রাম ও হনুমানের নামে কতটা ভোট আসে? দ্বিমত রয়েছে বিজেপিতেও। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রামনবমী পেরিয়ে গেলেও তার রেশ কাটেনি। তার মধ্যেই এসে পড়েছে হনুমান জয়ন্তী। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়ে যাবে নতুন মিছিল, নতুন উন্মাদনা। যা নিয়ে অশান্তির আশঙ্কায় প্রশাসনকে আগাম সতর্ক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সকলের কাছে শান্তি বজায় রাখার আবেদনও জানিয়েছেন তিনি। অমিত শাহের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও সব রাজ্যকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
এমনই এক পরিস্থিতিতে জন্ম হয়েছে এক প্রশ্নের। গোটা দেশে যা-ই হোক না কেন, বাংলায় বিজেপি কি রাম-হনুমানের নামে ভোট পাবে? কালী, দুর্গা, শিবের বাংলায় রাম বা হনুমান কি ‘দেবতা’ হিসাবে সে ভাবে আরাধ্য? না কি বিজেপির এই রাম-পার্বণ আদতে গেরুয়া শিবিরের গায়ে আরও বেশি করে ‘হিন্দিভাষীদের দল’ তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে? বিজেপি কি আসলে একটা ‘ফাঁদে’ পা দিয়ে ফেলেছে? যা থেকে তারা আর বেরোতে পারছে না? হিন্দি বলয়ের আরাধ্য দেবতাদের বাঙালির সঙ্গে আত্মীকরণ করাতে গিয়ে তারা কি বাংলা এবং বাঙালি থেকে আরও দূরে চলে যাচ্ছে?
সাম্প্রতিক বিভিন্ন ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, হিন্দিভাষী এলাকায় বিজেপি যতটা সমর্থন পেয়েছে, তেমনটা অন্যত্র পায়নি। কলকাতা শহরেও পুরভোটে বিজেপি টানা সাফল্য দেখাতে পেরেছে বড়বাজার-কেন্দ্রিক এলাকায়। তবে দলের গায়ে ‘হিন্দিভাষী’ তকমা নিয়ে রাজ্য বিজেপির মধ্যেও মতান্তর রয়েছে। দলের কোনও বড় পদেই এখন আর হিন্দিভাষী রাখা হয় না। মুখপাত্র হিসাবেও বাংলাভাষীদের গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে।
বাংলা এবং বাঙালির রুচি-সংস্কৃতির উপরে বেশি জোর দেওয়া যে উচিত, এমন আলোচনা উঠে এসেছিল গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও। সেই কারণে ভোটের ইস্তাহারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে পুরস্কার থেকে প্রথম বাঙালি মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের উল্লেখও ছিল। কিন্তু ভোট মিটে গেলে বিজেপি ফিরে এসেছে বিজেপিতেই। উত্তর ভারতের পার্বণকে নিয়েই বাংলায় উন্মাদনা তৈরির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। দলের একাংশ মনে করেন, এর ফলে শিক্ষিত শহুরে বাঙালির থেকে বিজেপির দূরত্ব আরও বাড়ছে। বস্তুত, রাজ্য বিজেপির এক নেতার সখেদ মন্তব্য, ‘‘আমরা এই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি। এখন আর বেরোতে পারছি না।’’ যদিও দলের অন্য একটি অংশ মনে করে, ‘জাতীয় দল’ হিসাবে দেশের সর্বত্র একই নীতিতে চলা উচিত দলের। নিজস্ব পরিচয়েই ভোট আসবে।
যদিও বিজেপি প্রকাশ্যে দাবি করে, ভোটের জন্য তারা রামের কথা বলে না। ‘রাষ্ট্রপুরুষ’ হিসাবেই গেরুয়া শিবিরের রাম-আরাধনা। রাম এবং হনুমান পুজো নিয়ে অবশ্য বিজেপি একা নয়, শাসক তৃণমূলও এখন সরব। তবে তাদের বক্তব্য, ধর্মাচার বা উৎসব তো হতেই পারে। তবে বিজেপির মতো ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে না তৃণমূল।
রাজ্যে ধর্মীয় মিছিল ঘিরে গত কয়েক দিনের অশান্তির প্রেক্ষিতে তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। তার থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতেই এ সব নিয়ে মাতামাতি।’’ জবাবে বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘বিজেপি তো মিছিল করেনি। সাধারণ মানুষের মিছিলে দুর্বৃত্তেরা আক্রমণ করায় প্রতিবাদ করা হয়েছে। এটা রামনবমী বা হনুমান জয়ন্তীর মিছিল না হয়ে অন্য কিছু হলেও আমরা একই কাজ করতাম।’’
তবে বিজেপি আসলে তৃণমূলের পাতা ‘ফাঁদে’ পা দিয়েছে বলেও মনে করেন অনেক নেতা। তাঁদেরই একজনের কথায়, ‘‘আগে থেকে রামনবমী বা হনুমান জয়ন্তী নিয়ে তৃণমূল নেত্রী সতর্ক করে দিয়ে আসলে ফাঁদ তৈরি করেন। বিজেপি গোলমাল পাকাতে পারে বলে ওঁর প্রচার আসলে ফাঁদ। তাতেই পা দিয়ে ফেলেছেন আমাদের রাজ্যনেতৃত্ব। এতে লাভের থেকে আখেরে দলের ক্ষতিই বেশি।’’
আমবাঙালির কাছে চৈত্র মানে অবশ্য শিবের মাস। গাজন, চড়কের মাস। সেই সঙ্গে শীতলা, অন্নপূর্ণা, ধর্মঠাকুরেরও মাস। গোটা দেশ যখন নবরাত্রি পালন করে, তখন বাঙালি দুর্গার অন্য রূপ বাসন্তীদেবীর পুজো করে। আবার দুর্গাপুজোর সময়ে আশ্বিনের নবরাত্রিও হয়। বাঙালির কাছে রাম তেমন প্রাধান্য পান না। সেই সময় অকালবোধনের দুর্গাপুজো পান বাঙালির ঘরে এবং বারোয়ারিতে। সেই উৎসবের সঙ্গে গোটা দেশের ঘরানা আলাদা। বাংলার ঘরানায় আশ্বিনে রামের সঙ্গে দুর্গার দেখা হয় মাত্র। তাই তা পালন হয় দুর্গার নামেই। আর অন্যত্র আশ্বিনের নবরাত্রি ও দশেরা রামের নামে পালিত হয়। আসলে তামিল ‘কম্ব-রামায়ণম’, তেলুগু ভাষায় ‘শ্রীরঙ্গনাথ রামায়ণম’, অসমিয়ায় ‘কথা রামায়ণ’, কন্নড় ভাষায় ‘জৈন রামায়ণ’-এর সঙ্গে অনেক ফারাক কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণের। ষোড়শ শতাব্দীতে তুলসীদাসের ‘অওধি’ ভাষায় লেখা ‘রামচরিতমানস’ আবার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল। গোটা হিন্দি বলয় তুলসীদাসের চোখেই রামকে দেখে।
কিন্তু বাংলায় রামের আধিপত্য কবে থেকে হল? অনেকে বলেন, কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিক থেকেই বাংলায় রামের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর লক্ষ্য নেয় গেরুয়া শিবির। অযোধ্যায় রামজন্মভূমি আন্দোলনে এই বাংলা থেকে করসেবক গিয়েছিলেন। এখানেও ‘রামশিলা পূজন’ হয়েছে। তবে সেই সময়ে সবটাই হত বিশ্ব হিন্দু পরিষদের উদ্যোগে। বাংলায় রামের নামে মিছিলকে বড় চেহারা দেওয়া শুরু হয় সঙ্ঘ পরিবার ‘হিন্দু জাগরণ মঞ্চ’ নামে সংগঠন তৈরির পরে। রাজনীতিতে আসার আগে যে সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন এখন বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ। সেই সময়ে বিজেপির সে ভাবে কোনও শক্তিই ছিল না রাজ্যে। সাধারণ হিন্দু সমাজকে নিয়েই তৈরি হয় কাজ। আর বিজেপি দিল্লিতে ক্ষমতায় আসার পরে সেই উদ্যোগ বড় আকার নেয়। একটা সময়ের পরে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা তো বটেই, অনেক জেলা স্তরের নেতাও রামনবমী এবং হনুমান জয়ন্তী পালনের উদ্যোগ নেন।
সেই মিছিলকে বেনামে নিজেদের করে নেওয়ার পিছনে যে বিজেপির ভোটের অঙ্ক ছিল এবং আছে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। ২০১৭ সালে গেরুয়া শিবিরের রামনবমী পালন বড় চেহারা নেয় বাংলায়। এর পরের বছরেই তৃণমূল ঘোষিত ভাবে হনুমান জয়ন্তী পালনে উদ্যোগী হয়। বিভিন্ন শহরে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের জন্য দলীয় ব্যানার নিয়ে জলসত্র করতে দেখা গিয়েছিল তৃণমূলকে। ধীরে ধীরে ‘হনুমানভক্তি’ বাড়তে থাকে তৃণমূলের। অধুনাপ্রয়াত মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে বিধাননগর স্টেশনের কাছে ২৫ ফুটের হনুমান মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ফি বছর ধুমধাম করে পালিত হয় উৎসব। শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের দুর্গাপুজোর জন্য খ্যাত রাজ্যের মন্ত্রী সুজিত বসুর উদ্যোগেও বিধাননগরের জিসি ব্লকে হনুমান জয়ন্তীর আয়োজন দেখা যায়। সেই সময়ে খাতায়কলমে তৃণমূলে থাকা ভাটপাড়ার তৎকালীন বিধায়ক অর্জুন সিংহ থেকে খড়্গপুরের তদানীন্তন পুরপ্রধান তৃণমূলের প্রদীপ সরকার নিয়ম করে রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তী পালন করতেন।
তৃণমূলের উদ্যোগের সবটাই হয়তো স্থানীয় ভোটারদের কথা ভেবে। কিন্তু বিজেপি যেটা চাইছে, তা হল রাজ্যের সর্বত্র ‘রামময়’ পরিবেশ তৈরি করা। এমনটাই মনে করে তৃণমূল। দলের মুখপাত্র কুণালের কথায়, ‘‘বিজেপির কাছে কোনও কর্মসূচি নেই। তাই শুধু ধর্ম-ধর্ম করে। আর আমরা উন্নয়নের কথা বলি। সেটা নিয়ে মানুষের কাছে যাই। আবার মানুষের উৎসবেও অংশ নিই। দুটোর মধ্যে ফারাক রয়েছে। ভোটের জন্য ধর্মকে আমরা প্রাধান্য দিই না।’’ কিন্তু এই উৎসব কি রাজ্যের হিন্দিভাষী ভোট প্রভাবিত করতে পারে? জবাবে কুণাল বলেন, ‘‘সেটা বলতে পারব না। তবে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি কিছু সময়ের জন্য কার্যকর হতে পারে। কিন্তু স্থায়ী ফল দেয় না।’’
এখন রাজ্যের সর্বত্রই হনুমান বা বজরঙ্গবলী মন্দিরের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলার শহরে এবং গ্রামে ষষ্ঠীতলা, মনসাতলা, শীতলাতলা, পঞ্চাননতলা এমনকি পিরতলা থাকলেও হনুমানতলা কোনও কালে দেখা যায়নি। কিন্তু এখন হনুমান দেবতা হয়ে বিরাজ করেন সর্বত্র। বাংলার একটা বড় অংশের মানুষ যে রাম এবং হনুমানে মজেছেন, সেটা চারপাশে ঠাহর করলে বোঝাও যায়। তবে তাঁরা সকলেই যে বিজেপির ভোটার, এমন ভাবার কারণ নেই। যদিও বিজেপি মনে করে, রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তী পালনের মধ্য দিয়ে বাঙালির মধ্যে ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ তৈরি করা যায়। দলের মুখপাত্র শমীকের বক্তব্য, ‘‘শ্রীরামকে বাইরে রেখে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ সম্ভব নয়। ভারতের যে কোনও প্রান্তে গেলেই দেখতে পাবেন, মানুষের লোকাচারে রাম জড়িয়ে রয়েছেন। যাঁরা মনে করেন বাঙালি এর বাইরে, তাঁরা ভুল করছেন। আশ্বিনের শুক্লা চতুর্দশীতে বাঙালি ১৪ শাক খায়, সন্ধ্যায় ১৪ প্রদীপ জ্বালে কেন? আসলে রাম ১৪ বছর বনবাসে ছিলেন বলেই ১৪ রকম শাক খাওয়ার লোকাচার। ১৪ বছর পরে তিনি রাজ্যে ফিরেছিলেন বলেই স্বাগত জানাতে ১৪ প্রদীপ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy