জামুড়িয়ার এক এলাকায় বর্ষায় জল ভর্তি খোলামুখ ‘অবৈধ’ খনি। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ
‘‘লকডাউনে একটু ঝটকা লাগলেও ধান্দা সামলে গিয়েছে। তাই এখন আর আনাজ বেচি না। যে ঠেলাটায় বেচছিলাম, সেটা যার থেকে নিয়েছিলাম ফেরত দিয়েছি’’—বলছিলেন রবি গড়াই। সমর্থনে ঘাড় নাড়েন দুলাল হেমব্রম। বলেন, ‘‘রাজমিস্ত্রির কাজে লাগার সুতো-পাটা-কর্নিকগুলো ধুয়ে-মুছে তুলে রেখেছি। আবার দরকার লাগলে বার করব।’’ সঙ্গে জোড়েন, ‘‘মনে হয় না, দরকার হবে।’’ সমীর বাদ্যকরের আবার বক্তব্য, ‘‘আমাদের টাকা মাঝে কমলেও, এখন ঠিকঠাক পাচ্ছি। পেশা বদলের কথা তাই ভাবিনি।’’
সমীর পেশায় ‘মালকাটা’ (অবৈধ কুয়ো-খাদানে কয়লা কাটেন), রবি ‘ঝিকাপার্টি’ (অবৈধ খনিগর্ভ থেকে খনিমুখ পর্যন্ত কয়লা আনেন), আর দুলাল ‘রসাটান’(খনিমুখ থেকে খনির উপরে কয়লা আনেন)। পুলিশ-প্রশাসন না মানলেও কারবারে জড়িতদের দাবি, পশ্চিম বর্ধমানের রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া, সালানপুর, বারাবনি-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় বেআইনি কয়লার ‘ধান্দা’ চলে। জেলায় প্রায় হাজার পাঁচেক কুয়ো-খাদান (কুয়ো খুঁড়ে কয়লা তোলা হয়), ১৬টি খোলামুখ অবৈধ খনি— মূলত এই দুই হল অবৈধ কারবারে কয়লার জোগানের জায়গা। অন্তত কুড়ি হাজার লোক এই কারবারে জড়িত। সে কারবারে ‘মালকাটা’দের দৈনিক মজুরি ১,০০০ টাকা, ‘ঝিকাপার্টি’দের প্রায় ৮০০ টাকা আর ‘রসাটান’দের প্রায় ৪০০ টাকা।
‘লকডাউন’-এর প্রথম দিকে, টানা প্রায় দু’মাস অবৈধ কয়লার কারবার পুরো থেমে গিয়েছিল পশ্চিম বর্ধমানে— এমনই দাবি কারবারিদের। গোটা এপ্রিল মাস কার্যত বসিয়ে সব শ্রমিককে খাওয়ান মালিকেরা। বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ কুয়ো-খাদানে কর্মরত ‘ঝিকাপার্টি’, ‘রসাটান’ শ্রেণির শ্রমিক রাম বাউড়ি, শেখ আমির, শামিম ইসলামেরা জানান, এপ্রিলে তাঁদের ও পরিবারের জন্য খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করেছেন ‘মালিকেরা’। রাম বাউড়ির দাবি, ‘‘এপ্রিলে জ্বর হয়েছিল আমার বউয়ের। ডাক্তার-ওষুধের খরচও মালিক দিয়েছেন।’’ সংশ্লিষ্ট ‘মালিক’ অবশ্য বলেছেন, ‘‘নিজের লোকের জন্য এটা করতেই হয়।’’
আরও পড়ুন: হাসপাতাল নয়, মন্দির চান দিলীপ
কিন্তু পকেটে টান পড়ায় মে মাস থেকে ‘ঝিকাপার্টি’, ‘রসাটান’দের খরচ টানতে পারেননি ‘মালিকেরা’। জামুড়িয়ার স্বপন রুইদাস, ইকড়ার মদন বাগদিরা তখন দিন কয়েকের জন্য নেমেছিলেন ‘সাদা’ কাজে। বলেন, ‘‘কয়েকটা দিন এলাকার বাজারে, পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে আনাজ বিক্রি করেছি। টুকটাক রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেছি।’’ ১০০ দিনের প্রকল্পের জব-কার্ড আছে প্রায় প্রত্যেকের। সে কাজ মেলে না, এমন নয়। করেন না কেন? ওঁদের জবাব, ‘‘১০০ দিনের কাজে কত ‘সিএফটি’ (ঘনফুট) মাটি কাটলাম, তার উপরে পয়সা মিলবে। সে টাকাও দিনের দিন হাতে আসবে না। কাটবই যদি কয়লা কাটব, তাতে রোজ টাকা পাব।’’
‘লকডাউন’-এর প্রথম দু’মাসে অবশ্য তা হয়নি। কারবারিদের একাংশের দাবি, ১ জুন থেকে ফের কুয়ো-খাদানে কয়লা কাটা শুরু হয়েছে। কিন্তু খোলামুখ খনিগুলিতে জল জমে থাকায় ‘কাজ’ শুরু হয়নি। কারবারের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ‘মাথা’র দাবি, ‘‘একটা কুয়ো খাদান থেকে ২৪ ঘণ্টা পাম্প দিয়ে জল তুলে কয়লা কাটা চালু করলে, দৈনিক এক হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু খোলামুখ খনিতে জল অনেক বেশি। সে জল মারতে পাম্প চালাতে গেলে ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি হবে।’’
কিন্তু শ্রমিকেরা যখন ‘সাদা’ কাজ করছেন, সে পর্বেও মালিকেরা কয়লা কাটার যন্ত্রের চালক, কয়লার পরিবহণকর্মী ও ‘মালকাটা’দের মাথা থেকে হাত সরাননি। এক ডাম্পার চালক জানান, এপ্রিলে তাঁদের পুরো মাস-মাইনে দশ-বারো হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। মে মাসেও তাঁদের ‘অর্ধেক’ বেতন, মাঝেমধ্যে খাদ্যসামগ্রী, প্রয়োজনে চিকিৎসার খরচ দিয়েছেন ‘মালিকপক্ষ’। তবে ‘মালকাটা’দের বেশির ভাগই বিহার, ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা হওয়ায় ওই পর্বে তাঁরা এক মাসের মজুরির বড় অংশ নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। এই মুহূর্তে অনেকে ফিরেছেন পশ্চিম বর্ধমানে।
রানিগঞ্জের অবৈধ কয়লার কারবারের এক ‘মাথা’ জানান, খোলামুখ খনিতে ন্যূনতম ৫০-৬০ জন কর্মী তিনটি ‘পালি’ (শিফট)-তে কাজ করেন। তাঁদের বসিয়ে-বসিয়ে এক মাসের মাইনে দিতে খরচ হয়েছে প্রায় পাঁচ-ছ’লক্ষ টাকা। কিন্তু কেন এই ‘খরচ’ ? এক মালিকের দাবি, ‘‘এটা ভরসার কাজ। ভরসার লোক হাতছাড়া করতে নেই।’’
কয়লা তুলে তা ঠিক ভাবে ‘পাচার’ করা গেলে, একটি কুয়ো-খাদান থেকে দিনে গড়ে ১৮ হাজার টাকা, খোলা মুখ খনি থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা লাভ থাকে বলে জানান এই ‘মাথা’রা। ফলে, ওই দু’মাসের ‘ক্ষতি’ পুষিয়ে নিতে পারবেন ওই ‘ভরসা’র কর্মীরাই। আর ক্ষতি পুষিয়ে দিতে কী ছক, তার সাক্ষী শিল্পাঞ্চলের কয়লার গুঁড়ো মেশা বাতাস!
(অবৈধ কয়লার কারবারে যুক্তদের নাম পরিবর্তিত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy