৎসকরা জানান, এমন প্রশ্ন তাকে যেন না করা হয়। যদি তার কিছু মনে পড়ে, তবে তা আপনা থেকেই পড়বে। আর না পড়লে কিছু করার নেই। দুর্ঘটনার আগের স্মৃতি তার আর ফিরে আসেনি।
অমৃতা কলেজ জীবনে প্রবেশ করার সময় থেকে প্রায় প্রতি রাতেই এক অস্বস্তিকর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। স্বপ্নে সে অবিকল তার মতো একটি মেয়েকে দেখতে শুরু করে। তার মতোই পোশাক পরনে। অমৃতা তাকে জিজ্ঞাসা করে, সে কোন জন, জয়া না বিজয়া। এর উত্তর তার জানা নেই। এই স্বপ্ন চলতেই থাকে। বদলে যায় স্বপ্নে দেখা মেয়েটির বয়স। বদলায় স্বপ্নে দৃষ্ট পরিমণ্ডলও। ঝাপসা অচেনা গাছপালা ঘেরা জায়গাটা একটু একটু করে বদলে যায় স্বপ্নান্তরে। অমৃতার অবিকল মেয়েটি উত্তর দেয়, ‘‘এসবের একটা যুক্তি আছে...।’’
কখনও স্বপ্নে কখনও জাগরণে এই ‘যুক্তি’-র ইঙ্গিত বহন করে তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ ‘সমান্তরাল’-এর প্রায় সব ক’টি গল্প। কোনও গল্পে প্রধান চরিত্র জেগে থাকা অবস্থায় টের পায় আর এক ‘অন্য’ জায়গার অস্তিত্ব। আবার কোনও কাহিনিতে ঘুমের মধ্যে দেখা দেয় সেই পরিসর। প্রায় সব গল্পেই এই পরিসরটির বর্ণনা এক। আবছা, অচেনা গাছপালা, কখনও বিচিত্র এক সমুদ্র, কোনও অজ্ঞাত জায়গা থেকে ভেসে আসা সুগন্ধ । সেই জায়গা কার্যত জনহীন। তবে মাঝে মাঝে একটা মূর্তিকে দেখা যায় সেখানে। কালো, খুব লম্বা মুখমণ্ডল, সবুজ চোখ, হাত-পা দেহের সঙ্গে জোড়া, মুখগহ্বর বলে কিছু নেই, লতানে হাতে অনেকগুলো করে লম্বা আঙুল। কে এই মূর্তি? উত্তর নেই এই বইয়ের কোনও গল্পেই। কোনও ইঙ্গিতও নেই। কেবল গল্প থেকে গল্পান্তরে বিস্তৃত হয় এই জগৎ। প্রাত্যহিকের জগতের সঙ্গে সমান্তরালে রয়েছে এই জগৎ। কখনও কখনও কাহিনির মূল চরিত্র ঢুকে পড়ে এই জগতে স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে, কখনও সে খুঁজে পায় এমন একটা দরজা, যা অন্যরা দেখতে পায় না। ফলে তার নিজের ‘যুক্তির জগৎ’-কে সে কাউকে বোঝাতেও পারে না।
বইয়ের চতুর্থ মলাটে লেখক পরিচিতিতে বলা হয়েছে, লেখিকা কিংবদন্তি সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতনি। এবং তাঁর লেখালেখির সূত্রপাতে তাঁর ‘লেখকদাদু’-র ভূমিকাও রয়েছে। কিন্তু এই বইয়ে সন্নিবিষ্ট কাহিনিগুলির সঙ্গে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত অতিলৌকিক কাহিনির মিল খুঁজতে চাওয়াটা একেবারেই ঠিক হবে না। শরদিন্দু তাঁর অধিকাংশ অতিলৌকিক কাহিনিতেই, বিশেষ করে ‘বরদা’ সিরিজের গল্পে বা ‘কালো মোরগ’ জাতীয় গল্পে শিউরে ওঠা ভয়ের উপস্থাপনা করেছিলেন। ‘সমান্তরাল’-এ সেই রস নেই বললেই চলে। বদলে রয়েছে এক অজানা শিহরণ, যা ছড়িয়ে পড়তে থাকে ধীরে ধীরে। বাংলা সাহিত্যে এই সমান্তরাল জগৎ নিয়ে খুব বেশি কথা বলা হয়নি। শরদিন্দুর লেখা একটি গল্প ‘ধীরেন ঘোষের বিবাহ’-তে গল্পের নায়ক আচমকা মুখোমুখি হয়েছিল নিজেরই যুবকাবস্থার। এক রেল কামরায় ঘটে যাওয়া সেই কাহিনি কি আসলে দুই সমান্তরাল বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া? শরদিন্দু নিরুত্তর। তাঁর ‘লেখকদাদু’-র মতো তন্দ্রাও উত্তর দেননি এই সমান্তরাল কাহিনিমালায়।
বাংলা সাহিত্যে এর আগেও এই সমান্তরাল ভিন্নমাত্রার জগৎ নিয়ে লেখা হয়েছে। বিমল করের ‘হারানো জিপের রহস্য’ অথবা ‘কিশোর ফিরে এসেছিল’ এই ভিন্নমাত্রারই কাহিনি। কিন্তু সে সব লেখায় সেই অন্যমাত্রিক জগতের কোনও বর্ণনা ছিল না। কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র এই সময়-পরিসর থেকে উধাও হয়ে যায় এবং আবার ফিরে আসে। কিন্তু এই মধ্যবর্তী সময়ের কোনও স্মৃতি তাদের ছিল না। এই বইয়ের সব কাহিনিতেই কিন্তু সেই স্মৃতি প্রবল ভাবে জাগরূক। উপরে বর্ণিত কাহিনিসূত্রটি এই বইয়ের দ্বিতীয় গল্প ‘অভিন্ন’-র। এই গ্রন্থের মোট ১৬টি গল্পের প্রায় সব ক’টিতেই সেই স্মৃতি যেন ক্রমে ক্রমে বর্ণিত হয়েছে। আরও একটা বিষয়, সব ক’টি কাহিনির কেন্দ্রীয় বা কথক চরিত্র নারী। গা ছমছমে একটা দীর্ঘ যাত্রা ঘটে এ বই পড়লে। নারীর নিজস্ব অমঙ্গল ভাবনা, নিজস্ব মনোগহিন মনে করিয়ে দেয় দেবারতি মিত্রের কবিতার কথা। সেখানেও বার বার উঠে আসে নারীচৈতন্যে হঠাৎ হানা দেওয়া অচেনা জগতের ছায়া।
একে অ্যাকাডেমিক অর্থে ‘ফেমিনিজম’-এর ছকে দেখা হয়তো ঠিক হবে না। পশ্চিমি অভিধায় বিষয়টিকে দেখতে গেলে মনে হতে পারে, এই কাহিনিমালার কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলি ‘সাইকিক’ বা অতীন্দ্রিয় বোধসম্পন্ন। এক জন সাইকিককে বুঝতে পারেন আর একজন সাইকিকই। এই বইয়ের প্রথম গল্প ‘জ্যোৎস্নার পাখি’-তে সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন লেখিকা। আর প্রায় সব গল্পেই তিনি স্বয়ং কেন্দ্রীয় নারীচরিত্রের সমব্যথী হয়ে উঠছেন। সাবলীল কলমে অত্যন্ত যত্নে ধরা থাকছে সেই অন্তর্বেদনা।
গল্প থেকে গল্পান্তরে এগিয়েছে এই ‘সমান্তরাল’ ভুবনের কথা। দু’একটি গল্প ব্যতিক্রম। যেমন ‘মামার বাড়ির সেই তেনারা’। এই গল্পে ইহজগতের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ‘তেনাদের’ বা পরলোকগত আত্মাদের জগৎ। কিতু এই ‘তেনারা’ মোটেই ভীতিপ্রদ নন। বরং তাঁরা খুবই বন্ধুভাবাপন্ন। কোথাও যেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে মনে পড়ায় এই গল্পের ভূতেরা। পড়তে পড়তে মনে পড়ে যেতে পারে ‘গন্ধটা খুব সন্দেহজনক’-এর কথা। কিন্ত এ ক্ষেত্রে পরিমণ্ডলটা একে বারেই আলাদা। ঘটনা ঘটে চলেছে একটি মেয়ের সঙ্গে, আর ভূতেরাও তারই প্রয়াত আত্মীয়স্বজন। গল্পের মধ্যে যে জগৎ লুকিয়ে রয়েছে তা অধুনালুপ্ত একান্নবর্তী পরিবারের আন্তরিকতা এবং তা এক নারীর দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ধাবমান এক স্নেহের প্রবাহ। কাহিনির ভিতরে একটা মোচড়ও রয়েছে। সেটা অনুল্লেখিতই থাক।
বাংলা অতিলৌকিক সাহিত্যে এই মুহূর্তে বিপুল জোয়ার। ‘তন্ত্র’-কে উপজীব্য করে অতিপ্রাকৃত কাহিনির ঢল নেমেছে বাংলা বই-বাজারে। সেই সব কাহিনির বেশিরভাগই অতিমাত্রায় ‘ভয়’-এর অবতারণা করতে নানান আজগুবি বিষয়ের উপস্থাপনা চলছে। তন্দ্রা একটি কাহিনিতেও সে রাস্তায় হাঁটেননি। বরং এমন একটি ‘লোক’-কে তিনি নিয়ে এসেছেন, যা বঙ্গসাহিত্যে বিরল।
এই কাহিনিমালা পড়তে বসে অতিপ্রাকৃত বা পরাবাস্তব সাহিত্যের পোড় খাওয়া পাঠকের মনে পড়ে যেতে পারে এই রসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক আমেরিকান লেখক হাওয়ার্ড ফিলিপ লাভক্র্যাফটের লেখা ‘ড্রিম সাইকল’ কাহিনিমালার কথা। যেখানে র্যানডলফ কার্টার নামে একটি চরিত্র স্বপ্নের মাধ্যমে প্রবেশ করে একটি বিশেষ জগতে, যার যুক্তিকাঠামো চেনা পৃথিবীর চেয়ে একবারেই আলাদা। সেই জগতের অধীশ্বর ‘আজাথথ’ নামের কেউ, যাকে সম্ভবত বর্ণনাই করা যায় না। তন্দ্রার ‘সমান্তরাল’ কাহিনিমালাতেও তেমনই এক ভিন্ন যুক্তির জগতের আভাস। সেই জগতের অধিপতি হিসেবে এক অদ্ভুত মূর্তির আভাস। এবং সেই জগৎ ও সেই মূর্তি বার বার ফিরে আসে। আজাথথের অবর্ণনীয় প্রকৃতির সঙ্গে সেই মূর্তির কোনও মিলই নেই। শুধু এক ভিন্ন জগতের, ভিন্ন যুক্তির রাজ্যের কথা মনে করিয়ে দেওয়া ছাড়া। লাভক্র্যাফটের সেই জগৎ মহাজাগতিক ভয়কে পাঠকের সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু তন্দ্রার লেখনীতে তার বদলে রয়েছে বাঙালির পারিবারিক আন্তরিকতা। মাঝে মাঝেই তাঁর রসবোধ মনে করিয়ে দেয় লীলা মজুমদারের ‘সব ভূতুড়ে’ বইয়ের ‘পেনেটিতে’ বা ‘পিলখানা’-র মতো গল্পকে। এই আন্তরিকতা বাংলা অতিপ্রাকৃত সাহিত্যে বিরল। শরদিন্দুর ‘ভূত-ভবিষ্যৎ’ নামের গল্পে দেখা গিয়েছিল এই ধরনের রসবোধ। চেনা যুক্তিকে অতিক্রম করে ‘লেখকদাদু’ পাঠককে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘অন্য যুক্তির’ পরাবাস্তবে। এখানে তন্দ্রা তাঁর প্রথম বইতেই লক্ষ্যভেদ করেছেন। বাংলা অতিপ্রাকৃত সাহিত্যে মূল্যবান সংযোজন ‘সমান্তরাল’।
সমান্তরাল/ তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়/ জয়ঢাক/ ২৮০ টাকা