সুনসান শেখ শাহজাহানের গ্রেফতারি স্থল। মিনাখাঁর মাদার টেরিজা মোড়। — নিজস্ব চিত্র।
বাসন্তী হাইওয়ের ধারে পাথর-বাঁধানো ছোট্ট একটি বেদী। কাচে ঘেরা সেই বেদীর মধ্যে মাদার টেরিজার আবক্ষ মূর্তি। আশপাশ শুনশান, মানুষজনের ভিড় তেমন নেই। শুধু হাইওয়ে ধরে দ্রুত গতিতে একের পর এক গাড়ি-মোটরবাইকের ছুটে চলা। জায়গার নাম মাদার টেরিজা মোড়। পুলিশের ‘অ্যারেস্ট মেমো’ অনুযায়ী, মিনাখাঁ থানা এলাকার এই জায়গাতেই বুধবার মধ্যরাত পেরিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে শেখ শাহজাহানকে!
শুক্রবার ভরদুপুরেই এ তল্লাটের যা জনশূন্য চেহারা, তাতে গ্রেফতারির সময়ে (অ্যারেস্ট মেমো অনুযায়ী রাত সওয়া ১টা) স্থানীয়দের কেউ এখানে ছিলেন কি না, কে জানে! শাহজাহানের গ্রেফতারির দাবিতে টিভির পর্দায় সরব হতে দেখা গিয়েছে সেখানকার বাসিন্দাদের অনেককে। কেউ কেউ টিভি-ক্যামেরার সামনে দাবি করেছেন ‘ফেরার’ শাহজাহানকে নিজের চোখে দেখার। সেই তুলনায় মিনাখাঁয় স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া যেন অনেকটাই আলাদা। সন্দেশখালির যে ‘বেতাজ বাদশা’, পাকড়াও হওয়ার আগে টানা ৫৬ দিন রাজ্য রাজনীতির শিরোনামে, তিনি যে নিজের বাড়ি থেকে এমন ঢিল ছোড়া দূরত্বে মাঝরাতে আচমকা গ্রেফতার হতে পারেন, তা ভেবেই বিস্মিত তাঁরা।
সন্দেশখালির ‘সম্রাট’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই বরং পাল্টা প্রশ্ন ধেয়ে এল— ‘‘এখানেই কি লুকিয়ে ছিলেন, নাকি ধরা পড়লেন পালাতে গিয়ে?’’ কেউ কেউ আবার প্রশ্ন করছেন, ‘‘এমন দাপুটে নেতা আর যাওয়ার জায়গা পেলেন না? যদি এত কাছেই থাকবেন, তা হলে ধরতে পুলিশের ৫৬ দিন লেগে গেল কেন?’’ শাহজাহান মিনাখাঁতেই ‘লুকিয়ে ছিলেন’, এমন কথা অবশ্য পুলিশ এক বারও বলেনি। সরকারি ভাবে শুধু জানানো হয়েছে, ওখানেই গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে এডিজি দক্ষিণবঙ্গ সুপ্রতিম সরকার শুধু বলছেন, ‘‘বিচারাধীন বিষয়।’’
মিনাখাঁ থানার একটি পুলিশ সূত্রের দাবি, ভান্ডারখালি, মৌখালি এলাকায় শাহজাহানের থাকার খবর পেয়ে হানা দিয়েছিল পুলিশ। পরে বাসে করে কলকাতার দিকে পালানোর চেষ্টা করছিলেন শাহজাহান। সেই খবর ছিল পুলিশের কাছে। তার উপরে শাহজাহানের জন্যই নাকি গ্রেফতারি আরও সহজ হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত। ওই সূত্রের দাবি, প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে ওই মোড়ে নামতেই তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। স্থানীয়দের অনেকে অবশ্য এমন কথা শুনে তাজ্জব। এক স্থানীয়ের কথায়, ‘‘পুলিশ যাকে খুঁজছে, যার অমন অঢেল পয়সা, সে কি না পালাতে গেল বাসে!’’ মাদার টেরিজা মোড়ের গেঞ্জি কারখানার কর্মী পিন্টু মণ্ডল বলছিলেন, ‘‘ওই লোকের যা প্রভাব, তাতে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে গোটা বাস নিয়েই যে দিকে
খুশি যেতে পারতেন। কী ভেবেছিলেন, কে জানে!’’
বাসন্তী হাইওয়ে ধরে কলকাতা থেকে মিনাখাঁ থানার দূরত্ব মেরেকেটে ৪০ কিলোমিটার। গ্রেফতারির পরে প্রথমে সেখানেই শাহজাহানকে আনা হয়েছিল বলে পুলিশের একটি সূত্রের দাবি। ভোরের দিকে ন্যাজাট থানার পুলিশকর্মীদের সঙ্গে বসিরহাট আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। মিনাখাঁ থানা পর্যন্ত পৌঁছে শাহজাহানের নাম করতেই কয়েক জন দেখিয়ে দিলেন বামনপুকুর বাজার। তাঁদের দাবি, বৃহস্পতিবার ভোরে এই বাজারের মাছ ব্যবসায়ীরাই নাকি প্রথম জটলা দেখেন। রটে যায় যে, পুলিশ শাহজাহানকে ধরে এনেছে। কিন্তু বেলা যত গড়াতে থাকে, বাজারের পরিবর্তে ততই উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে থানা থেকে ২০০ মিটারের মধ্যের মাদার টেরিজা মোড়। জানাজানি হয়ে যায়, ওই মোড় থেকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে পালিয়ে বেড়ানো ওই অধুনা বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতাকে।
এ দিন ওই মোড়ে গিয়ে দেখা গেল, কোনও পুলিশি প্রহরা নেই। আলাদা করে কোনও জটলাও চোখে পড়ল না তেমন। শাহজাহান ফেরার হওয়ার পরে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী প্রথমে এক বার বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন, কিন্তু তার পরে বহু বার দাবি করেছেন, সন্দেশখালি ও তার আশপাশেই রয়েছেন ‘এলাকার ত্রাস’। একই ইঙ্গিত মিলেছিল অন্যান্য বিরোধী নেতাদের কথাতেও। কিন্তু মাদার টেরিজা মোড়ে রাস্তার ধারে সাইকেল সারানোর দোকান থাকা খোকন ওঝা অবাক গলায় বললেন, ‘‘কখন কী হয়ে গেল, কিছুই তো জানতে পারলাম না! এমন লোক এত দিন এখানেই ছিল নাকি?’’ মূর্তির পাশের রাস্তা ধরে এগিয়েই পুকুরপাড়ে আশুতোষ ওঝার বাড়ি। তিনি আবার বললেন, ‘‘সন্দেশখালি, মিনাখাঁ, মালঞ্চ তো শাহজাহানেরই এলাকা। শেষে সেখানেই গ্রেফতার! তা হলে কি বিরোধী নেতাদের দাবিই ঠিক ছিল?’’
মধ্যরাতে এই মোড়ে ঠিক কী হয়েছিল, তা অন্তত স্থানীয়দের কাছে এখনও রহস্যে ঢাকা। ‘আসল ঘটনা’ আপাতত জানে শুধু মধ্যরাতের শুনশান রাস্তা আর ওই মূর্তি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy