Bank Loan

এক ফালি ছাদের স্বপ্ন

পাকাপাকি ছাদ তো সকলেরই স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন সফল করার জন্য অনেককে জীবনের দীর্ঘ একটা সময় ধরে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। তাই সেই লড়াই শুরুর আগে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা ভাল। পরামর্শ দিচ্ছেন শৈবাল বিশ্বাসপাকাপাকি ছাদ তো সকলেরই স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন সফল করার জন্য অনেককে জীবনের দীর্ঘ একটা সময় ধরে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২০ ০২:৪৫
Share:

সারা দিনের খাটাখাটনির শেষে যেখানে ফিরি, সেই ঠাঁইটা একেবারে নিজের তো হতেই হবে। যাঁদের থাকে না, তাঁদের লড়তে হয় অনেক। বছর ৩০ আগের কথাই মনে করুন তো! ঋণ নিয়ে বাড়ি কেনার চল তো ছিল না তখন। বহু মানুষকে দেখেছি পরিবারের জন্য ছাদটুকু নিশ্চিত করতে গিয়ে সঞ্চয়ের শেষ কড়িটুকু তুলে নিতে। তাতে বাড়ি তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু অবসর জীবনটা হয়ে পড়েছে ঝুঁকিপূর্ণ। এখন পরিস্থিতি অন্য। যোগ্যতা থাকলে ঋণ পেতে তেমন সমস্যা হবে না। নিঃশেষ হবে না সঞ্চয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মাথার উপরে বোঝা হয়ে থাকবে বিপুল ঋণ। সে উদ্বেগ আবার আলাদা।

Advertisement

তাই ঋণের সুবিধা যতই থাকুক না কেন, সেই বোঝা কী ভাবে কিছুটা হাল্কা হতে পারে, বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার আগে কী কী বিষয় মাথায় রাখা উচিত, তা নিয়েই আজ সংক্ষেপে আলোচনা করব। যাতে টাকা ঢেলে ফেলার পরে আফশোস করতে না-হয়।

Advertisement

আগে পরিকল্পনা

যে কোনও কাজ শুরুর আগেই পরিকল্পনা জরুরি। এখানে পরিকল্পনা বলতে মূলত আর্থিক পরিকল্পনা এবং ঠিকঠাক বাড়ি বা ফ্ল্যাট নির্বাচনের কথাই বলছি। ব্যাপারটা শুনতে যতটা সোজা লাগে বাস্তবে করে ফেলা কিন্তু ততটাই কঠিন। প্রস্তুতিটাও নেওয়া উচিত যথেষ্ট সময় হাতে রেখে। কারণ প্রথমত, শুরুতেই এক বারে অনেকটা টাকা জোগাড়ের প্রশ্ন রয়েছে। ডাউন পেমেন্ট, রেজিস্ট্রেশন ফি-সহ আরও বেশ কিছু খরচ জোগাড় করতে হয়। দ্বিতীয়ত, প্রতি মাসে নিশ্চিত করতে হবে ঋণ শোধের কিস্তি। এমনিতে ভাড়া বাড়িতে মাসে যে টাকা গুনতে হয়, ফ্ল্যাটের ইএমআই কিন্তু তার তুলনায় অনেকটাই বেশি। তার পর তো সংসার খরচ, সঞ্চয়, বিমার প্রিমিয়াম মেটানো, আরও সব কিছু। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা কম চাপের নয়।

আবার অন্য দিকে ধরা যাক, আপনার ইতিমধ্যেই নিজের ছাদ আছে। আরও একটি ফ্ল্যাট কিনতে চান সম্পদ তৈরির লক্ষ্যে। তা হলে সমীকরণটা আবার আলাদা। কিছু দিনের জন্য সেই ফ্ল্যাট ভাড়াও দিতে পারেন। তা হলে ইএমআইয়ের খানিকটা অংশ উঠে আসবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির আর্থিক মূল্যও বাড়বে। তবে উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, তার জন্য পরিকল্পনা সাজাতে হবে কয়েকটি ধাপে।

বাজেট গুরুত্বপূর্ণ

রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বা বাজার করার সময়ে অনেক কিছুই তো পছন্দ হয়। তাই বলে সবই কি আমরা কিনে নিই? নিশ্চয়ই না। কারণ, অপ্রয়োজনীয় খরচ করে নিজেদের এবং পরিবারের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিতে পারি না আমরা। ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। বাছাই করার সময়ে অনেক ফ্ল্যাটই পছন্দ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাজেট ছাপিয়ে গেলে ঝুঁকি না নেওয়াই উচিত।

ডাউন পেমেন্টের প্রস্তুতি

বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে হলে আজকের দিনে ব্যাঙ্ক ঋণ কার্যত অবশ্যম্ভাবী। এক বারে পুরো টাকা নগদে দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা এখন সচরাচর দেখা যায় না। তবে শুরুতে একটা বড় অঙ্ক ডাউন পেমেন্ট হিসেবে দিতেই হয়। ন্যূনতম ডাউন পেমেন্টের হিসেব এক এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক এক রকম। সাধারণত তা ১০%-২৫% হয়। অর্থাৎ, ৬০ লক্ষ টাকা দামের ফ্ল্যাটের ন্যূনতম ডাউন পেমেন্ট ৬ লক্ষ টাকা থেকে ১৫ লক্ষ টাকা হতে পারে। তবে আমার পরামর্শ, ক্ষমতা অনুযায়ী যতটা বেশি সম্ভব ডাউন পেমেন্ট দেওয়ার চেষ্টা করুন। সে ক্ষেত্রে মাসে মাসে ইএমআইয়ের বোঝা কিছুটা কমবে। তবে সেই ডাউন পেমেন্টের অঙ্ক যতই হোক না কেন, যাবে তো আপনার পকেট থেকেই। তাই তা জমানো শুরু করুন ফ্ল্যাট কেনার পরিকল্পনার দিন থেকেই। দেখে নিন ইতিমধ্যেই সঞ্চয় করা তহবিলের কতটা এই খাতে খরচ করা যেতে পারে। ডাউন পেমেন্টের অঙ্ক কিছুটা বাড়াতে বিনোদন-সহ বিভিন্ন খাতে খরচ কমাতেই হবে।

শুরুর অন্যান্য খরচ

এমন কয়েকটি খরচ রয়েছে যেগুলো শুরুতেই করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে স্ট্যাম্প ডিউটি, রেজিস্ট্রেশন, বিদ্যুৎ এবং জলের যোগাযোগ, বিমা, আইনি খরচ। এর হিসেব ডাউন পেমেন্টের সঙ্গেই করতে হবে।

মাসিক কিস্তির উৎস

ডাউন পেমেন্টের বড় অংশ সাধারণত আসে দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় থেকে। ইএমআইয়ের প্রধান উৎস কিন্তু মাসের রোজগার। তাই হিসেব কষুন কিস্তি হিসেবেই বা কত টাকা গোনা সম্ভব আপনার পক্ষে। ইএমআইয়ের অঙ্ক যেন তাকে ছাপিয়ে না-যায়। মাসের শুরুতে সেই টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সংসারের খরচটাও তো টানতে হবে। নয় কি? হিসেব কষার সুবিধার জন্য ইন্টারনেটে ইএমআই ক্যালকুলেটরের সাহায্য নিতে পারেন। ডাউন পেমেন্টের বন্দোবস্ত হয়ে গেলে প্রত্যেক মাসে ইএমআইয়ের টাকা অন্য একটি অ্যাকাউন্টে সরিয়ে রাখার রিহার্সাল কিন্তু শুরু করে দিতে পারেন ফ্ল্যাট কেনার আগে থেকেই।

বস্তুত ডাউন পেমেন্ট, রেজিস্ট্রেশন এবং ইএমআইয়ের হিসেবটা কষে নেওয়ার পরেই কিন্তু আপনার গোটা বাজেট পরিকল্পনা শেষ হচ্ছে।

কী ধরনের আবাসন

বাড়ি নাকি ফ্ল্যাট? বেডরুম বা বাথরুম ক’টা করে? কমপ্লেক্স নাকি কমপ্লেক্স ছাড়া? গাড়ি রাখার জায়গা, সুইমিং পুল, ক্লাব দরকার কি? শহরের ভিতরে নাকি একটু বাইরে হলেও চলবে?

পরিকল্পনার সময়ে এই সমস্ত ব্যাপারেও কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, পরিবারের সদস্যদের কী কী সুবিধা প্রয়োজন তা এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তা ছাড়া খরচের ব্যাপার রয়েছে। যেমন, পার্কিংয়ের জায়গা কিনলে বাজেটে তা যোগ হবে। ক্লাব থাকলে প্রত্যেক মাসে তার বাড়তি খরচ রয়েছে। আবার শহরের একটু বাইরে ফ্ল্যাট কিনতে পারলে তার দাম কিছুটা কম হবে। সে ক্ষেত্রে আবার পরিবহণের সুবিধা কেমন সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার।

ঠিক জায়গায় জমান

আগেই বলেছি ফ্ল্যাট কেনার পরিকল্পনা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে টাকা জমানোও শুরু করতে হবে। তবে একটা ব্যাপার মাথায় রাখুন। তা হল সেই টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে রেখে দেওয়ার বদলে এমন কোনও সঞ্চয় প্রকল্পে রেখে দেওয়া ভাল যেখানে তা সুদে কিছুটা বেশি বাড়বে। যেমন, সেভিংস অ্যাকাউন্টে রাখলে যেখানে ৩%-৩.৫% সুদ মেলে, সেখানে রেকারিং অ্যাকাউন্টে তা মিলতে পারে ৬ শতাংশের কাছাকাছি। মিউচুয়াল ফান্ডে হয়তো আরও কিছুটা বেশি। তবে মিউচুয়াল ফান্ডে কিছুটা ঝুঁকিও রয়েছে। এই সমস্ত বিষয় মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিন।

ক্রেডিট স্কোর

অতীতের ঋণ শোধের পারফরম্যান্সের উপর আপনার ক্রেডিট স্কোর নির্ভর করে। তা ভাল হলে (৭৫০-এর বেশি) সহজে এবং কম সুদে ঋণ পেতেও আপনার সুবিধা হবে। তাই গৃহঋণ নেওয়ার আগে অন্যান্য ঋণ শোধ করে দেওয়ার চেষ্টা করুন। স্কোর ভাল হলে কম সুদে ঋণ পেতেও যেমন সুবিধা হবে, তেমনই কমবে দেনার বোঝা।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন আপনি ২০ বছরের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা ঋণ নিচ্ছেন। সুদের হার ৮%। সে ক্ষেত্রে পুরো মেয়াদে আসল এবং সুদ মিলিয়ে আপনাকে ১ কোটি টাকার কিছু বেশি শোধ করতে হবে। কিন্তু যদি সুদের হার ৭.২% হয়? তা হলে কিন্তু আপনার খরচ হবে ৯৪ লক্ষ ৪৮ হাজার টাকা। পার্থক্যটা কম নয়। কিছুটা কম সুদে ঋণ পাওয়ার জন্য তাই ক্রেডিট স্কোর ভাল রাখা দরকার।

কোথায় সুদ কম

ঋণ নেওয়ার আগে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদের হার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া উচিত। কোথায় সুদের হার অপেক্ষাকৃত কম। দেখে নিন প্রসেসিং ফি, লেট ফি কত। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কগুলি বিনা প্রসেসিং ফি-তে ঋণ দেয়। সুদের হার কম থাকলে সেই সুযোগ নেওয়া যেতে পারে।

কর ছাড়ের সুবিধা

আয়কর আইনের ২৪ নম্বর ধারায় (পুরনো আয়কর কাঠামোয়) গৃহঋণে বছরে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সুদ মেটানোয় কর ছাড়ের সুবিধা পাওয়া যায়। আবার ৮০সি ধারায় ১.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আসল মেটানোর ক্ষেত্রে ওই ছাড় দাবি করা যায়।

ফ্ল্যাট নির্বাচন

• দামে জোর: প্রোমোটার বা ব্রোকার ঠিকঠাক দাম দাবি করছেন কি না সেটা যাচাই করা জরুরি। এর জন্য ওই এলাকার অন্যান্য আবাসনের দামের ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে।

• রেকর্ড: কেনার আগে ফ্ল্যাটের টাইটেল ডিড খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে নেওয়া দরকার। দেখা দরকার বিদ্যুৎ, জল-সহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র রয়েছে কি না। এর জন্য আইনজীবীর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। গৃহঋণ নিলে অবশ্য ব্যাঙ্কই এই সমস্ত খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে নেয়।

• কবে হাতবদল: প্রতিশ্রুতির চেয়ে দেরিতে ফ্ল্যাট হাতবদল করা ইদানীং কার্যত নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই নির্মীয়মান ফ্ল্যাট হলে জেনে নিন কত দিনের মধ্যে তা হাতে পাওয়া যাবে। চুক্তিপত্রে তা যেন থাকে। সাধারণত যে কোনও ডেভেলপার বাড়তি ছ’মাস সময় চায়। তবে তার চেয়েও দেরি হলে বিল্ডারের ক্রেতাকে জরিমানা দেওয়ার কথা।

• বিশ্বাসযোগ্যতা: বিল্ডারের পেশাদারি বিশ্বাসযোগ্যতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে তা খারাপ হলে ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি সেই সংস্থার প্রকল্পে ঋণ দিতে চায় না। এ ব্যাপারেও খোঁজ নেওয়া দরকার।

• চুক্তিপত্র: ফ্ল্যাট নির্বাচনের পর অল্প কিছু টাকা দিয়ে সেটি বুক করতে হয়। মেলে অ্যালটমেন্ট লেটার। এর পরে ক্রেতা, বিক্রেতা এবং ঋণদাতা ব্যাঙ্কের মধ্যে একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়। সই করার আগে কিন্তু সেই চুক্তির খসড়া ভাল করে পড়ে নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে পেশাদার আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। জেনে নেওয়া উচিত জিএসটি-সহ অন্যান্য অতিরিক্ত খরচের বিষয়গুলিও।

• বিভিন্ন সুবিধা: আগামী দিনে যেটা আপনার স্থায়ী বাসস্থান হতে চলেছে তার আশেপাশের এলাকা কেমন তা ভাল করে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। বাজার, হাসপাতাল, পরিবহণ-সহ প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো, নিরাপত্তা কেমন, সে ব্যাপারে খোঁজ নিন।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement