এই সরকারের আগের চলেই চলতি বাজেটেও হেঁটেছেন অর্থমন্ত্রী। ছবি: সংগৃহীত।
অবশেষে তাই হল। আগের সব সরকারের মতো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অর্থমন্ত্রীও ২০২৪ সালের নির্বাচন মাথায় রেখে ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষের বাজেট প্রস্তাব পেশ করলেন। আপাতদৃষ্টিতে। এই লেখার সময় পর্যন্ত বাজেটের আয় এবং ব্যয় প্রস্তাব হাতে আসেনি। কিন্তু সংসদে যা বললেন তা কিন্তু এই সরকারের চল থেকে খুব একটা আলাদা নয়। আর তা হল পরিকাঠামো বিনিয়োগ এবং সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে আরও বেশি করে বেসরকারি বিনিয়োগের উপর নির্ভর করা। বাজেট নিয়ে উত্তেজনা প্রশমিত হলে এবং আরও তথ্য হাতে এলে হয়তো মনে হবে যে যতটা ব্যতিক্রমী বা নির্বাচনমুখী মনে করা হচ্ছিল ততটা উত্তেজিত হওয়ার জায়গা তৈরি করতে পারেননি নির্মলা সীতারামন। বরং এই সরকারের আগের চলেই চলতি বাজেটেও হেঁটেছেন অর্থমন্ত্রী।
প্রথমেই ধরা যাক আয়করের কথা। নতুন আয়কর ব্যবস্থা পুরনোর পাশাপাশি চালু করার সময়ই মনে করে হয়েছিল যে পুরনো ছাড়কে বাতিলের খাতায় তুলে দেওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। অর্থমন্ত্রী তাঁর এই বাজেট প্রস্তাবে সেই আশঙ্কাকেই সত্যি প্রমাণ করলেন। এত দিন পুরনো আয়কর ব্যবস্থাই ছিল প্রাথমিক। নতুন ব্যবস্থা পছন্দ হলে করদাতা সেই পথেও হাঁটতে পারতেন। কিন্তু এই বাজেটে তিনি গোটা ব্যবস্থাটাকেই বদলে দিয়ে নতুন আয়কর ব্যবস্থাকেই প্রাথমিক করে পুরনো ব্যবস্থাকে পছন্দের খাতায় লিখে দিলেন। তাই একে নির্বাচনমুখী কতটা বলা যাবে তা নিয়ে সংশয় থাকল।
তবে এই ব্যবস্থার যৌক্তিকতা নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে। একদল বলবেন পুরনো ব্যবস্থায় সঞ্চয়ে উৎসাহ দেওয়ার একটা সুযোগ ছিল। কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় সেই জায়গাটা নেই। কিন্তু আরও বড় প্রশ্ন হল নতুন ব্যবস্থায় সাত লক্ষ টাকা পর্যন্ত কর দিতে হবে না। আগে যে ছাড় ছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। কিন্তু আমরা যদি মেনে নিয়ে থাকি যে যাঁরা বাৎসরিক আয় আট লক্ষ টাকা পর্যন্ত আর্থিক ভাবে দুর্বল তা হলে এই ছাড় কি আট লক্ষ টাকায় নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল না? অর্থমন্ত্রী তাঁর আয়করের নতুন কাঠামো করার যাত্রা সম্পূর্ণ করলেন। এটা তাঁর লক্ষ্যপূরণ। কিন্তু সাধারণ করদাতাদের প্রাপ্তিলক্ষ্যের যুক্তিতে এটা কতটা সঠিক তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। তাই এই ছাড়কেও কি সেই লাভ বলে মনে করা যাবে যা বাস্তবকে ছাপিয়ে যায়?
একই সঙ্গে এটাও মানতে হবে যে সবুজ শক্তির ক্ষেত্রে যে বিরাট পরিকল্পনা অর্থমন্ত্রী প্রস্তাব করেছেন তা প্রশংসনীয়। বিশেষ করে হাইড্রোজেন নির্ভর শক্তির ব্যবহার এবং তার রফতানির লক্ষ্যকে হাততালি দিতেই হবে। কিন্তু তা কী ভাবে হবে তা কিন্তু এই বাজেটে পরিষ্কার নয়। তাই এখানেও কিন্তু মন্তব্যকে জিজ্ঞাসা চিহ্ন দিয়েই শেষ করতে হবে।তবে বাজেটকে যদি অর্থমন্ত্রীর চোখ দিয়ে দেখতে হয় তা হলে চিত্রটা বোধহয় এ রকম দাঁড়ায়। আগামী দিনে দেশকে যদি বিশ্বের প্রথম সারির দেশ হিসাবে এগিয়ে যেতে হয় তা হলে
ক) দেশের গবেষণা কেন্দ্রগুলিত দেশজ প্রযুক্তি তৈরি করতে হবে
খ) উৎপাদন শিল্পের বৃদ্ধির হার বাড়াতে হবে এবং বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় জিততে হবে
গ) কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ বাড়াতে হবে
ঘ) আধুনিক শিক্ষাকে প্রত্যন্ত গ্রামেও প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৌঁছে দিতে হবে
ঙ) পর্যটন শিল্পকেও আধুনিক করে তুলতে হবে
চ) আর দেশের যুব শক্তিকে আধুনিক শিল্পের যোগ্য করে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে
ছ) জীবন যাপনের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম নীতি পালন সহজতর করে তোলা।কিন্তু পাশাপাশি যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তা হল গবেষণার উপর যে জোর অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবে শোনা গিয়েছে তার সঙ্গে অভিজ্ঞতা মিলছে না। যদি মিলত তা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিন্দে গবেষণার বাজেটে কোপ পরার গুজব এত কর্ণবিদারক হয়ে উঠতে হত না।
কিন্তু বাজেট আলোচনা কোষাগারের ক্ষমতা ছাড়া করা যায় না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে অর্থ মন্ত্রক মনে করছেন যে বিগত বছরে নাগরিক বাজারে যে ভাবে খরচ করেছেন সেই হার বজায় রেখে বাজারের খরচ আরও বাড়বে। কিন্তু এটাও মনে করার কারণ আছে যে কোভিডের সময় বাজার বন্ধ থাকার কারণে চাহিদাকে সিন্দুকে বন্দি করে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন সবাই। কিন্তু গত বছরে সিন্দুক খোলার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রবণতা বন্যার মতো বাজারে আছড়ে পড়েছিল। কিন্তু ইতিমধ্যেই সেই বন্যা সাধারণ স্রোতে পর্যবসিত হয়েছে। আর তাই যে বৃদ্ধির কথা ভেবে এই বাজেটের অঙ্ক কষা হয়েছে সেই বৃদ্ধির হার বজায় থাকবে তো? যদি না থাকে তা হলে বাজেট অঙ্ককে নতুন করে কষতে হতে হবে।
বাজেট নিয়ে নির্দিষ্ট মন্তব্য করতে হলে বাজেট যে ভাবে পড়তে হয় সেই সময় এই লেখার সময় পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে এই বাজেটে নিশ্চিত ভাবেই লালফিতের চাপ কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে যেমন, কেওয়াসি-র সরলীকরণ। তাতে আপাতদৃষ্টিতে একে বোধহয় আমলার বাজেট হিসাবেই অভিহিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী একে ঐতিহাসিক অভিহিত করেছেন। দেখা যাক সময় কী বলে।