Barrackpore had Asia’s first Zoological Garden in British era dgtl
History
আজকের আলিপুর নয়, এশিয়ার প্রাচীনতম চিড়িয়াখানার ঠিকানা ছিল গঙ্গাপারের এই শহর
লর্ড ওয়েলেসলি চেয়েছিলেন এশীয় জীবজন্তু সম্বন্ধে ইউরোপীয়দের ধারণা তৈরি করতে। তাই তিনি বেশ কিছু প্রাণী সংগ্রহ করেছিলেন ব্যারাকপুরে। পরে তাদের জায়গা হয়েছিল ব্যারাকপুর চিড়িয়াখানাতে।
অর্পিতা রায়চৌধুরী
কলকাতাশেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১১:২৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৪
শীতকাল মানে চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানা মানেই আলিপুর। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ছবিটা এ রকম ছিল না। ঔপনিবেশিক কলকাতার একমাত্র চিড়িয়াখানা ছিল ব্যারাকপুরে। উনিশ শতকের গোড়ায় তৈরি হওয়া সেই চিড়িয়াখানা ছিল এশিয়ার মধ্যে প্রাচীনতম। বয়সের হিসেবে সে লন্ডন পশুশালার থেকেও পুরনো।
০২১৪
১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যারাক তৈরি হয়েছিল এখানে। সেখান থেকেই তা ব্যারাক-এর শহর বা ব্যারাকপুর। তার আগে এই জনপদের নাম ছিল চানক। তবে এর সঙ্গে জোব চার্নকের কোনও সম্পর্ক নেই। চাণক্য বা সংস্কৃত ভাষার আরও একটি শব্দ ‘চানক’ থেকেই এর নামকরণ হয়েছিল। চানক কথার অর্থ ছোলা। এই ‘চানক’ থেকেই ‘চানাচুর’ শব্দের জন্ম।
০৩১৪
আজকের তুলনায় কয়েকশো গুণ বেশি নির্জন হলেও কলকাতায় থাকতে থাকতে দমবন্ধ হয়ে আসত ব্রিটিশদের। স্বাদ বদলাতে তাঁরা যেতেন গঙ্গার তীরে আর এক জনপদ ব্যারাকপুরে। এখানে ছিল কলকাতার লাটসাহেবের বাগানবাড়ি। তার সঙ্গেই জন্ম লাটবাগান এবং চিড়িয়াখানা।
০৪১৪
ম্যাকফারসন বা কর্নওয়ালিশের সময় থেকেই বাগানবাড়ি হিসেবে জনপ্রিয় হয় এই জনপদ। তবে এর প্রাণপুরুষ লর্ড ওয়েলেসলি। ১৭৯৮ থেকে ১৮০৫ অবধি তিনি ছিলেন ভারতের গভর্নর জেনারেল। তিনি লন্ডনের আদলে সাজিয়েছিলেন ব্যারাকপুরকেও।
০৫১৪
সেনাছাউনি হওয়ার জন্য ব্যারাকপুরে কম্যান্ডার-ইন-চিফ-এর একটি বাড়ি ছিল। কিন্তু ওয়েলেসলির সেটিকে নিতান্ত মামুলি বলে মনে হয়েছিল। তিনি সেটিকে ভেঙে নতুন বাংলো তৈরি করান ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে। পাশাপাশি একটি বিশাল প্রাসাদও তিনি তৈরি করিয়েছিলেন।
০৬১৪
সেই প্রাসাদের ভিতটুকু পর্যন্ত তৈরি হয়েছিল মাত্র। তার পর খরচ দেখে ভয় পেয়ে যান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে শেষ হল ওয়েলেসলির কার্যকালের মেয়াদ। তত দিনে ব্যারাকপুরে শোভা পাচ্ছে তাঁর তৈরি বাংলো নামক প্রাসাদ এবং ২৫০ একর জমির উপরে বাগান ও চিড়িয়াখানা।
০৭১৪
তাঁর দ্বিতীয় প্রাসাদটি অসমাপ্তই থেকে যায়। পরবর্তী লাটসাহেবরা থাকতেন বাংলো থেকে প্রাসাদে রূপান্তরিত হওয়া বাড়িতেই। সিপাহি বিদ্রোহের আগুন জ্বললেও ব্যারাকপুর বরাবরই সাহেবদের প্রিয় অবসরযাপনের জায়গা ছিল। সপ্তাহান্তে ছুটি থেকে মধুচন্দ্রিমা— ব্যারাকপুর ছিল সাহেবদের পছন্দতালিকার শীর্ষে। লেডি ক্যানিং প্রয়াত হয়েছিলেন এখানেই। তাঁর শেষশয্যাও রয়েছে এই প্রিয় গন্তব্যেই।
০৮১৪
লর্ড ওয়েলেসলি চেয়েছিলেন এশীয় জীবজন্তু সম্বন্ধে ইউরোপীয়দের ধারণা তৈরি করতে। তাই তিনি বেশ কিছু প্রাণী সংগ্রহ করেছিলেন ব্যারাকপুরে। পরে তাদের জায়গা হয়েছিল ব্যারাকপুর চিড়িয়াখানাতে। মূলত তাদেরই ঠিকানা ছিল এই পশুশালা, যা তৈরি করা হয়েছিল ১৮১৭ থেকে ১৮১৯ সালের মধ্যে। তারও প্রায় ১ দশক পরে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়েছিল লন্ডন চিড়িয়াখানা।
০৯১৪
বাঘ, ভালুক, হাতি, লেপার্ড, বাইসন, ক্যাঙারুর পাশাপাশি এই চিড়িয়াখানায় বাসিন্দা ছিল অসংখ্য প্রজাতির বাহারি পাখি। লাটসাহেব রাজকার্যে ব্যস্ত থাকলেও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিনোদনের ঠিকানা ছিল চিড়িয়াখানা। এই চিড়িয়াখানার পিছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করত ব্রিটিশ প্রশাসকরা। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ অবধি এই চিড়িয়াখানার পিছনে প্রচুর অর্থব্যয় হয়েছিল।
১০১৪
তবে শুধুই বিনোদন নয়। ওয়েলেসসি চেয়েছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পড়ুয়ারা ভারতীয় জীবজন্তুদের সম্বন্ধে জানুক। তিনি প্রথমে চেয়েছিলেন কলকাতার গার্ডেনরিচে ‘ন্যাচরাল হিস্ট্রি ইনস্টিটিউশন’ গড়ে তুলতে। কিন্তু শেষ অবধি প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করা যায়নি। তার জন্য সংগৃহীত জীবজন্তুদেরই পাঠানো হয়েছিল ব্যারাকপুরে।
১১১৪
চিড়িয়াখানার তত্ত্বাবধায়ক এবং গবেষক নিযুক্ত হলেন ফ্রান্সিস বুকানন। উৎসাহী এই পশুতত্ত্ববিদকে সাহায্য করার জন্য ছিলেন চিত্রকর এবং অন্যান্যরা। ইউরোপীয় এবং দেশীয় দু’রকমের চিত্রকরকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই চিড়িয়াখানার আঁকা রঙিন ছবি সযত্নে রাখা আছে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে।
১২১৪
উনিশ শতকের গোড়ায় ওয়েলেসলি বিদায় নেওয়ার পরে এই চিড়িয়াখানার দিন পড়ে এল। তিনি চলে যাওয়ার পরের বছর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলেন বুকাননও। এর পর সেরা সময় হারিয়ে গেলেও চিড়িয়াখানা কিন্তু থেকে গেল। প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে প্রায় পৌনে একশো বছর ধরে ছিল ব্যারাকপুরের চিড়িয়াখানার অস্তিত্ব।
১৩১৪
কিন্তু লর্ড বেন্টিঙ্ক এই চিড়িয়াখানার পিছনে অর্থ ব্যয়ে রাজি ছিলেন না। লর্ড অকল্যান্ডের আমলে তাঁর বোনদের উৎসাহ ছিল এই পশুসংগ্রহ নিয়ে। প্রসঙ্গত এই অকল্যান্ডের বোন এমিল ইডেনের উদ্যোগেই প্রাণ পেয়েছিল ইডেন উদ্যান।
১৪১৪
কিন্তু জিরাফ, বেবুন, বাঘ, সিংহ, ক্যাঙারু এবং হরেক রকমের অজস্র পাখির এই ঠিকানা বদল হয়ে গেল লর্ড লিটনের আমলে। তিনি ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন ১৮৭৬ থেকে ১৮৮০ অবধি। তিনিই ব্যারাকপুর থেকে সব জীবজন্তুকে পাঠিয়ে দেন নবনির্মিত আলিপুর চিড়িয়াখানায়। (ঋণস্বীকার: ‘কলিকাতা’: শ্রীপান্থ; অমিতাভ কারকুন)