অর্জুনকে আদর দিদিমণি মুর্শিদা খাতুনের। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
অনুষ্ঠান শেষে গ্রুপফটো-পর্বে খুঁজে পাওয়া গেল না দস্যি আট বছরকে। রাতেই মুম্বইয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে ‘ফলো-আপে’র জন্য ট্রেন ধরতে হতো শ্রীরামপুরের লিউকেমিয়া-উত্তীর্ণ খুদেটিকে।
একরত্তি অরণ্যতেশ গঙ্গোপাধ্যায়ের রক্তে ক্যানসারের চিকিৎসায় আসবাব-গয়না বেচে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় অসহায় মা-বাবার। মুম্বই-কলকাতা করতে গিয়ে বেসরকারি সংস্থার চাকরিও রাখতে পারেননি তাঁরা। গত ডিসেম্বরে ক্যানসার-উত্তীর্ণ তকমা মেলার পরে প্রথমবার ফুটবল-সাঁতারে হাতেখড়ি ছেলেটির। রাশিয়ায় ‘ক্যানসার সারভাইভার’দের গেমসে টেবলটেনিসে সোনাজয়ী বালককে শনিবার দু’চোখ ভরে দেখল কলকাতা।
নজরুল মঞ্চে ‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল অ্যাওয়ার্ডস’-এর আসর মানেই অজস্র বিস্ময়ের উপাদান। সবে জীবনের দৌড়ে শামিল খুদেদের পাশেই বনস্পতির ছায়া হয়ে ওঠা সব পরম আশ্রয়ের আধার। বাংলার শিক্ষক কৃষ্ণনগরের ৮২ বছর বয়সী অমরেশ মিত্রকে ‘আজকের নোয়া’ আখ্যা দিলেন সঞ্চালক ব্যারি ও’ব্রায়েন। ২৩২ রকমের ধান, শতাধিক পাখির ডিম, ১৫০ বছরের দেশীয় ডাকটিকিট ভাঁড়ার, ৫০০ পাথর, জীবাশ্মের ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহ জীবনভর বাড়িতে জড়ো করেছেন মাস্টারমশাই। ইতিহাস-প্রকৃতির স্মারক জিইয়ে রাখার তাগিদে নোয়ার মতোই ধ্বংসের মুখে জীবনকে বাঁচানোর অভিযান। ক্যানসারে গৃহবন্দি শিক্ষিকা উমা বসু মজুমদার আসতে পারেননি। তবে খড়্গপুরের ৯৪ বছরের ঋজু শিক্ষয়িত্রী অলিভ লেননের জন্মদিনের কেক কাটা হল মঞ্চে। মিত্র ইনস্টিটিউশনের মাস্টারমশাই রণেশচন্দ্র রায়চৌধুরী এবং নিজের স্কুলে এক টাকা গুরুদক্ষিণা নেওয়া আউশগ্রামের অবসরপ্রাপ্ত হেডস্যার সুজিত চট্টোপাধ্যায়ও এক বন্ধনীতে ধরা পড়লেন।
সিকি শতক পার করার প্রাক্কালে এই আসর এখন নানা অসম্ভবের হয়ে-ওঠা স্পর্ধাও। এক যুগ আগে এখানে পুরস্কৃত কার্তিক কালিন্দী নিঃশব্দে সেটাই বলে গেলেন। একদা দুর্গাপুর কুষ্ঠ কলোনিতে ‘নির্বাসিত’ পরিবারের ছেলে সেই কলোনিকেই আঁকড়ে ধরেছেন। ইংরেজিতে অনার্স ও আইআইটি-তে উদ্যানচর্চার ডিপ্লোমার পরে ভাল চাকরির প্রস্তাব হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। কলোনিতে কার্তিকের নবদিগন্ত স্কুলের পাশে দাঁড়াল পুরস্কার-মঞ্চ। পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও স্কুলের আসবাব, সরঞ্জামের চটজলদি সহায়তায় উৎসুক কয়েকটি হাতও উঠে এল দর্শক আসনেই। অনেকটা একই ভাবে মুশকিল আসান হল, শিয়ালদহের প্ল্যাটফর্মবাসী অর্জুন দাসের। কাকদ্বীপের আবাসিক স্কুলে সুযোগ পেলেও অর্জুনের মা, বোনকে নিয়ে দুশ্চিন্তার একশেষ। আসরের ফাঁকেই বোন ও মায়ের থাকার বন্দোবস্ত হয়ে গেল দুঃস্থদের জন্য নির্দিষ্ট হস্টেলে। কার্তিককে পুরস্কার দিতে এসে আবেগে বেসামাল বেলডাঙার মাদ্রাসার প্রধানশিক্ষিকা, প্রান্তিক মেয়েদের জীবন পাল্টে দেওয়া দিদিমণি মুর্শিদা খাতুন। মারাত্মক দুর্ঘটনা, দুরারোগ্য অসুখের সঙ্গে লড়ে হার না-মানা নানা মুখের জন্য স্মরণীয় এমন একটি আসর। বধির পড়ুয়াদের অভিভাবকদের জোট কলকাতা অন্বেষা, বারাসতের ৫০ টাকা মাস মাইনের স্কুল মুকুলিকা স্বল্প উপস্থিতিতে দাগ কেটে গেল। আর স্বল্প সময়ে ছাপ রেখে গেলেন উদয়ন পণ্ডিতেরাও। ক্ষুধা, কুসংস্কার, ধর্ম-রাজনীতির অচলায়তনের বিরুদ্ধে যাঁরা লড়ে যাচ্ছেন। কোচবিহারের ইট ভাটায় দু’হাত হারিয়েও মাধ্যমিকজয়ী বিষ্ণু বর্মণকে সম্মানিত করলেন হিঙ্গলগঞ্জের উজান-ঠেলা প্রধান শিক্ষক পুলক রায়চৌধুরী। স্কুল বা স্কুলের বাইরে নানা উদ্যোগে পড়ুয়াদের জীবন যিনি বদলে দিচ্ছেন।
দুর্লভ সব মানুষ রতনের সান্নিধ্যে পুরস্কার-মঞ্চ তখন হয়ে উঠেছে মানুষ হিসেবে উত্তরণের এক উঠোন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy