যাঁরা মৃত, তাঁদের দেহ ফিরছে। কিন্তু এ রাজ্যের অনেক পুণ্যার্থী এমনও আছেন, মঙ্গলবার গভীর রাতে প্রয়াগরাজে কুম্ভস্নান করতে গিয়ে দুর্ঘটনার পর থেকে যাঁরা না বাড়ি ফিরেছেন, না তাঁদের খবর মিলেছে। শুক্রবার রাত পর্যন্ত তাঁদের সন্ধান না মেলায় উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে পরিবারের।
বীরভূমের রামপুরহাট পুর-এলাকার বাউড়িপাড়ার বাসিন্দা বছর আটান্নর গায়ত্রী দে যেমন। তাঁর ছেলে প্রতাপ দে জানান, মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জ থেকে জ্যেঠতুতো বোন-সহ অনেকের সঙ্গে কুম্ভ মেলায় গিয়েছিলেন গায়ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘মাকে আমার ভাগ্নে সোমবার রাতে ট্রেনে চাপিয়ে দিয়েছিল। মঙ্গলবার রাত থেকে মায়ের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই।’’ এ দিন বিকেলে এক পড়শির কাছ থেকে কুম্ভমেলায় পদপিষ্ট হয়ে মৃতদের ছবি দেখতে পান প্রতাপ। তাঁর দাবি, একটি ছবি দেখে তাঁর মনে হয়েছে, তা তাঁর মায়ের মৃতদেহের ছবি। পরিবারের তরফ থেকে রামপুরহাট থানায় বিষয়টি জানানো হয়েছে। মহকুমাশাসক (রামপুরহাট) সৌরভ পাণ্ডে বলেন, ‘‘মৃতদের তালিকায় থাকা ছবি দেখে পরিবারের লোক দাবি করছেন, গায়ত্রীদেবী মারা গিয়েছেন। আমাদের কাছে সরকারি ভাবে এ বিষয়ে খবর নেই।’’ তবে জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, ‘‘শুনেছি এটা। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। প্রশাসনের দিক থেকে সত্যতা যাচাই করে নিঃসন্দেহ হওয়ার চেষ্টা চলছে।”
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ের সবিতা দেবনাথ ও গোসাবার গীতা মণ্ডল কুম্ভমেলায় দুর্ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ। সবিতার ছেলে মানস ও তাপস দেবনাথ বলেন, “শুনলাম, দুর্ঘটনার সময় মা ঘটনাস্থলেই ছিলেন। মেলাতেও যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছি।” গীতার ছেলে গৌরাঙ্গ মণ্ডল বলেন, “গত ২৯ জানুয়ারি (বুধবার) ভোর থেকে নিখোঁজ মা। স্থানীয় থানায় জানিয়েছি।” বুধবার ভোরেই মহাকুম্ভে স্নান শেষে ফেরার সময় নিখোঁজ হয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার রজনীকান্ত পয়ড়্যা নামে এক বৃদ্ধ। মহাকুম্ভের ৬ নম্বর ঘাটে স্নানের পরে মেয়ে-জামাই আর তাঁর খোঁজ পাননি। এগরা থানায় বৃদ্ধের ছেলে নিখোঁজ-ডায়েরি করেছেন। কুম্ভমেলায় গিয়ে একই দিনে নিখোঁজ কোলাঘাটের রায়চক গ্রামের বছর আশির বৃদ্ধ, নাম পঞ্চানন মণ্ডল।
দুই পড়শির সঙ্গে কুম্ভমেলায় গিয়ে নিখোঁজ হন হুগলির বৈদ্যবাটীর মাছ ব্যবসায়ী দীনেশ ঘোষ। বুধবার ভোরে প্রয়াগরাজের সঙ্গমঘাটে স্নানে যাওয়ার সময় ভিড়ে হারিয়ে যান দীনেশ। আর তাঁর খোঁজ পাননি পড়শিরা। দীনেশের ছেলে হিরণ্ময় এ দিনই বাবার খোঁজে প্রয়াগরাজের উদ্দেশে রওনা হন। কুম্ভে গিয়ে মঙ্গলবার রাত থেকে নিখোঁজ মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের প্রৌঢ়া তুলো দাস। বুধবার মহাকুম্ভের স্নানের পরে নিখোঁজ উত্তর দিনাজপুরের ডালখোলার ধীরেন মজুমদার এবং করণদিঘির মণিবালা বিশ্বাস। দু’জনেই স্নানের পর থেকে দলছুট বলে দাবি। দু’টি পরিবারই প্রয়াগরাজের ‘টোল-ফ্রি’ নম্বরে নিখোঁজদের পরিচয় জানিয়ে ডায়েরি করেছে।
এরই মধ্যে কুম্ভে গিয়ে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয়েছে আলিপুরদুয়ারের জয়গাঁর মিঠুন শর্মার (৩২)। রবিবার কয়েক জন পর্যটক নিয়ে প্রয়াগরাজে যান পেশায় টুর-গাইড মিঠুন। বৃহস্পতিবার ভোরে এক ব্যক্তি তাঁর অসুস্থ হওয়ার খবর দেন পরিবারকে। তার ঘণ্টাখানেক বাদে মৃত্যুসংবাদও দেন।
কুম্ভে মৃত শালবনির বৃদ্ধা ঊর্মিলা ভুঁইয়ার দেহ এ দিন বিকেলে পৌঁছয় মেদিনীপুরে। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের মর্গে ঊর্মিলার দেহের ময়না তদন্ত হয়েছে। হাসপাতালের সুপার ইন্দ্রনীল সেন বলেন, “শালবনি থানা সুরতহাল করেছে। তার ভিত্তিতে ময়না তদন্ত করেছি।” এ দিনই পশ্চিম বর্ধমানের জামুড়িয়ার কেন্দা মুচিপাড়ার বাড়িতে দেহ ফেরে একই দুর্ঘটনায় মৃত বিনোদ রুইদাসের। বিনোদের স্ত্রী শর্মিলা বলেন, “বাড়িতে রোজগেরে বলতে আর কেউ নেই। উত্তরপ্রদেশ সরকার মৃত্যুর শংসাপত্র দেয়নি। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা বলতে কিছু রইল না।” যদিও স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক হরেরাম সিংহের দাবি, “পশ্চিম বর্ধমান জেলা প্রশাসন উত্তরপ্রদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি তদারক করবে।”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)