বিপুল ব্যয়ের সংসারে রাজস্ব এবং রাজকোষ ঘাটতি ঊর্ধ্বমুখী। বাড়ছে পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণও। এই অবস্থায় একেবারে নিজস্ব রাজস্ব আদায় কিছুটা করে বাড়লেও, কেন্দ্রীয় অর্থের উপর ধারাবাহিক ভাবে বড় নির্ভরতা রাখতেই হচ্ছে রাজ্যকে। গত পাঁচ বছরের রাজ্য-বাজেট তথ্য বলছে, মোট রাজস্বের অর্ধেকের বেশি আসছে কেন্দ্রীয় করের ভাগ এবং অনুদান মিলিয়ে। কেন্দ্রের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশের একই আর্থিক পরিবেশে অন্য অনেক রাজ্য নিজস্ব রাজস্ব বাড়িয়ে, কেন্দ্রীয় অর্থের উপর নির্ভরশীলতা ক্রমশ কমিয়ে খরচ সামলাচ্ছে। যা তাদের আর্থিক স্বাস্থ্যকে চাঙ্গা করছে। কিন্তু সেই কাজে এ রাজ্য অনেকটাই পিছিয়ে। যদিও রাজ্য প্রশাসনের অন্দরে পাল্টা বক্তব্য, কেন্দ্রীয় অর্থ ‘দয়ার দান’ নয়। জিএসটি চালু হওয়ার ফলে রাজ্যের নিজস্ব কর আদায়ের সুযোগ কমেছে। গোটা দেশ তথা এ রাজ্য থেকে যে কর আদায় করে কেন্দ্র, তার একটা অংশ ফিরিয়ে দেওয়ারই কথা তাদের। কিন্তু তা-ও পাওয়া যায় না পুরোপুরি। বকেয়া রয়েছে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা।
তথ্য বলছে, ২০২০-২১ বছরে রাজ্যের নিজস্ব আয় যেখানে ছিল ৬৫ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা, তা-ই ২০২৪-২৫ সালে (সংশোধিত হিসেবে) হয়েছে প্রায় ১.০৩ লক্ষ কোটি টাকা। রাজ্যের মোট রাজস্বে কেন্দ্রের অবদানও এই সময়সীমার মধ্যে ৮২ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে প্রায় ১.২৪ লক্ষ কোটি টাকা। কেন্দ্রের এই অংশের মধ্যে থাকে, আদায় হওয়া কেন্দ্রীয় করের একটা অংশ ফিরিয়ে দেওয়া (ডেভোলিউশন) বাবদ অর্থ এবং কেন্দ্রীয় অনুদান বা ‘গ্রান্টস-ইন-এড’। আধিকারিকদের একাংশের দাবি, ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের আমলে কেন্দ্রীয় করের ৭.২৬% পেত রাজ্য। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের আমলে তা বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ৭.৩৩% এবং ৭.৫২%। নবগঠিত ষোড়শ অর্থ কমিশনের কাছে করের আরও বেশি ভাগ চেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ (বিজেপিশাসিত-সহ বহু রাজ্যও এই দাবি জানিয়েছে)। ফলে ২০২০-২১ থেকে ২০২৫-২৬ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় করের ভাগ লাফিয়ে বেড়েছে। পাশাপাশি, কেন্দ্রের অনুদান খাতে প্রাপ্য অর্থ কখনও কমেছে, কখনও বেড়েছে। তবে গত পাঁচ বছরে মোট রাজস্বে কেন্দ্রীয় অবদান থেকেছে ৫০%-এর আশেপাশে।
রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, “জিএসটি চালু হওয়ার পরে রাজ্যের কর সংগ্রহের পথ অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়েছে। এমনকি, সেস বাবদ কেন্দ্রের নেওয়া অর্থও পায় না রাজ্য। তার উপর একশো দিনের কাজ, আবাস, গ্রামীণ সড়কের মতো প্রকল্পে কেন্দ্র বরাদ্দ বন্ধ রাখায় সেই কাজ রাজ্যকেই চালাতে হচ্ছে নিজস্ব খরচে।”
এ বছরই দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপর্ণ প্রভাব রাখা বড় ১৮টি রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্যের (ফিসকাল হেলথ ইনডেক্স) রিপোর্টে নীতি আয়োগ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের নিরিখে হওয়া ওই সমীক্ষায় অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে শীর্ষস্থানে রয়েছে ওড়িশা। পশ্চিমবঙ্গ ষোড়শ। আর কেন্দ্রীয় অর্থের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল না থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির হিসাবে এ রাজ্য ১৮-এর মধ্যে ১৭তম। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের দাবি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার মানুষের উপর নতুন করে করের বোঝা না চাপিয়ে মানুষের আর্থিক বোঝা লাঘবের চেষ্টা করে। এক কর্তার কথায়, “বিপুল অর্থ কেন্দ্রের কাছে আটকে না থাকলে রাজ্যেরও কোনও সমস্যা হত না।”
আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, রাজ্যের খরচের বোঝা কিন্তু বেড়েই চলেছে। লক্ষ্মীর ভান্ডারের বিপুল বরাদ্দের পরে আবাস যোজনায় ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে নতুন করে ১৫ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। অবশ্য কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী-সহ একাধিক প্রকল্পে বরাদ্দ কমেওছে। পূর্ত, পুর ও নগরোন্নয়নের মতো দফতরগুলিতে বরাদ্দ বেড়েছে নামমাত্র। এই অবস্থায় রাজ্যের একেবারে নিজস্ব রাজস্বের প্রায় ৯১% আসছে মাত্র আটটি ক্ষেত্র থেকে। সেগুলির মধ্যে রাজ্যের জিএসটি, আবগারি (প্রধানত মদ বিক্রি), স্ট্যাম্প-রেজিস্ট্রেশন এবং পেট্রল-ডিজ়েল বিক্রির আয়ের উপর বেশি ভরসা রাখতে হচ্ছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)