তালবাঁধ গ্রামে আগামীর পাঠশালা। নিজস্ব চিত্র
শ্বাস নিতে গেলে কষ্ট হয়। খাবার গলা দিয়ে নামতে চায় না, বুকে কষ্ট হয়। হাত ও পায়ের আঙুলগুলি বেঁকে গিয়েছে। একসময় পাথর ভাঙার কর্মী সরস্বতী টুডু জানেন না, তাঁর শরীরে কী রোগ বাসা বেঁধেছে। ‘সিলিকোসিস কি?’ প্রশ্ন শুনেই মুখ শুকনো করে বলে ওঠেন, “কী জানি! কিছু হবে হয়তো।”
বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের তালবাঁধ গ্রামের বছর ষাটের বৃদ্ধা রোগের বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে, আট বছরের নাতনিকে শুধোলেন, “আজ পড়তে যাসনি কেন?” তাঁদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই ক্লাবে প্রতি দিন বিকেলে বসে ‘আগামীর পাঠশালা’। যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের সহায়ক শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেছে জেলা প্রশাসন। গ্রামের স্কুলে প্রচলিত শিক্ষা মিললেও বাড়িতেও যে শিক্ষা চর্চার প্রয়োজন হয় সেটাই মিলছে এই পাঠশালায়। ১৩০০ শিশুকে নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে চলা প্রকল্পে কয়েক হাজার টাকা বেতনে পড়ানোর কাজ করছেন গ্রামেরই ১৮ জন শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী। পাথর খাদানের গ্রামের বাতাসে ভেসে বেড়ায় সিলিকোসিসের বিষ। যা শরীরে বাসা বেঁধে ধীরে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। সেটাই অলিখিত ভবিতব্য পাথর খাদান, ক্রাশারে ঘেরা তালবাঁধ, জেঠিয়া, হাবড়াপাহাড়ি সহ বিস্তীর্ণ এলাকার বহু মানুষের। সব জেনেও একটা সময়ের পরে পড়াশোনা ছেড়ে রোজগারের নেশায় তাতে পা বাড়ায় কিশোরেরা। সেই চিন্তাধারাতেই পরিবর্তন আনতে চাইছে প্রশাসন। জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, “কিছু উন্নয়নকে চোখে দেখা যায় না। তবে যেগুলি দেখা যায়, তাকে সংহত করে এই অদৃশ্য উন্নয়ন।” তাঁর মতে, শিশুকেও বোঝাতে হবে, তারাও বড় হয়ে ভাল কিছু করতে পারে।
তিনি জানান, প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সর্বশিক্ষা মিশনের ‘কমিউনিটি মোবিলাইজ়েশন’ খাতে অনুদানের আবেদন করা হয়েছে। যাতে পিছিয়ে পড়া জনজীবনেও তা ছড়িয়ে দেওয়া যায়। অতিমারিতে স্কুল যেতে না পেরে ভাঁড়কাটা, হিংলো, পুরাতন গ্রাম, দেউচা পঞ্চায়েতের শিশুদের কমপক্ষে ৯৫ শতাংশ ভুলে গিয়েছে অক্ষর বা বর্ণ পরিচিতি। জানুয়ারি থেকে ওই চারটি পঞ্চায়েতের ২৩টি গ্রামে ছুটির পরে স্কুলের বারান্দায়, গাছের তলায়, বাড়ির উঠোনেই চলছে সহায়ক পাঠশালা। কেমন চলছে? কাপাসডাঙা রোডে দেখা হওয়া শীর্ণকায় বৃদ্ধ বললেন, “এমনটা দরকার ছিল গো বাবু। ছেলেমেয়েগুলিকে এবার মানুষ হতে হবে।” কথা শেষ হয় না, কাশির দমক ওঠা বৃদ্ধ পথ দেখিয়ে, শুনসান রাস্তায় পা বাড়ান। ধেনুপাড়ার বাসিন্দা দূরশিক্ষায় দর্শনশাস্ত্রে এমএ পাঠরতা সোনামনি বাস্কি তখন খুদেদের শেখাচ্ছেন ‘এক হাততালি মানে দশ। একটা টুসকি মানে এক।’ হাততালি ও আঙুলে টুসকির শব্দ শুনে খুদের দল যোগ কষছে। সোনামনির মতই শিব হেমব্রম, রূপালি মার্ডি-রা প্রতিদিন জীবনের পাঠ দিচ্ছেন খুদেদের।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির পক্ষে দেবরাজ মুখোপাধ্যায় বলেন, “প্রথমে লোকজনের সন্দেহ ছিল কয়লা শিল্পের জন্য বোঝাতে এসেছি। পরে অবশ্য ভালটা বুঝেছেন।” গ্রামের বাতাসের বিষ কী ওদের এগিয়ে যেতে দেবে? জেলাশাসক বলেন, “সিলিকোসিস থেকে শুরু করে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে কি না তা জানতে বিশেষ স্বাস্থ্যশিবিরে জোর দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের অপ্রতুলতা মেটানো, আশাকর্মী নিয়োগ হচ্ছে।” কিন্তু সিলিকোসিস রোগীদের জন্য ঘোষিত স্বাস্থ্য নীতির সুফল কী মিলছে? জেলাশাসকের দাবি, “বিডিওদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, উদ্যোগী হয়ে সরাসরি বিষয়টি দেখতে হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy