Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Uttar Dinajpur

অমানবিক! দেহ উদ্ধারে প্রশ্নে পুলিশ

পরিস্থিতির চাপে এ দিন সন্ধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক করেন জেলার পুলিশ সুপার মহম্মদ সানা আখতার। তাঁর দাবি, এর মধ্যেই দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

deadbody.

পুলিশ জোর করে ওই নাবালিকার দেহ তুলে নিয়ে গিয়ে ময়না-তদন্তে পাঠায় বলে অভিযোগ। প্রতীকী ছবি।

গৌর আচার্য 
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:৫৫
Share: Save:

অমানবিক— উত্তর দিনাজপুরে এক নাবালিকার দেহ ঝুলিয়ে আনা নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ উঠেছে সর্বত্র। সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে (যার সত্যতা আনন্দবাজার যাচাই করেনি), কী ভাবে দেহটি ঝুলিয়ে নিয়ে ছুটছেন কয়েক জন পুলিশ, কী ভাবে তাঁদের পিছনে চাদর হাতে চলেছেন আর এক পুলিশ। অভিযোগ, এই নাবালিকাকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয়। শুক্রবার তার দেহটি উদ্ধার হয়। তার পরে বিক্ষোভের মুখে এমনই দৃশ্য দেখা গিয়েছে বলে দাবি বিভিন্ন মহলে।

এই ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছে। এক দিকে, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে বিষয়টি নিয়ে টুইট করেছেন অমিত মালবীয়। সেখানে ভিডিয়োটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বিজেপির প্রতিনিধিদল এর মধ্যেই এলাকায় পৌঁছে গিয়েছে। অন্য দিকে, রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের তরফে পুলিশের কাছে এমন কাজের জবাব চাওয়া হয়েছে। জাতীয় শিশু সুরক্ষা কমিশনের দলও উত্তর দিনাজপুরে পৌঁছে গিয়েছে। শাসক দল তৃণমূলের রাজ্য এবং জেলা নেতৃত্বের তরফেও ঘটনাটির নিন্দা করা হয়েছে। যদিও এই নিয়ে বিজেপি ‘অকারণ রাজনীতি করছে’ বলেও তাদের দাবি।

পরিস্থিতির চাপে এ দিন সন্ধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক করেন জেলার পুলিশ সুপার মহম্মদ সানা আখতার। তাঁর দাবি, এর মধ্যেই দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘তিন জন চিকিৎসকের বোর্ড ময়না-তদন্ত করেছে। ময়না-তদন্ত প্রক্রিয়ায় মৃতার পরিবারের লোকেরা হাজির ছিলেন। ময়না-তদন্তের রিপোর্টে প্রাথমিক ভাবে বিষক্রিয়ার জেরে ওই নাবালিকার মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে। ওই নাবালিকার শরীরে বড় আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। তা-ও তদন্তে সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ তিনি জানান, পুরো প্রক্রিয়া ‘ভিডিয়োগ্রাফি’ করা হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অপহরণ, খুন ও ধর্ষণের মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু হয়েছে।

যদিও নাবালিকার পরিবার মনে করছে, পুলিশি তদন্তে সঠিক তথ্য না-ও বার হতে পারে। নাবালিকার বাবা দাবি করেন, “ভবিষ্যতে সিবিআই তদন্তের আশায় মেয়ের দেহ দাহ না করে বাড়ির সামনে সমাহিত করেছি।”

তাঁদের এই দাবিকে সমর্থন করে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার জানান, সিবিআই তদন্তের দাবিতে তাঁরা পরিবারটিকে সব রকমের সাহায্য করবেন। ঘটনাচক্রে, ২০১৮ সালে এই জেলারই দাড়িভিটে পুলিশের গুলিতে দুই তরুণের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। ‘ন্যায় বিচারের আশায়’ তাঁদের বাড়ির পাশে সমাহিত করা হয়েছিল।

কী ঘটেছিল শুক্রবার? স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই দিন বাড়ির অদূরে ওই নাবালিকার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন এলাকাবাসী। পাশে একটি কীটনাশকের কৌটো মেলে। তবে তাকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে নাবালিকার দেহ আটকে, রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন আত্মীয় ও স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ। তখন মৃতদেহ উদ্ধার করতে গেলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। বিক্ষোভকারীরা ইট-পাটকেল ছোড়েন বলে অভিযোগ। পুলিশ তাঁদের সরাতে লাঠি চালায়, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায়। পরে, পুলিশ জোর করে ওই নাবালিকার দেহ তুলে নিয়ে গিয়ে ময়না-তদন্তে পাঠায় বলে অভিযোগ। পুলিশের দাবি, ঘটনায় জড়িত অভিযোগে দু’জনকে ধরা হয়েছে। আদালত ধৃতদের ১৪ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

বিজেপি এই ঘটনা নিয়ে শুক্রবার থেকেই পথে নামে। এ দিন দলের পশ্চিমবঙ্গের সহকারী পর্যবেক্ষক অমিত মালবীয় টুইট তো করেনই, রায়গঞ্জের সাংসদ দেবশ্রী চৌধুরী, উত্তর মালদহের সাংসদ খগেন মুর্মু এবং সুকান্ত মজুমদার মেয়েটির বাড়িতে যান। সুকান্ত বলেন, “অমানবিক পুলিশ ওই নাবালিকার মৃতদেহের হাত-পা ধরে টেনে-হিঁচড়ে, চ্যাংদোলা করে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।’’ পরে তাঁরা দীর্ঘ ক্ষণ অপেক্ষা করেও পুলিশ সুপারের দেখা না পেয়ে তাঁর অফিসের দরজায় তালা দিতে চেষ্টা করেন। সেই সময় পুলিশের সঙ্গে তাঁদের ধস্তাধস্তি হয়।

সুকান্তেরা এলাকা থেকে চলে যেতেই অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে এ দিনও বাসিন্দাদের একাংশ রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করেন। এলাকার বেশ কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর ও একটি দোকানে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ফের পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। পুলিশ ফের লাঠি চালিয়ে, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। ঘটনায় সাত জনকে গ্রেফতারও করা হয়।

ঘটনাস্থলে যান রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুদেষ্ণা রায়ও। পরে তিনি বলেন, ‘‘কারও মৃত্যুর পরে, মৃতদেহেরও সম্মান দেওয়া প্রয়োজন। পুলিশের বিরুদ্ধে কেন অমানবিক ভাবে ওই নাবালিকার মৃতদেহ উদ্ধারের অভিযোগ উঠছে, তা জেলা পুলিশের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে।’’ জাতীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের তরফে একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি উত্তর দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা হয়েছে জানিয়ে কমিশনের প্রধান প্রিয়াঙ্ক কানুনগোর ক্ষোভ, ‘‘শুক্রবার থেকে পুলিশ সুপারকে ফোন করার চেষ্টা করছি। উনি ফোনই ধরেন না।’’ এসপি-র অবশ্য দাবি, ‘‘অন্য সময় সবার ফোন ধরি। কিন্তু শুক্র এবং শনিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যস্ত ছিলাম। তাই হয়তো ওঁর ফোন ধরে উঠতে পারিনি। ওঁরা জেলায় এসে তদন্ত করুন। কে ওঁদের বাধা দেবে?’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘মেয়েটির দেহ উদ্ধারের সময়ে কিছু লোক পুলিশকে বাধা দেয়, ইট-পাটকেল ছোড়ে। তদন্তের স্বার্থে মেয়েটির মৃতদেহের উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য পুলিশ সামান্য লাঠি চালিয়ে, নিয়ম মেনেই মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়না-তদন্তে পাঠায়।”

যদিও তৃণমূলের জেলা সভাপতি কানাইয়ালাল আগরওয়াল থেকে জেলার বাসিন্দা রাজ্যের মন্ত্রী গোলাম রব্বানিরও দাবি, পুলিশের বিরুদ্ধে লাঠি চালিয়ে, কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে মৃতদেহ উদ্ধারের অভিযোগ ওঠা কাম্য নয়। তবে রব্বানি বলেন, “কোন পরিস্থিতিতে ওই ঘটনা ঘটেছিল, তা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।” তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘বালিকার দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু। মৃতদেহ যে ভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেই দৃশ্য দেখতে ভাল লাগছে না। কিন্তু ওই এলাকায় বিজেপি নেতারা যে ভাবে প্ররোচনা ছড়াচ্ছেন, তাতে তার আগে কী হয়েছে, পরে কী হয়েছে সেই বিষয়টা জানতে হবে। কেউ মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় তাড়া করছিল কি না, তা-ও তদন্ত সাপেক্ষ।’’

নাবালিকার মায়ের আক্ষেপ, ‘‘মরেও মেয়েটা শান্তি পেল না!’’

অন্য বিষয়গুলি:

Uttar Dinajpur Death police Crime
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy