বৃহস্পতিবার কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে। ছবি আফগানিস্তানের একটি টিভি চ্যানেলের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে।
বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দাদের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল কাবুল। গভীর রাতে বিস্ফোরণের দায় নিয়েছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এর আগে তালিবানও এক বিবৃতি দিয়ে দাবি করে, এই হামলা আইএসেরই কাজ। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ বিমানবন্দরের কাছে পর পর দু’টি আত্মঘাতী বিস্ফোরণে শিশু-সহ শতাধিক নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ১৩ জন আমেরিকান সেনা। জখম হয়েছেন দেড়শোরও বেশি।
বিস্ফোরণের পরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ভিডিয়ো ফুটেজে দেখা গিয়েছে, রাস্তায় মৃতদেহের স্তূপ, বিমানবন্দরের বাইরের পরিখায় অসংখ্য দেহ ভাসছে। পরে বিমানবন্দরের কাছে ফের একটি বিস্ফোরণ হয়। রাতে বিভিন্ন সূত্রে দাবি করা হয়, বিস্ফোরণ হয়েছে অন্তত ৬টি। গুলির লড়াইও চলছে বলে খবর।
প্রথম বিস্ফোরণটি হয় হামিদ কারজ়াই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ‘অ্যাবি গেটের’ সামনে। এই ফটক দিয়েই এখন বিমানবন্দরের ভিতরে ঢুকছেন দেশ ছাড়ার অনুমতি পাওয়া মানুষেরা। দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি হয় বিমানবন্দরের খুব কাছেই ব্যারন হোটেলের সামনে। এই হোটেলে এখন ব্রিটিশ নাগরিকেরা রয়েছেন। বিমানবন্দরের সামনে বিস্ফোরণের পরে একাধিক দুষ্কৃতী সেখানে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। তাতেও অনেকে জখম হন। এক আফগান স্বাস্থ্য আধিকারিককে উদ্ধৃত করে এক ব্রিটিশ চ্যানেল জানিয়েছে, নিহতের সংখ্যা অন্তত ৭২। হাসপাতালগুলিতে উপচে পড়া ভিড়। আক্রান্তদের মধ্যে বিমানবন্দরের দায়িত্বে থাকা আমেরিকান মেরিন কোরের ১১ জন-সহ মোট ১৩ জন এবং বিমানবন্দরের বাইরে থাকা কয়েক জন তালিবান রক্ষীও রয়েছেন।
১৫ অগস্ট কাবুল-পতনের পর থেকেই বিমানবন্দরে ঢোকার জন্য ভিড় জমাচ্ছেন হাজার হাজার আফগান। প্রতিদিন প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ এই বিমানবন্দর থেকে আফগানিস্তান ছাড়ছেন। আজও সকাল থেকে বিমানবন্দরের ফটকের সামনে জড়ো হয়েছিলেন অনেকে। থিকথিকে সেই ভিড়ের মধ্যেই প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটায় এক আত্মঘাতী জঙ্গি। তার কিছু ক্ষণ পরেই ব্যারন হোটেলের সামনে আর একটি ফিদাইন হামলা হয়। সেখানে ভিড় অপেক্ষাকৃত কম থাকলেও
কয়েক জন গুরুতর জখম হয়েছেন। বিমানবন্দরের বাইরে কে গুলি চালাল তা এখনও স্পষ্ট নয়। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, কয়েক জন জঙ্গিই গুলি চালিয়েছিল। কিন্তু কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের পরে বিশৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি চালান বিমানবন্দরের ফটকের সামনে থাকা তালিবান রক্ষীরাই। আজ রাতে তালিবান মুখপাত্র জ়বিউল্লা মুজাহিদ টুইটারে লিখেছেন, ‘‘কাবুল বিমানবন্দরের ভিতরে নিজেদের জিনিসপত্র নষ্ট করে দিতে আমেরিকান বাহিনীই বিস্ফোরণগুলি ঘটিয়েছে। কাবুলের বাসিন্দারা তা নিয়ে ভাবিত নন।’’
গত কয়েক দিন ধরে পেন্টাগন বারবার সতর্ক করেছিল, যে কোনও সময়ে বিমানবন্দরে হামলা চালাতে পারে আইএস। আজ সকালেই বিশেষ নির্দেশিকা জারি করে কাবুলের আমেরিকান দূতাবাস। আফগানিস্তানে এখনও আটকে রয়েছেন প্রায় ১৩০০ আমেরিকান নাগরিক। আজ সকালে এক বিশেষ নির্দেশিকা জারি করে কাবুলে আমেরিকান দূতাবাস জানিয়েছিল, যাঁরা আজ কাবুল ছাড়ছেন বলে আগে থেকেই ঠিক করা আছে, তাঁরাই যেন শুধু বিমানবন্দরে যান। অন্যরা যেন বিমানবন্দর চত্বর অবশ্যই এড়িয়ে চলেন। একই সুরে ব্রিটেন, ডেনমার্ক ও অস্ট্রেলিয়াও তাদের নাগরিকদের সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিল।
প্রতিদিনের মতো আজও আমেরিকান ও বিভিন্ন আমেরিকান সংস্থায় কাজ করা আফগান ও তাঁদের পরিবারকে নিয়ে আসার জন্য এই বিমানবন্দর থেকে একের পর এক বিমান ছেড়েছে। বিকেলে একটি সি-১৭ বিমান টেক অফ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তখনই বিস্ফোরণ ঘটে। তবে পেন্টাগন সূত্রে জানানো হয়েছে, বিস্ফোরণের আগে ওই বিমানে যাত্রীদের তোলার কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। বিস্ফোরণের কয়েক মিনিটের মধ্যে আমেরিকান বিমানটি কাবুলের মাটি ছাড়ে। বিশেষ বৈঠকে বসেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হোয়াইট হাউস জানায়, জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দেবেন প্রেসিডেন্ট।
গত কয়েক দিন ধরে পেন্টাগন বারবার বলছিল, যে কোনও মুহূর্তে কাবুলের হামিদ কারজ়াই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জঙ্গি হামলা হতে পারে। তাই ৩১ অগস্টের পরে আর সে দেশে আমেরিকান সেনাকে রাখা নিরাপদ নয় বলে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে জানিয়েছিল তারা। আজ ভারতে এক উচ্চ পর্যায়ের সর্বদলীয় বৈঠকেও বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছিলেন, কাবুল বিমানবন্দরে আইএস হামলার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এই ধরনের হামলা হতে পারে ভেবে ভয়ে রয়েছে তালিবানও। বিস্ফোরণের তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি জারি করেছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। আজ সকালে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস হিপি একটি ব্রিটিশ রেডিয়োকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘হামলার আশঙ্কা আদপেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।’’ পরে একটি আমেরিকান চ্যানেল মন্ত্রীকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে, ‘‘আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কি কাবুলে কোনও হামলা হতে পারে?’’ হিপি উত্তর দেন, ‘‘হ্যাঁ, আমাদের গোয়েন্দা-তথ্য সে রকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে।’’ মন্ত্রী আরও জানান, এই হামলা যথেষ্ট বড় আকারের হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এত স্পষ্ট সতর্কবার্তা থাকলেও এই হামলা এড়ানো গেল না কেন? এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে কাবুল বিমানবন্দর ও তার চারপাশের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে। গত কয়েক দিন ধরে এই বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ছাড়ছেন হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু যাঁরা বিমানে উঠছেন, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি মানুষ রয়ে যাচ্ছেন পিছনে। বিমানবন্দরের ভিতরে রয়েছেন প্রায় সাত হাজার আমেরিকান সেনা আর নেটো বাহিনী। তাঁরাই ৩১ অগস্ট পর্যন্ত বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। কিন্তু বিমানবন্দরের বাইরে চূড়ান্ত অরাজকতা। তালিবান রক্ষীরা ভিড় সামলানোর চেষ্টা করলেও বিশেষ সাফল্য মিলছে না। মাঝেমাঝে এই তালিবান রক্ষীরা ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে গুলি চালান। তাতে হুড়োহুড়ি আরও বেড়ে যায়। গত কয়েক দিনে এই বিমানবন্দরের বাইরে ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন অন্তত কুড়ি জন স্থানীয় আফগান।
কাবুল-সহ দেশের প্রায় পুরোটা দখল করে নেওয়া তালিবানের পক্ষে যতটা সহজ ছিল, দেশে সরকার গঠন করা তাদের পক্ষে আদপেই সহজ হচ্ছে না। এই কাজে অন্যতম প্রধান অন্তরায় দেশের উত্তর প্রান্তে পঞ্জশির প্রদেশে নর্দার্ন অ্যালায়ান্সের প্রতিরোধ। তা ছাড়া, তালিবান গোষ্ঠীর বাইরে যে সব ক্ষমতাশালী নেতা রয়েছেন, তাঁদেরও এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না তালিবানের পক্ষে। কয়েক দিন ধরে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজ়াইয়ের সঙ্গে আলোচনা চালানোর পরে আজ তাঁকে গৃহবন্দি করে তালিবান। গৃহবন্দি করা হয়েছে আর এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা, আশরফ গনি আমলের চিফ এগজ়িকিউটিভ অফিসার আবদুল্লা আবদুল্লাকেও। তাঁদের সব গাড়ি বাজেয়াপ্ত করেছে তালিবান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy