বগটুই গ্রামের বাসিন্দা মিহিলাল শেখ হারিয়েছেন স্ত্রী শেলি বিবি ও সাত বছরের মেয়ে তুলিকে। বৃহস্পতিবার গ্রামে ফিরে মেয়ের নাম বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিহিলাল। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
আমরা তো এই হত্যাটাই চাইছি না
উনিশশো চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন থেকে আমি টানা কলকাতায় আছি। তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। সে সময়ে তো এত খুনোখুনি হত না! তার পরেও বাংলায় খুনোখুনির ছড়াছড়ি ছিল, এমন স্মৃতিও কিন্তু নেই। কাজেই খুনোখুনিকে এই রাজ্যের ঐতিহ্য বলে দেগে দেওয়াটা ঠিক হবে না। মারপিট হত, গুন্ডামি ছিল, এক-আধটা লাশও পড়ত মাঝে মাঝে। কিন্তু ব্যাপক হারে খুন-জখমের খবর ছিল না। বামফ্রন্টের আমলেও প্রথম দিকটা মোটামুটি শান্তিতেই ছিলেন বঙ্গবাসী। অশান্তি দেখা দিল নকশাল অভ্যুত্থানে। সেই আন্দোলন নেতৃত্বহীন ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ায় আমরা প্রথম ব্যাপক হারে লাশ পড়তে দেখেছিলাম দিনের পর দিন। লাশ ফেলার রাজনীতির সেই শুরু। বিস্তর রক্তপাতের পরে সেই আন্দোলন স্তিমিত হল বটে, কিন্তু একটা মারমুখো রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেল। লাশ পড়ার ধারাবাহিকতাও শুরু হয়ে গেল।
পশ্চিমবঙ্গ একটু অন্য রকম রাজ্য। একে তো এটি ভারতবর্ষের একমাত্র আসমুদ্রহিমাচল রাজ্য। তার উপরে এর তিনটে আন্তর্জাতিক সীমানা। বাংলাদেশ, ভুটান আর নেপাল। সেই সঙ্গে রাজ্যটি উত্তর-পূর্ব ভূখণ্ডের করিডর। অনুপ্রবেশ, চোরাচালান এবং অন্যান্য অপকর্মের আদর্শ জায়গা। এই রাজ্যে বিভিন্ন প্রদেশের বিস্তর মানুষের সমাগম এবং বসবাস। জীবনযাপনে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা। আর যত জনসংখ্যা বাড়ে, ততই বেকার বাড়ে, দুষ্কর্মও বৃদ্ধি পায়। জমি-মাফিয়াগিরি, প্রোমোটিং, তোলাবাজি, অস্ত্র এবং মাদকের চোরাচালান— সব কিছুর সঙ্গেই হিংস্রতার সম্পর্ক মামা-ভাগ্নের মতো। এ সব কাজ তো বৈষ্ণব মতে হওয়ার নয়! আর একটা প্রেম হল রাজনীতির সঙ্গে সমাজবিরোধীদের। সেটা স্বাভাবিক। আর এটাও বিদিত যে, সমাজবিরোধীদের কোনও দল হয় না। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তখন তারা সেই দলে ভিড়ে যায়। এটা বরাবরই দেখে আসছি। তখন জনসংখ্যা কিছু কম ছিল এবং সমস্যাগুলি তত জটিল ছিল না বলে এত লাশ পড়ত না। নইলে বিধান রায়েরও কিন্তু গুন্ডাবাহিনি ছিল। তার সর্দারের নাম সবাই জানে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি যে বামফ্রন্টের আমল থেকেই হিংস্র হয়ে উঠেছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু বামফ্রন্টের অনেক নেতাই অতি সৎ, ত্যাগব্রতী এবং নির্লোভ। তবু হিংস্র রাজনীতি এবং গুন্ডারাজের কাছে তাঁদের মাথা নোয়াতে হয়েছে। বাধ্য হয়েই। পার্টি করা একা জিনিস, আর গভর্ন্যান্স অন্য জিনিস। এখন সমাজবিরোধী আরও বেড়েছে, যার কারণ অতিমারি এবং তজ্জনিত কর্মহীনতার ব্যাপক বৃদ্ধি। ফলে বহু মানুষ রাজনীতিতে ভিড়ে পড়ছে ‘টু পাইস’ কামানোর আশায়। এরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দলের প্রতি এদের কোনও আনুগত্য থাকার কথা নয়। যার হাতে ক্ষমতা, এরা তাদেরই মন রেখে চলে মাত্র।
আমার মনে হয়, এই রাজ্যকে সুশাসনে বেঁধে ফেলা অতি কঠিন কাজ। বিশেষ করে, দলের সঙ্গে দলের খেয়োখেয়ি, নেতৃবৃন্দের পরস্পরের প্রতি বিষোদ্গার, অশ্রদ্ধা, অসহযোগ, বিরুদ্ধ প্ররোচনা, ছিদ্রসন্ধান— সবই ওই হিংস্র মনোভাবকেই বাতাস দেয়।
গত কিছু দিন ধরে বাংলায় যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দুর্ভাগ্যজনক হল, এই অসময়ে যখন সকলের একজোট হয়ে এই প্রবণতার হাত থেকে রাজ্যকে রক্ষা করার উপায় উদ্ভাবন করা উচিত, ঠিক তখনই চলছে এর ওর উপরে দায় চাপানোর চেষ্টা। যখন দেশ বা রাজ্য বিপন্ন, তখন যদি শাসক ও বিরোধী এককাট্টা হয়ে তার মোকাবিলা করত, তা হলে হয়তো আমাদের সোনার বাংলার স্বপ্ন আর অলীক থাকত না।
রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে যে নারকীয় ঘটনা ঘটেছে, তার নিন্দার কোনও ভাষা আমার জানা নেই। খুনি হয়তো ধরা পড়বে এবং শাস্তিও হবে, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। তাতে তো মৃতেরা প্রাণ ফিরে পাবে না। আমরা তো এই হত্যাটাই চাইছি না। এ রকম সব হত্যাকাণ্ডকে বন্ধ করতে হলে দলমত-নির্বিশেষে সব নেতৃবৃন্দকে এককাট্টা হয়ে এর উপায় চিন্তা করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy