Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Death

‘এখন আর কারও মা নই আমি’

এখনও সকাল সকাল রান্নাটা সেরে নিতে হয়। অফিসে যান শুভ্রজিতের বাবা বিশ্বজিৎ। মায়ের হাতে তখন অঢেল সময়।

ছেলের ছবির সামনে মা শ্রাবণী চট্টোপাধ্যায়।

ছেলের ছবির সামনে মা শ্রাবণী চট্টোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।

সুনীতা কোলে
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২১ ০৬:৫৬
Share: Save:

মাধ্যমিকে সেকেন্ড ডিভিশন!

বেশ রাগই করেছিলেন মা। কয়েক দিন ভাল করে কথাও বলেননি। শেষে মায়ের অভিমান ভাঙাতে ছেলে জানায়, কলা বিভাগে ভর্তি হবে। মায়ের কাছেই পড়বে। মজা করে বলত, ‘‘দেখবে, উচ্চ মাধ্যমিকে এত ভাল রেজ়াল্ট হবে যে, খবরের কাগজে ছবি বেরোবে!’’

‘‘সত্যিই কাগজে ছবি ছাপা হল, তবে রেজ়াল্টের জন্য নয়। ক’দিনের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকের রেজ়াল্টও বেরোল। জানেন, স্টার পেয়েছিল ছেলেটা আমার।’’ ভেজা চোখে ম্লান হাসেন শ্রাবণী চট্টোপাধ্যায়। ইছাপুরের নেতাজিপল্লির এক চিলতে বাড়িটায় ঢুকলেই নজর টানে ছেলে শুভ্রজিতের বড়, বাঁধানো ছবিটা। কাছছাড়া হত না একমাত্র ছেলে। মামারবাড়ি থেকে পাড়ার পুজোমণ্ডপ— মা যেখানে, ছেলেও সেখানে। আগে এই সময়ে শ্রাবণীর ব্যস্ততা তুঙ্গে থাকত। সংসার সামলে সারা দিন কাটত পুজোর আয়োজনে। হামাগুড়ি দেওয়ার বয়স থেকে শুভ্রজিৎও মায়ের সঙ্গে ক’টা দিন হাজির মণ্ডপেই। স্থানীয় নেতাজি সঙ্ঘের সেক্রেটারি সুমিত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বড় হতে পুজোর কাজ করত শুভ্রজিৎও। কিছু দরকার হলে এনে দিত। সরল, হাসিখুশি। এমনটা ঘটবে, কেউ ভাবতে পারিনি।’’

সেই ব্যস্ততা এখন কোন অতীতের কথা মনে হয় শ্রাবণীর। পুরোহিতদের সঙ্গে প্রায় আত্মীয়তার সম্পর্ক। মাঝেমধ্যেই শুভ্রজিতের আবদারে বাড়িতে চা খেয়ে যেতেন। তাঁরা গত বছর এক দিন অনুরোধ করে মণ্ডপে নিয়ে গেলেও মন বসেনি মায়ের। বলেন, ‘‘পুজোর জোগাড় করতে, শীতলভোগ রান্না করতে ভালবাসতাম। আমি আর কারও মা নই এখন। মায়ের পুজোও আর টানে না।’’ গত বছর ২৪ জুন আদরের সোনাইয়ের জন্মদিনে তৈরি করা কেকের ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘‘খেতে খুব ভালবাসত। করেও দিতাম সাধ্যমতো। শুধু পুজোর ক’দিন রান্না করার সময় তেমন পেতাম না।’’

এখনও সকাল সকাল রান্নাটা সেরে নিতে হয়। অফিসে যান শুভ্রজিতের বাবা বিশ্বজিৎ। মায়ের হাতে তখন অঢেল সময়। কাউকে পড়াতে বসাতে হয় না। নিত্যনতুন রান্নার আবদার রাখতে হয় না। বিকেলে কেউ বলে না, ‘‘আমিও তোমার সঙ্গে হাঁটতে যাব।’’

মাস পনেরো আগে শুরু হয়েছিল লড়াইটা। ৯ জুলাই তিন-চার বার বমি করে দুর্বল হয়ে পড়েছিল ছেলে। পর দিন ভোরেই তাই পৌঁছন কামারহাটি ইএসআই হাসপাতালে। তার পরে বেলঘরিয়া মিডল্যান্ড নার্সিংহোম হয়ে ইএসআই-য়ে ফেরত। সেখান থেকে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে আবারও ইএসআই। শেষে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যখন পৌঁছন, ছেলে তখন নেতিয়ে পড়ছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে মরিয়া শ্রাবণী হুমকি দেন, ছেলেকে ভর্তি না নিলে আত্মহত্যা করবেন। বিকেল ৪টে নাগাদ ভর্তির পরে সন্ধ্যায় জানানো হয়, শুভ্রজিৎকে সুপার স্পেশালিটি ব্লকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর ১১ জুলাই সকালে ফোন আসে, আগের রাতেই সাড়ে ন’টা নাগাদ মৃত্যু হয়েছে শুভ্রজিতের।

শুরু হয় লড়াইয়ের দ্বিতীয় পর্ব। শ্রাবণী বলেন, ‘‘ইএসআই-তে বলেছিল, ছেলের সুগার ৬০০ ছাড়িয়েছে। কিন্তু কোনও দিন অসুস্থ লাগছে বলেনি। তবে মিডল্যান্ডে রক্ত নিয়ে কিটে দেওয়ার দু’মিনিটের মধ্যে সাদা কাগজে লিখে দিল ‘কোভিড পজ়িটিভ’। স্বাস্থ্য ভবন থেকে বলল, ওটা কোভিড রিপোর্ট নয়। ওদের কাছে শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের তথ্য নেই। কোথাও ভর্তি নিল না। রিপোর্টটা নিয়ে বার বার সন্দেহ প্রকাশ করলেও কেউ আমল দেয়নি।’’

মায়ের সন্দেহ সত্যি প্রমাণ করে গত অগস্টে জানা গেছে, শুভ্রজিতের করোনা হয়নি। তবে এখনও জানা যায়নি মৃত্যুর কারণ। মায়ের চোয়াল এ বার শক্ত হয়। ‘‘এ টুকু জানতেও ১৩ মাস লাগল। ছেলেকে কেন হারালাম, সে টুকু জানারও কি অধিকার নেই?’’ চিকিৎসার আশায় হন্যে হয়ে ঘোরার সময়ে ছেলের মুখটা মনে করে ডুকরে ওঠেন বিশ্বজিৎও। বলেন, ‘‘হাসপাতালের মেঝেতে শুইয়েও যদি ডাক্তারেরা দেখতেন, তা হলে হয়তো আমাদের ঘর ফাঁকা হয়ে যেত না।’’ সংবাদপত্র থেকে খবরটা জেনে পাশে দাঁড়িয়েছেন বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীন সাহুর মতো আইনজীবীরা, অম্বিকেশ মহাপাত্রের মতো মানবাধিকার কর্মী। চলছে একাধিক মামলা।

অসম্পূর্ণ ময়না-তদন্তের রিপোর্ট, মামলার নথি নাড়াচাড়া করেন শ্রাবণী।

ফ্রেম থেকে তাকিয়ে থাকে শুভ্রজিৎ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy