উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতা, সেখানে প্রতিদিনই গড়ে উঠছে নিত্যনতুন আড্ডার ঠিকানা।
এক কাপ কফিতে চুমুক সঙ্গে কিছু টুকিটাকি স্ন্যাক্স আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা জমজমাটি আড্ডা। কলকাতাবাসীর কাছে কফি হাউজের আড্ডা যেন এক অন্য নস্টালজিয়া। তবে ওই টুকুই। অন্যান্য পুরোনো কফিখানার আড্ডার ছবিটা আজ যেন কেমন নিষ্প্রভ। পাড়ার রোয়াকে বসে আড্ডা যেন আজ অতীত। নতুন প্রজন্মের কাছে নয়া ক্যাফেগুলির ঠান্ডা ঘরের মেজাজ সঙ্গে ফ্রি ওয়াইফাই আর যতক্ষণ খুশি আড্ডা দেওয়ার দেদার স্বাধীনতা, পুরোনো কফিখানাগুলির তুলনায় অনেক বেশি শ্রেয়। পকেট থেকে একটু বেশি খসলেই বা ক্ষতি কী? কফির স্বাদ আর পরিবেশটাও তো দেখতে হবে বইকি! শুধু কি তাই? নয়া ক্যাফেগুলিতে রয়েছে হরেক রকম থিমের ছোঁয়া।
শেষ কিছু বছরে শহর কলকাতার ছবিটা আমূল বদলে গিয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ, প্রতিদিন গড়ে উঠছে নিত্যনতুন ক্যাফে। এ সব ছোট ছোট কফিখানাগুলির পাশাপাশি শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ক্যাফে কফি ডে, স্টারবাকস, বারিস্তার মত কফিচেনগুলির রমরমাও নেহাত কম নয়। এক পেয়ালা কফি আর সামান্য কিছু স্ন্যাক্স নিলেই এ সব ক্যাফেতে আপনার পকেট থেকে খসে যাবে কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোট। এই ধরনের ক্যাফের যে কোনও একটিতে পা রাখলেই বোঝা যাবে এই ক্যাফেগুলিতে আড্ডাবাজ তরুণ--তরুণীরা রোজ নিয়ম করে যান না।বরং বহুজাতিক সংস্থাগুলির কফি চেনগুলিকে কর্পোরেট মিটিং, বিজনেস টক করার ঠেক বলা যেতেই পারে।
অপর দিকে ছোট ক্যাফেগুলি চালাচ্ছেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীরা।চাকরি খোঁজার পিছনে না ছুটে এই ক্যাফে ব্যাবসার পথকেই বেছে নিয়েছে তারা। বুদ্ধি খাটিয়ে বার করছে নয়া সব বিপণন কৌশল। কেউ নিজের ক্যাফেকে নিছক ঘরোয়া আড্ডার স্পেস হিসেবেই প্রচার করছেন, কেউ আবার নিজের ক্যাফের অন্দরসজ্জায় রেখেছেন ‘আন্তর্জাতিক টাচ্’। খাবারেও রেখেছেন সাহেবি ছোঁয়া।
‘আবার বৈঠক’ ক্যাফের অন্দরসজ্জা(ছবি সৌজন্যে: ফেসবুক)
আড্ডার আমেজ নিতে ঘুরে আসতে পারেন যোধপুর পার্কের ‘আবার বৈঠক’ ক্যাফে থেকে। এই ক্যাফের স্পেশালিটিই হল ফেলুদা আর মগনলালালের ছোঁয়াচ। সঙ্গে আড্ডা। রেস্তরাঁর অন্দরসজ্জা থেকে নানা ডিশের নামকরণ— সবেতেই ফেলুদার প্রসঙ্গ। সত্যজিৎ ও ফেলুদা-ভক্ত স্বরলিপি চট্টোপাধ্যায়ের ভাবনাই এদের ইউএসপি। মজাদার নামের অসম্ভব সুস্বাদু রেসিপি ও অন্দরসজ্জায় রয়েছে তারই ছোঁয়াচ। মেনুতে রয়েছে নানা ধরনের চা, কফি আর মকটেল। তবে খাবারের ভাগেও কম যায় না এই ক্যাফে। চিকেন প্ল্যাটার, গ্রিলড ফিশ লেমন বাটার সস, ফিশ অ্যান্ড চিপস, চকোলেট মেঘরাজ, অরেঞ্জ মোইতোর মতো নানা রকমারি ফিউশন পদ ও পানীয়তে ঠাসা মেনুকার্ড জিভে জল আনবে।
সল্টলেকের ‘ক্যালকাটা ৬৪’ ক্যাফে
বছর চারেক আগে সল্টলেক সেক্টর ওয়ান এলাকায় নিজের বাড়ির নীচেই প্রায় ২০০০ বর্গফিট এলাকা জুড়ে ‘ক্যালকাটা ৬৪’ ক্যাফের যাত্রা শুরু করলেন কর্ণধার দেবজিৎ পাল। কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরুতে থাকাকালীন সেখানকার ‘হার্ড রক’ ক্যাফেতে প্রায়শই বসত দেবজিতের আড্ডার আসর। সেখান থেকেই নিজের একটা ক্যাফে খোলার ভাবনা মাথাচড়া দিয়ে বসল তার। চাকরির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেশ ভালই সামাল দিচ্ছেন ক্যাফের ব্যাবসা। পকেটসই দামে ভাল মানের কফি আর খাবার সার্ভ করাই এই ক্যাফের ইউ এস পি। ক্যাফের মেনুটা সম্পূর্ণ কন্টিনেনটাল। ক্যাপেচিনো, পিনাকোলাটা মকটেল, ফার্স্ট ফ্লাস দার্জিলিং টি, পেরি পেরি চিকেন সিসলার, থিন ক্রাস্ট পিত্জা এই সব কিন্তু এই ক্যাফের মাস্ট ট্রাই। প্রতি শুক্রবার থাকে গান-বাজনার আয়োজনও। এই কয়েক বছরেই ক্যাফেপ্রেমী মানুষের কাছে বেশ ভালই সাড়া ফেলেছে ‘ক্যালকাটা ৬৪’ ।
বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সুন্দর আয়োজন করে রেখেছে দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জে ‘বিউন-দ্য কফি রুম’। ক্যাফেতে ঢুকেই চক্ষু একেবারে চড়কগাছ! টেবিল আছে তবে চেয়ারের পাত্তা নেই! আসলে জাপানি কায়দায় চেয়ারের কাঠামোয় নরম কুশনের উপর বসে নীচু ডাইনিং টেবিলে খাওয়াদাওয়ার আয়োজনেই এই ক্যাফে বাজিমাত করেছে, যা মন কাড়তে পারে আপনারও। ক্যাফেতে বসেও বাঙালি পছন্দ করে পেট ভরানো চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল। শুধু কি তাই? এই ক্যাফেতে আরও পাবেন বাঙালির সাধের সাদা ভাত আর কষা মাংসও। এক ক্যাফেতেই যদি আপনি ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার সবই সারতে পারেন তা হলেই বা মন্দ কী!
হিন্দুস্তান পার্কে কন্টিনেন্টাল খাবার আর নানা ধরনের পসরা সাজিয়ে বসেছে ‘ক্যাফে ড্রিফটার’। গান-বাজনার উপকরণ মজুত। ক্যাফেতে আসেন সব বয়সের মানুষ। রাজরূপ ভাদুড়ি তিন বছর ধরে ব্যবসা করছেন। বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে জেনেই নতুন নতুন পদ তৈরি করছেন তিনি। নিজস্বতা আনতে টাই আপ করেছেন একটি ছোট বেকারির সঙ্গেও।
সুন্দর আয়োজন নজর কাড়বে দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জে ‘বিউন-দ্য কফি রুম’
দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত চা পরিবারের ছেলে শৈলেশ সিংহ সমতলে নেমে এসেছেন ব্যবসার প্রসারে। গোলপার্কের মুখে তাঁর ক্যাফে— দ্য হুইস্টলিং কেটল (দার্জিলিংয়ে তাঁর চায়ের দোকানের নাম নাথমুলস)। এক টুকরো দার্জিলিংকে কলকাতায় তুলে ধরাই তাঁর লক্ষ্য। ক্যাফে নয়, এই একফালি জায়গাটিকে টি-বুটিক বলতেই পছন্দ করেন তিনি। ঢোকার মুখেই ছোট্ট জায়গায় পাওয়া যাবে মকাইবাড়ির প্রথম কুঁড়ি তোলা চা। ঠিক যে খাবারগুলি চায়ের সঙ্গে খেতে ভাল লাগে, এই ক্যাফেতে মিলবে সেগুলিই। দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত আড্ডাখানা গ্লেনারিজের ঢঙে মঞ্চ করা রয়েছে। সেখানে নানা ধরনের গানবাজনার আয়োজন করা হয় সারা বছর।
এ ছাড়াও নজর কেড়েছে গলফ গ্রিনের ট্রাভেলিস্তান ক্যাফেও। রথীন্দ্রনাথ দাস বাইকে করে ১৩টি দেশ ঘুরছেন, তিনি যাত্রা শুরু করেছেন এই ক্যাফে থেকে। ক্যাফেতে সবচেয়ে পপুলার এক ধরনের শরবত— ‘জুজু’। এ ছাড়া মাঝে মাঝেই এখানে বেশ কিছু স্পেশাল ডিশ তৈরি হয়।
অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ কফি হাউস থেকে ক্যাফেটেরিয়ার এই যাত্রাটাকে নিয়ে উৎফুল্ল। “ক্যাফের স্মার্টনেস বাঙালি মধ্যবিত্তের অনেক সেকেলে ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে। ক্যাফে মেয়েদেরও অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে। কলকাতার পুরনো কফিখানায় পুরুষের মৌরসিপাট্টা ছিল। ক্যাফেগুলি তেমন না। তা ছাড়া ক্যাফে আমাদের ডিজিটাল বেঁচে থাকার এই অবস্থাটাকে চ্যালেঞ্জ করে।
আর এর অভিনেতা কৌশির সেনের কথায়: ‘‘কমফর্টের সংজ্ঞাটা বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে রুচির মানে। নতুন জেনারেশন স্টারবাকস, সিসিডি-তেই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। তবে কফি হাউজে এখনও অনেকে যায়। ছোটখাটো আড্ডাঠেকগুলিতেও লোকে যান না এমন নয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ঠেকগুলি নিজেদের বদলাতে পারেনি এ কথাও তো সত্য।’’
পাল্টে যাওয়া কলকাতার রং-রূপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলের চা-পানে নিজস্ব সই রেখে চলেছে এই নতুন ক্যাফেগুলি। সেখানকার ঠেক থেকেও যে আমরা আর কোনও লেখক, পরিচালক বা গীতিকার পাব না তা ভেবে নেওয়া কিন্তু মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়!
তথ্য সহায়তায়: অর্ক দেব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy