প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বাছাই করা কয়েক জন উপদেষ্টাকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিনটি হাজত পরিদর্শন করার পরেও ‘আয়নাঘর’ কোথায়, সেই প্রশ্নের জবাব মিলল না। ইউনূসের এই কর্মসূচিকে ‘আয়নাঘর পরিদর্শন’ বলা হলেও কোথায় সেই বহু আলোচিত বিশেষ কারাগার, তার স্পষ্ট কোনও জবাব মিলল না। ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, র্যাব ও ডিজিএফআই (সেনা গোয়েন্দা)-এর এই হাজতগুলিই ‘আয়নাঘর’। তাঁর কথায়— “শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, সারা দেশে এমন ৭০০-৮০০ আয়নাঘর রয়েছে।”
শেখ হাসিনা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিরোধীদের নির্বিচারে বন্দিশালায় তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেছে গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাব এবং ডিজিএফআই। বিএনপির অভিযোগ, তাঁদের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গোয়েন্দা পুলিশ তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে আর ফিরে আসেননি তাঁরা। এঁদের পরিবারদের নিয়ে আন্দোলনের চেষ্টাও করেছিল হাসিনা আমলের বিরোধী দলটি। ২০১২-র এপ্রিলে সিলেটের বিএনপি এমপি ইলিয়াস আলি ও তাঁর গাড়ির চালককে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আজও তাঁদের কোনও খোঁজ নেই। ইলিয়াস ছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। ২০১৫-র মার্চে উত্তরার বাসভবন থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যায়। তার ৬১ দিন পরে ভারতের মেঘালয়ে সড়কের ধারে তাঁকে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রায় ১০ বছর শিলংয়ে কাটিয়ে মামলায় খালাস পেয়ে দেশে ফিরে ফের দলের কাজ শুরু করেছেন সালাহউদ্দিন। সম্প্রতি এই সব অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে শেখ হাসিনা ও তাঁর দল ও সরকারের অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন বিএনপি নেতৃত্ব। ইউনূস সরকার গুমের অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখতে একটি কমিশনও তৈরি করেছে।
কিন্তু বিদেশ থেকে এক সাংবাদিকের একটি ইউটিউব চ্যানেল প্রথম ‘আয়নাঘর’-এর কাহিনি নিয়ে একটি প্রতিবেদন সম্প্রচার করে, পরে যা প্রচার করে আল জ়াজিরা টেলিভিশন। পরিচয় গোপন করা কয়েক জন জানান, তাঁদের মতো বিভিন্ন জনকে আটক করার পরে একটি বিশেষ বন্দিশালায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে ডিজিএফআই বা র্যাব। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে এই বহুতল বন্দিশালাটি অবস্থিত, যার নাম ‘আয়নাঘর’। এখানে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় বন্দিদের নির্যাতন করার জন্য বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার হয়। খুপরির মতো কুঠুরিতে পাখির মতো ভরে রাখা হয় আটকদের। কেউ কেউ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মারা যান। কাউকে বা দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া হয়। কম্পিউটারে গ্রাফিক চিত্রও তৈরি করা হয় সেই ‘আয়নাঘর’-এর। সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছর ধরেই ‘আয়নাঘর’ নিয়ে প্রবল কৌতূহল তৈরি হয়েছে। এর পরে ৫ অগস্ট অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশছাড়া হওয়ার পরে অনেকেই ভেবেছিলেন, এ বারে ‘আয়নাঘর’-এর রহস্য উন্মোচন হবে।
ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গির আলম চৌধুরীকে প্রায় রোজই শুনতে হয়েছে, ‘আয়নাঘর’ কোথায়। একবার তা খুঁজতেও বেরিয়ে পড়েন উপদেষ্টা। কিন্তু বিফল হয়ে বলেন, “সম্ভবত আয়নাঘর প্রতীকী নাম। তবে সব বাহিনীরই নিজস্ব লক আপ থাকে, রয়েছেও।” ইউনূসের প্রেস সচিব প্রতিশ্রুতি দেন, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের তিনি ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শনের ব্যবস্থা করবেন।
এর পরে হঠাৎ ছ’মাস পরে ইউনূস জানালেন তিনি ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শন করবেন। করেও এলেন। কিন্তু ঢাকার সাংবাদিকদের ডাকা হল না। উপদেষ্টা ও প্রেস সচিব সমাজমাধ্যমে যে সব ছবি দিলেন, তা সাধারণ লক আপের মতোই দেখতে। একটি স্টিলের চেয়ার রেখে বলা হল, বন্দিদের বৈদ্যুতিক শক দিতে সেটি ব্যবহার হত । কিন্তু তা নিয়ে সমালোচনার ঝড়। কারণ সেই চেয়ারে বসিয়ে শক দিলে বন্দির ঝলসে মারা যাওয়া উচিত। পর দিন ইউনূসের প্রেস সচিবকে প্রশ্ন করা হল, কোথায় এই গোপন আয়নাঘর পাওয়া গেল? তিনি জানালেন, উত্তরা, কচুক্ষেত ও আগারগাঁওয়ে র্যাব ও ডিজিএফআই-এর দফতরেই এই ‘আয়নাঘর’। তাদের লক আপই পরিদর্শন করেছেন ইউনূস।
লোকে বলছে, রহস্যভেদ আর হল কই? আসল ‘আয়নাঘর’-টি তা হলে কোথায়?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)