—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
অতীতে অনেক বারই সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আর জি কর কাণ্ডে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায় অভিযুক্ত হওয়ায় সেই বিতর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিরোধীদের অনেকেরই অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে সিভিক ভলান্টিয়ারদের অনেকেই যে ‘বলশালী’ হয়ে উঠছেন, তা সঞ্জয়ের ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সংশ্লিষ্টদের নিয়োগে স্থানীয় শাসক দলের নেতা বিধায়ক, পঞ্চায়েত প্রধান, কাউন্সিলরের সুপারিশই যে এখন অন্যতম ‘যোগ্যতামান’, সেই অভিযোগও উঠছে। প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্টও।
যদিও প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, ২০১১ সালে সরকারি আদেশনামা অনুযায়ী পদ্ধতি মেনে চুক্তিভিত্তিক সিভিক-নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালে সেই আদেশনামা পরিমার্জনও করে সরকার। তবে অভিজ্ঞ আধিকারিকদের একাংশ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০১১ সালের মূল আদেশনামায় বলা হয়েছিল, কোনও ফৌজদারি মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে, আর্থিক দুর্নীতি, টাকা তোলা, রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক (পলিটিক্যাল পার্টিজ়ান বিহেভিয়ার) আচরণ-সহ আটটি কারণে কোনও সিভিককে বরখাস্ত করা হতে পারে। কিন্তু ২০১৭-এর পরিমার্জিত আদেশনামায় রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক আচরণের ধারাটিই আর রাখা হয়নি। বলা হয়, বিভাগের প্রধানের (হেড অব ইউনিট) নির্ধারিত অন্য যে কোনও ন্যায্য কারণ থাকলেও বরখাস্ত করা যাবে।
বিরোধীদের একাংশের বক্তব্য, সরকারি বিধি বা আদেশনামা সিভিক নিয়োগ বা পরিচালনায় কত দূর মানা হচ্ছে, মূল প্রশ্ন সেখানেই। মঙ্গলবারই আর জি কর মামলার শুনানিতে স্বজনপোষণের সুন্দর পন্থা’ আখ্যা দিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, কোন আইন এবং পদ্ধতিতে সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়োগ, বেতন সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য হলফনামা আকারে জমা দেওয়ার প্রস্তুতিও শুরু করেছে রাজ্য সরকার।
এ দিকে, প্রাক্তন ও বর্তমান পুলিশ কর্তাদের একাংশের অভিযোগ, নিয়োগপত্র না থাকায় সিভিক ভলান্টিয়ারদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এলেও বিভাগীয় তদন্ত করা সম্ভব নয়। আর ওই সুযোগে তাঁরা ক্ষেত্রবিশেষে পুলিশ কর্মীদের থেকেও ‘ক্ষমতাবান’। থানার ওসি এবং আইসিদের একাংশের অভিযোগ, বাস্তবে দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে সিভিক ভলান্টিয়ার জড়িয়ে পড়লেও, তাঁদের বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে বরখাস্ত করার কোন সুযোগ নেই। অভিযোগের ভিত্তিতে, মামলার তদন্তের গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী তাঁদের কর্তব্যরত অবস্থা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে জামিন পেলে ফের তিনি কাজে যোগ দিতে পারেন। কারণ, মামলা বিচারাধীন এবং তখনও তিনি দোষী সাব্যস্ত হননি। কিন্তু পুলিশ কর্মী গ্রেফতার হলে এবং বিভাগীয় তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে, তাঁকে বরখাস্ত করা যায়। তাঁর বেতন অর্ধেক করে দেওয়ারও সংস্থান রয়েছে।
নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না কেন? সরকারি সূত্রের বক্তব্য, পুরোপুরি চুক্তিভিত্তিক হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্টদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। তবে পুলিশের একটি শাখা (রিজ়ার্ভ অফিস) তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করে। প্রত্যেকের পরিচয়পত্র এবং একটি নম্বর দেওয়া থাকে। পুলিশের তহবিল থেকেই সংশ্লিষ্টদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। রাজ্য পুলিশ ও কলকাতা পুলিশ, হাসপাতাল, পুরসভা এমনকি, রাজ্য গোয়েন্দা দফতরে গত প্রায় ১৩ বছরে লক্ষাধিক সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ করা হয়েছে। বর্তমান মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা। সরকারি স্বাস্থ্য বিমার আওতায় রয়েছেন তাঁরা, তা ছাড়া অবসরকালীন ভাতা তিন থেকে বেড়ে হয়েছে পাঁচ লক্ষ টাকা। এ বার থেকে উৎসাহ ভাতাও বেড়ে হয়েছে ছ’হাজার টাকা।
সরকারি আদেশনামা অনুযায়ী, ন্যূনতম ২০ এবং সর্বাধিক ৩০ বছর বয়সিদের, যাঁরা অষ্টম শ্রেণি পাশ করেছেন, তাঁরা থানায় গিয়ে আবেদনপত্র ভর্তি করতে পারেন। একটি কমিটি সংশ্লিষ্টদের ইন্টারভিউ নেয়। সেই কমিটির চেয়ারম্যান পুলিশ কমিশনার বা পুলিশ সুপার। এক জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বা ডেপুটি কমিশনার ও এক জন ডেপুটি পুলিশ সুপার বা এসিপি থাকেন কমিটিতে। রাজ্যস্তরের কমিটিতে চেয়ারম্যান ডিজি, এডিজি (এ) এবং এক জন আইজি সদস্য থাকেন। কোনও সমস্যায় সেই কমিটি হস্তক্ষেপ করতে পারে। আদেশনামায় বলা রয়েছে, দু’সপ্তাহের প্রশিক্ষণ হবে। প্রতিমাসে অন্তত আরও একটি করে প্রশিক্ষণ হবে। আবেদনকারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকা চলবে না। গ্র্যাজুয়েট, এনসিসি, ক্যারাটে বা সিভিল ডিফেন্সের শংসাপত্র থাকলে অগ্রাধিকার মিলবে। মাসে সর্বোচ্চ ২০ দিন কাজ করানো যাবে সিভিককে।
তবে পুলিশের একাংশের অভিযোগ, খাতায়কলমে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, সরকারের কাজে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর সম্পর্কে যাবতীয় খোঁজখবর করার যে রীতি রয়েছে, তা এ ক্ষেত্রে হয় না বললেই চলে। প্রশিক্ষণও সর্বত্র সমান ভাবে হয় না। যদিও আর জি কর-কাণ্ডের পরে সিভিক-প্রশিক্ষণের উপর বাড়তি জোর দিয়েছে নবান্ন।
প্রশ্ন রয়েছে বাস্তবে সিভিকদের কাজকর্ম নিয়েও। এক পুলিশ-কর্তার কথায়, “সরকারি আদেশনামা অনুযায়ী, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, উৎসবের সময়ে ভিড় নিয়ন্ত্রণের কাজগুলিতে পুলিশকে সহযোগিতা করার কথা সিভিকদের। কোনও তদন্ত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বা কোর পুলিশিং-এর সঙ্গে তাঁদের যুক্ত করা যায় না।” কলকাতা হাইকোর্টও নির্দেশ দিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সিভিকদের ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু ভোটের সময়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগও উঠেছে।
আবার পুলিশ কর্তাদের একাংশের এ-ও অভিযোগ, রাজ্য পুলিশ ও কলকাতা পুলিশের এসটিএফের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগেও সিভিক ভলান্টিয়ারেরা রয়েছেন। তদন্তের গুরুত্বপূর্ণ খবর বাইরে চলে যাচ্ছে বলে কিছু ক্ষেত্রে জানাও গিয়েছে। কিন্তু আইনি পদক্ষেপ করা যাচ্ছে না। কেন? কলকাতারই একটি থানার অফিসারের অভিযোগ, “একটি গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে ভৎর্সনা করেছিলাম। মিনিট দশেকের মধ্যেই স্থানীয় বিধায়ক ফোন করে বলেন, ভুলভ্রান্তি সবাই করে। মানিয়ে চলতে শিখুন। না হলে বিষয়টি উপরতলায় পৌঁছে যাবে। তখন আপনার চাকরি করা অসুবিধা হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy